সরকারি ব্যাংক ‘গ্রাহকবান্ধব নয়’ অভিযোগ আর নেই
মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। ১৯৮৪ সালে ব্যাংকটির সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৮ সালে পদোন্নতি পান মহাব্যবস্থাপক হিসেবে। পরে ডিএমডি হন। এরপর আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পান শামস-উল ইসলাম। ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট তিনি যোগ দেন অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ও সিইও হিসেবে।
শামস-উল ইসলাম জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন বৈশ্বিক বাণিজ্যে স্থবিরতা নামানো করোনাভাইরাস, এতে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্ব-অর্থনীতি, চলমান নানা সংকট, উত্তরণের উপায় এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম।
জাগো নিউজ: করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি। চলমান এ সংকটে অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাংক খাতের কী অবস্থা?
শামস-উল ইসলাম : করোনাভাইরাস যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে এই অবস্থায় আমরা কোনোদিন পড়িনি। এটা নতুন একটা পরিস্থিতি। কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই আমাদের এ মহামারি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। অনেক নতুন অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। প্রথম ধাক্কাটা আমরা কাটিয়ে উঠেছি।
প্রথম অবস্থায় অনেকে অফিসে আসতে চাইতেন না। যার কারণে ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রমে সমস্যা হয়েছিল। এখন ওই অবস্থা নেই। কর্মকর্তারা আসছেন, স্বাভাবিক কাজকর্ম চলছে। এটা সম্ভব হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে পরামর্শ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনার ফলে।
জাগো নিউজ : এক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থা কী?
শামস-উল ইসলাম : আমরা প্রাথমিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছি। আমাদের প্রায় ১৩ হাজার কর্মী। তাদের সবসময় দিক-নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে গ্রাহকের শতভাগ সেবা নিশ্চিত করা যায়, সার্বক্ষণিক সেই পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এজন্য আমরা ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে জোর দিচ্ছি। কীভাবে ব্যাংকের শাখায় না এসেও গ্রাহকরা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত সেবা পেতে পারেন, এ বিষয়টিতে আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
করোনাভাইরাস আমাদের ক্ষতি করেছে। ব্যাংকের তিনজনকে হারিয়েছি আমরা। এ ক্ষতি থেকে আমরা অনেক শিক্ষা নিয়েছি; যা আমাদের আগামীর পথচলার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। আগামীতে আমরা গ্রাহকের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছাতে পারব, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
জাগো নিউজ : চলমান পরিস্থিতিতে গ্রাহকের প্রত্যাশা সম্পর্কে যদি বলতেন…
শামস-উল ইসলাম : মহামারি-পরবর্তী গ্রাহকের নতুন নতুন অনেক ধরনের চাহিদা সৃষ্টি হবে। তারা ঘরে বসে ব্যাংকিং সেবা চাইবেন। এখন সীমিত সময়ে লেনদেন হলেও এটা আরও বেশি সময় ধরে চালানোর একটা চাহিদা সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ গ্রাহক চাইবেন ২৪ ঘণ্টা লেনদেন করতে। এসব বিষয় মাথায় নিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করছি। আমাদের সব শাখাকে ডিজিটালাইজড করার পরিকল্পনা করছি। আমাদের সফটওয়্যারগুলোও আপডেট করা হচ্ছে।
এক সময় যে ব্যাংকের যত বেশি শাখা থাকত ওই ব্যাংককে তত বড় মনে করা হতো। এ ধরনের মনোভাব থেকে এখন সবাই সরে আসছে। এখন কম শাখায় বেশি সেবার পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং ও ডিজিটাল ওয়ালেটে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। ডিজিটাল ওয়ালেটে সহজে যত বেশি সেবা ও সুবিধা দেয়া যাবে গ্রাহক তত সন্তুষ্ট হবেন। তাই এখন শাখা বাড়ানোর চেয়ে আমরা ডিজিটাল সেবায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
জাগো নিউজ : ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের জন্য অগ্রণী ব্যাংক নতুন কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি?
শামস-উল ইসলাম : আমরা বিকাশের সঙ্গে একটি সমঝোতা করছি। ইতোমধ্যে যেসব ব্যাংক বিকাশের সঙ্গে ব্যবসা করেছে, সেটা হলো ওয়ান ওয়ে। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে শুধু বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো যায়। আমরা একটি ইউনিক সিস্টেম নিয়ে আসছি, সেটা হলো ব্যাংক থেকে বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা যাবে; আবার বিকাশ থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা আসবে। দেশে প্রথমবারের মতো এই সেবা চালু হচ্ছে। এছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখতে অগ্রণী ব্যাংকের সিঙ্গাপুরের একচেঞ্জ অফিস একটি অ্যাপ তৈরি করেছে। সিঙ্গাপুরের প্রবাসীরা ব্যাংকে না এসে এই অ্যাপের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন। এ ধরনের গ্রাহকবান্ধব সেবা আমরা চালু করছি। ডিজিটাল সেবায় বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
জাগো নিউজ : চলমান পরিস্থিতিতে অনেক ব্যাংকের আমানত কমে গেছে। গ্রাহকের প্রত্যাশা অনুযায়ী ঋণ দেয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ব্যাংকের অবস্থা কী?
