জীবিকার উৎস যখন ময়লা


প্রকাশিত: ০৪:০৮ এএম, ১১ জুন ২০১৬
রাজধানীতে তৃণমূলের একটি অংশ রয়েছে, যারা জীবিকার জন্য নির্ভর করে ডাস্টবিনের ময়লা-আবর্জনার উপরই

বর্জ্য। রাজধানী ঢাকার নিত্যদিনের এক সমস্যা। এ সমস্যায় নাগরিক জীবন যেন ওষ্ঠাগত। নগরের দায়িত্বে যিনিই এসেছেন, তিনিই নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু উদ্যোগ-উদ্দীপনা ঘোষণাতেই আটকে থেকেছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। চিত্র বদলেছে রাজধানীরও। তবে বর্জ্য সমস্যা থেকেছে আগের মতোই। বিভক্ত নগরীর দুই মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই পরিচ্ছন্ন নগরী উপহার দিতে নানা চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। দৃশ্যমান কিছু পরিবর্তন এসেছেও বটে। কিন্তু মানুষ তাতে ভরসা রাখাতে পারছে না। নানা অব্যবস্থাপনার কারণে বর্জ্য অপসারণ এখনও এই শহরের মৌলিক সমস্যাগুলোর একটি। বর্জ্য, বর্জ্য অপসারণ, অপসারণে অব্যবস্থাপনা, বর্জ্য থেকে জীবিকা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন করেছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু, নিজস্ব প্রতিবেদক আবু সালেহ সায়াদাত ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সুব্রত মণ্ডল। আজ থাকছে প্রথম পর্ব: জীবিকার উৎস যখন ময়লা।  

প্রায় দুই কোটি মানুষের বাস রাজধানী ঢাকাতে। হাজারো সমস্যায় জর্জরিত এ শহরের মানুষেরা। তারপরও প্রতিনিয়ত এই শহরে মানুষের সংখ্যা বাড়ছেই। সেই সঙ্গে বাড়ছে সমস্যার পরিধি।

বাড়ি ভাড়ার চাপ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাস্তা-ঘাটের বেহাল দশা, গণপরিবহনের সঙ্কট ও যানজটের সঙ্গে ঢাকাবাসীর জন্য অভিশাপ হয়ে আছে এই শহরের ডাস্টবিনগুলো। ডাস্টবিনের আবর্জনার উৎকট দুর্গন্ধের কারণে প্রতিনিয়ত চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে পথচারীদের। এই দুর্ভোগের বিস্তৃতি রাজপথ থেকে অলিগলি সবখানে, মাত্রা সীমাহীন।  

পরিবেশবিদরা মনে করেন, যতগুলো কারণে রাজধানী ঢাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম এই ডাস্টবিনগুলো।   

যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব ডাস্টবিন থেকে নির্গত দুর্গন্ধ বাতাসকে করে তোলে ভারি। ডাস্টবিনের সামনে দিয়ে হাঁটতে গেলে মানুষকে নাকে রুমাল জড়িয়ে চলতে হয়।

Dust
প্রতিদিন গড়ে ১০০ টাকার ভাঙরি বিক্রি করতে পারে কিশোর রাকিব

যেখানে এসব ডাস্টবিনের ধারেকাছে ক্ষণিকের অবস্থানই জীবনকে বিষিয়ে তোলে, জীবনকে দুঃসহ করে তোলে, সেখানে ময়লার ভাগাড়েই শত শত মানুষের বেঁচে থাকা, ময়লাকে পুঁজি করেই রুটি-রুজির ব্যবস্থা।

রাজধানীতে তৃণমূলের একটি অংশ রয়েছে, যারা তাদের জীবিকার জন্য নির্ভর করে ডাস্টবিনের এসব ময়লা-আবর্জনার উপরই। ময়লা আর্বজনাই তাদের রুজির উৎস।

নগরীতে এরা পরিচিত মুখ। বাসাবাড়িতে রোজই দেখা মেলে এই কর্মীদের। এক দল বাঁশি বাজিয়ে বাসা বাড়ি থেকে ভ্যানগাড়িতে ময়লা আর্বজনা সংগ্রহ করে ডাস্টবিনে ফেলে আসে, অন্যদল ডাস্টবিন থেকে ময়লা অন্যত্র সরিয়ে নেন।

এছাড়াও ময়লা আর্বজনাতেই যাদের রুটি-রুজির উৎস তাদের মধ্যে একটি শ্রেণি ডাস্টবিনে ফেলা ময়লা-আবর্জনার মাঝে নানা পরিত্যাক্ত জিনিস সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

Dust
ময়লার ভাগাড়েই শত শত মানুষের বেঁচে থাকা, ময়লাকে পুঁজি করেই রুটি-রুজির ব্যবস্থা

রাজধানীর রামপুরায় বস্তিতে মায়ের সঙ্গে বসবাস করে ১৩ বছরের কিশোর রাকিব। ডাস্টবিন থেকে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন, জুতা সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে উপার্জন তার।

কথা হয় এই কিশোরের সঙ্গে। রাকিব জানায়, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ডাস্টবিন থেকে বোতল, পলিথিন, জুতা কুড়িয়ে বস্তায় ভর্তি করে সে। এরপর রামপুরায় ভাঙ্গারির দোকানে সেগুলো বিক্রি করা হয়।

কত টাকায় বিক্রি হয় জানতে চাইলে এই বালক বলে, প্লাস্টিকের বোতল ২০ টাকা, ভালো পলিথিন ৩০ টাকা, আর জুতা-স্যান্ডেল ১৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। প্রতিদিন গড়ে ১০০ টাকার ভাঙরি বিক্রি করতে পারে সে।

সেই টাকা দিয়ে কি করো- এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলে, ‘মা কে দিয়ে দিই, মা বাজার করে। আমার মা মানুষের বাসায় বুয়ার কাজ করে মাসে ৫ হাজার টাকা পায়। আামাদের দুজনের টাকায় সংসার চলে।’

ময়লা কুড়াতে কষ্ট হয় না- এমন বিষয় জানতে চাইলে সে জানায়, প্রথম দিকে খুব গন্ধ লাগতো, ঘেন্নায় গা ঘিন ঘিন করতো। এখন আর খারাপ লাগে না।

আর কিছু দিন কাজ করার পর টাকা জমা হলে রাকিবকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হবে বলে তাকে জানিয়েছেন তার মা।

যারা বাসা-বাড়ি থেকে টাকার বিনিময়ে ময়লা সংগ্রহ করে ডাস্টবিনে ফেলেন তার কাজ করেন মাসিক চাঁদার চুক্তিতে। তারা যদি এই কাজের দায়িত্ব না নিতেন তবে এ শহর আরো নোংরা হতো।

কেউ ময়লা ফেলছে, কেউ গাড়িতে তুলে দিচ্ছে– রাজধানীর পরিচিত চিত্র এটি। তীব্র গন্ধ ঠেকানোর মুখ বন্ধনী বা হাতে ময়লা না লাগার গ্লোভস তো দূরের কথা, অনেকের পায়ে একজোড়া জুতাও নেই। এভাবেই কেটে যায় দিনের পর দিন। ময়লার ভাগাড়ে ম্লান হতে থাকে জীবন স্বপ্নগুলো।

এএস/এএসএস/এনএফ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।