বড় অপরাধে রূপ নিয়েছে সাইবার ক্রাইম


প্রকাশিত: ০৩:৫৬ এএম, ২৭ মে ২০১৬
ফাইল ছবি

রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রূপা (ছদ্মনাম)। কয়েকদিন আগে এক বিকেলে একটি অজ্ঞাত নম্বর থেকে তাকে ফোন দিয়ে জানানো হয়, ‘তার বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। স্থানীয়রা রাজধানীর পুরান ঢাকার রায় সাহেব বাজারের ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য দ্রুত ২৫ হাজার টাকা লাগবে। এই নম্বরটিতে বিকাশ করতে হবে।’

বিষয়টি নিশ্চিত হতে বাবার মোবাইলে ফোন দেন রূপা। কিন্তু বন্ধ পান। পরে মা’কে বলে দ্রুত সেই নম্বরে ২৫ হাজার টাকা বিকাশ করে ছুটে যান ন্যাশনাল হাসপাতালে। গিয়ে দেখেন তার বাবার নামে কেউ সেখানে ভর্তিই হননি। পরে বাবার নম্বরে আবার ফোন দিলে তার বাবা স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেন এবং সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি ভুয়া বলে জানান।

কিছুক্ষণ আগে ফোন বন্ধ ছিল কেন? রূপার এই প্রশ্নের উত্তরে বাবা গোলাম মোহাম্মদ বলেন, ‘একজন ফোন করে বললেন বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনের কারণে কি যেন ঝামেলা হয়েছে, ৩ ঘণ্টা ফোন বন্ধ রাখতে হবে। তাই আমি ফোন বন্ধ রেখেছিলাম।’

রূপা ও গোলাম মোহাম্মদের মতো বাংলাদেশে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন। চলমান সাইবার ক্রাইমের এমন হাজারো চিত্র জাগো নিউজ-এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। নিজস্ব প্রতিবেদক আদনান রহমানের পাঁচ পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে মানুষকে হুমকি-ধামকি ও ব্ল্যাকমেইল করে প্রতিনিয়ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।  বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অপরাধে রূপ নিয়েছে এই সাইবার ক্রাইম।

খুব সহজেই এই অপরাধ করা সম্ভব। আবার অপরাধ করে সহজেই নিস্তার পাওয়াও সম্ভব। তাই এই অপরাধকেই ‘নিরাপদ পেশা’ হিসেবে বেছে নিয়েছে অপরাধীরা। এতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন।  

মোবাইল ফোন ছাড়াও দেশে যেসব ক্রাইম অহরহ হচ্ছে সেগুলো হলো- ফেইসবুকে ফেইক অ্যাকাউন্ট খুলে নগ্ন ছবি পোস্ট করা, ফেসবুকের চ্যাটে হত্যার হুমকি, মোবাইলে হুমকি, এমএমএস ভিডিও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ফাঁস করে দেয়া।

এছাড়াও কোনো ওয়েবসাইটের তথ্য চুরি করা, কন্টেন্ট এডিট করা, দেশীয় সাইট ডিফেস দেয়া, ক্রেডিট কার্ড চুরি, অনলাইনে প্রতারণার মতো ঘটনা দেশে নিয়মিত ঘটছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান জাগো নিউজকে বলেন, সাইবার অপরাধের মধ্যে মোবাইল ফোন, ফেসবুক ও ই-মেইলে হুমকির ঘটনা এখন সবচেয়ে বেশি ঘটছে। মানুষের ল্যাপটপের ডাটা মুছে দেয়ার ঘটনাও কম না।’

‘এছাড়াও হ্যাকিং, পর্ণগ্রাফি ও ফেসবুক-স্কাইপে মিথ্যা সংবাদ বা গুজব ছড়িয়ে দিয়ে সাইবার ক্রাইম করা হচ্ছে।’

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অজয় রায়, গণজাগরণ মঞ্চের (একাংশ) মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারসহ বাংলাদেশি ব্লগারদের বিভিন্ন দেশের ফোন নম্বর ব্যবহার করে মোবাইলে হুমকি দেয়ার ঘটনা শোনা গেছে।

এবছরের ফেব্রুয়ারিতে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮৮ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে স্থানান্তর করে তোলা হয়েছে। এটিও বাংলাদেশের সাইবার ক্রাইমের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা।

খবর রটেছে সোনালী, ট্রাস্ট, সিটি ও ডাচ-বাংলা ব্যাংকের তথ্য চুরির। দেশের বড় বড় ব্যাংকগুলো এখনো সাইবার ক্রাইমের ঝুঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) দেশের ২৫টি সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে একটি জরিপ করেছে।

জরিপে দেখা গেছে, ৫২ শতাংশ ব্যাংক বর্তমানে তথ্য নিরাপত্তার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। অর্থাৎ সাইবার আক্রমণের মতো অতর্কিত হামলার মাধ্যমে ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কেউ যদি চুরি করার চেষ্টা করে, তা ঠেকাতে দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংকের সক্ষমতা কম।

বিআইবিএমের গবেষণায় বলা হয়েছে, সাইবার হামলার শিকার হলে বা কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার বিকল হয়ে পড়লে বেশির ভাগ ব্যাংকের এ ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। সাইবার হামলা ঠেকাতে বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য আদান-প্রদান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের কোনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা না থাকা এই সমস্যার মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

এদিকে, সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে বাংলাদেশে স্পেসালাইজড কোনো বাহিনী না থাকলেও সিআইডি এই কাজটি সম্পন্ন করে।

এছাড়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ ও অপরাধী শনাক্তে কয়েকজন কাজ করছেন।

কীভাবে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ করা যাবে জানতে চাইলে সিআইডির সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ রায়হান উদ্দিন খান জাগো নিউজকে বলেন, অনেক সময় সামান্য অসতেনতার কারণে অপরাধীরা সাইবার ক্রাইমের  সুযোগ পাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি নিজেদের সচেতন হতে হবে। ফেসবুক, ইন্টারনেট, জি-মেইল ব্যবহারের আগে এগুলোর সিকিউরিটির বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে।

সাইবার অপরাধ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে দেশে www.facebook.com/groups নামে একটি সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম (সিসিএ-ফোরাম) রয়েছে। এই অপরাধের শিকার হওয়া অনেককে পরামর্শ ও সাহায্য করে ফোরামটি।

স্বেচ্ছাসেবী এই ফোরামের প্রধান সমন্বয়ক কাজি মুস্তাফিজ জাগো নিউজকে বলেন, সাইবার সিকিউরিটির খুটিনাটি বিষয়গুলো মানুষকে শেখানোর মাধ্যমে সচেতনতা তৈরির কাজ করা হচ্ছে।  সাইবার অপরাধ সব সময়ই থাকবে, এটি বন্ধ হবে না। তবে অনলাইন ইউজাররা সাইবার সিকিউরিটি সম্পর্কে শতভাগ সচেতন হলেই সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

বর্তমানে সচেতনতা তৈরির কাজটি অনলাইনে (ফেসবুক ও নিজস্ব ওয়েবসাইটে) করা হলেও শিগগিরই বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যলয়ে প্রোগ্রাম করা হবে বলে জানান প্রধান সমন্বয়ক।

এআর/একে/এএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।