শামস-উল ইসলাম : অগ্রণী ব্যাংকের আমানতের বড় একটা অংশ সরকারি সঞ্চয়। জুন ক্লোজিংয়ের কারণে প্রায় তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা দিতে হয়েছে। এতে কিছুটা আমানত কমেছে। তবে আমাদের গ্রামগঞ্জে অনেক শাখা রয়েছে। সারাদেশে আমাদের ৯৫৮টি শাখা রয়েছে। ২০০ এজেন্ট ব্যাংকিং, নয়টা ইসলামিক ইউনিট আছে। এসব শাখায় সঞ্চয় এসেছে যার কারণে মোট আমানত কমেনি। আমরা আশা করছি, আগামীতে ডিপোজিট আরও বাড়বে।
বর্তমানে আমাদের ডলার সংকট নেই, তারল্য সংকটও নেই। ফলে আমাদের ঋণ দিতেও সমস্যা হচ্ছে না।
জাগো নিউজ : করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে অগ্রণী ব্যাংক কী ভূমিকা পালন করছে। অনেক উদ্যোক্তার অভিযোগ, তারা এ ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা পাচ্ছেন না…
শামস-উল ইসলাম : চলমান পরিস্থিতির মধ্যেও অগ্রণী ব্যাংক সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন দেয়ার প্রণোদনা প্যাকেজ অগ্রণী ব্যাংক সবার আগে সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। এছাড়া কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের ২০ হাজার কোটি টাকা এবং শিল্প ও সেবা খাতের ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কাজ করছি আমরা।
সরকারি ব্যাংক হিসেবে আমাদের অগ্রণী ব্যাংক ১৬ কোটি মানুষের ব্যাংক। তাদের প্রত্যাশা পূরণে আমরা কাজ করছি। আশা করছি, মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারব।
চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকিং কার্যক্রম কিছুটা কমেছে। কারণ গত প্রায় তিন মাস আমরা স্বাভাবিক নিয়মে অফিস করতে পারিনি। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ ছিল, সবমিলিয়ে কাজকর্ম কিছুটা ধীরগতির ছিল। যার কারণে গ্রাহক তার প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা পাননি। তবে বাঙালি বীরের জাতি। দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সব সক্ষমতা রয়েছে। খুব শিগগিরই আমাদের রফতানি বাড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হবে, ব্যাংকিং কার্যক্রমে গতি ফিরে আসবে। গত কয়েক মাসে যে ক্ষতি হয়েছে আমরা তা অচিরেই কাটিয়ে উঠতে পারব।
জাগো নিউজ : প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে কি-না?
শামস-উল ইসলাম : প্যাকেজ বাস্তবায়নে তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমাদের নীতিনির্ধারক বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে অনেক সহযোগিতা করছে। বিভিন্ন সার্কুলারের মাধ্যমে বিষয়গুলো ক্লিয়ার করছে। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম এখনও অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ অনেক ব্যাংকার করোনায় আক্রান্ত। স্বাভাবিক নিয়মে শাখাগুলোতে অনেক কর্মকর্তা যেতে পারছেন না। আমাদের ব্যাংকও পুরনো, সিস্টেমগুলোও পুরনো। এটাই আমাদের সমস্যা। তবে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তাবায়নে আমরা বিশেষ জোর দিয়েছি। আশা করছি, এক্ষেত্রে সমস্যা হবে না।
জাগো নিউজ : ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা ও আগামীর সম্ভাবনা সম্পর্কে যদি বলতেন…
শামস-উল ইসলাম : অর্থনীতির হৃদপিণ্ড ব্যাংক খাত। ব্যাংক ঠিক থাকলেই অর্থনীতি সুস্থ থাকবে। সরকার ব্যাংকের প্রতি সহনশীল। সরকারের আস্থা ও ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা আছে বলেই বাজেটে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। করোনার মতো এত বড় মহামারির মধ্যেও ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট নেই। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশই এখন সংকটে রয়েছে।
আমাদের রেমিট্যান্স পাঠানো অব্যাহত রয়েছে। রফতানি কিছুটা কমলেও আশা করছি খুব শিগগিরই এটি বেড়ে যাবে। সামনে অর্থনীতির বড় সম্ভাবনা রয়েছে, যা কাজে লাগাতে হলে নতুন নতুন সেবাপণ্য আনতে হবে, পাশাপাশি আধুনিক ও ডিজিটালাইজড ব্যাংকিংয়ে আমাদের জোর দিতে হবে।
অভিযোগ ছিল, সরকারি ব্যাংকে গ্রাহকবান্ধব সেবা দেয়া হয় না— এটা একসময় প্রচলিত থাকলেও এখন নেই। আমাদের অগ্রণী ব্যাংক প্রচলিত এই ধারণা পাল্টে দিয়েছে। আমাদের এখানে এখন সাধারণ গ্রাহক থেকে শুরু করে কর্পোরেটপর্যায়ের গ্রাহকরাও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন। দেশের বড় বড় গ্রুপ আমাদের সেবা নিচ্ছে। দেশের স্বনামধন্য শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, পিএইচপি, বিএসআরএমের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আমাদের সেবা নিচ্ছে। তারা সন্তোষও প্রকাশ করছে।
এসআই/এইচএ/এমএআর/জেআইএম