আমরা ভিক্ষুক না, নাম পরিচয় লিখে বেইজ্জত করবেন না


প্রকাশিত: ০৩:২৮ পিএম, ১১ জুন ২০১৬

রাজধানীর একটি ব্যস্ততম মার্কেটে শুক্রবার সন্ধ্যায় প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছিল দুইশিশু। ওদের একজনের বয়স আনুমানিক দশ ও আরেকজনের খুব বড়জোর আট বছর হবে।

প্ল্যাকার্ডটিতে লেখা ‘সাহায্য চাই, আমরা এতিম। বাবা নাই, মা অচল। এক ভাই এক বোন। আমরা মাদ্রাসায় পড়ি। আমাদেরকে সাহায্য করুন।’

ছোট্ট শিশু দুটিকে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এ প্রতিবেদক মোবাইলে তাদের চিত্রধারণ করতে গেলে মেয়েটি দ্রুত পা ফেলে হেঁটে পালাতে থাকে। হঠাৎ করে বোনকে এভাবে পালাতে দেখে ছেলেটি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড পর সেও বোনের পিছু নেয়। বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে শিশু দুটিকে ফের প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াতে দেখা যায়।

ছোট মেয়েটি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বারবার পিছনে উঁকিঝুঁকি মারছিল। তাদের চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ না থাকলেও দরিদ্র পরিবারের সন্তানের কোনো প্রতিচ্ছবি ছিল না।

কৌতুহলবশত এ প্রতিবেদক উল্টো পথ ঘুরে শিশু দুটির সামনে দাঁড়ালে মেয়েটি দুইহাত জোর করে বলতে থাকে ‘স্যার, আমাগোরে থানায় নিয়েন না, আমরা ভিক্ষুক না। দুই ভাইবোন মাদ্রাসায় পড়ি। যা সাহায্য পাই তা দিয়ে মাদ্রাসার বেতনভাতা দেই, বাকি টাকা দিয়ে মা বাজার সদাই করেন।’

ছোট্ট মেয়েটি  যখন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলো তখন ভাই সেখান থেকে সটকে পড়ে। মিনিট খানেকের  মধ্যেই বোরকা পরিহিতা মধ্যবয়সী এক নারী সেখানে হাজির হন।

ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলতে থাকেন, আমরা ভিক্ষুক না, নিতান্ত পেটের দায়ে ও ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার খরচ যোগাতে সাহায্যের জন্য মার্কেটের ভেতর দাঁড়িছি।

তাকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে অভয় দিতেই শিশু দুটির চোখমুখ থেকে আতংকের চিহ্ন উবে যায়। তারা জানায়, পুলিশ ভিক্ষুক ভেবে ধরে নিয়ে যেতে পারে এ আশঙ্কায় তারা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

ওই নারী জানান, সন্তানদের নিয়ে এভাবে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে তা কোনোদিন কল্পনাও করেননি। এক সময় গ্রামে (শরীয়তপুর সদরের বড় বিনোদপুর) তাদের দোতলা বাড়ি ছিল, জমিজমাও ছিল। কিন্তু ২০০৭ সালে স্বামী দুরারোগ্য ব্যধিতে অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসায় প্রচুর টাকা খরচ হয়। জমিজমা বিক্রি ও বন্ধক রেখে চিকিৎসার খরচ চালান। দুই বছর  চিকিৎসা চালিয়েও স্বামীকে বাঁচাতে পারেননি।

স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি চোখে মুখে অন্ধকার দেখেন। সংসারের হাল ধরতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে আইসক্রিম বিক্রি করেন। ভারি আইসক্রিমের বাক্স টানতে টানতে এক সময় মেরুদণ্ডের হাঁড় ক্ষয় হয় হলে তিনিও কর্মহীন হয়ে পড়েন। টাকা পয়সার অভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধও কিনে খেতে পারেননি।

তিনি আরো জানান, তার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় ছেলে মুদি দোকানে চাকরি করে। যা বেতন পায় তা দিয়ে তার হাত খরচ চলে। মেয়েটি কেরানীগঞ্জের একটি মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে ও ছেলেটি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। প্রতি শুক্রবার ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মার্কেটে আসেন। ছেলেমেয়েকে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড় করিয়ে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন।

তিনি জানান, ছেলেমেয়ে দুটিকে দেখে মানুষ কমবেশি সাহায্য করেন। প্রতি শুক্রবার প্রায় দেড় হাজার টাকা পান। তা দিয়ে বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ চালিয়ে অবশিষ্ট টাকা দোকা

নির কাছ জমা দেন।

তিনি আরো জানান, বাকি খেয়ে জীবন কাটছে তাদের। যখনই হাতে কিছু টাকা আসে তখনই তা দোকানিকে দিয়ে দেন। গ্রামে এখনো তাদের জমি আছে। ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় বন্ধক রয়েছে। টাকার অভাবে ছাঁড়াতে পারছেন না।

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ওই নারীর চোখ থেকে পানি পড়তে দেখে সন্তান দুটি ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। জড়সড় হয়ে মায়ের হাঁটু জড়িয়ে ধরে।

এমইউ/এমএমজেড/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।