চীনের উদাহরণ দিলেও আওয়ামী লীগ হাঁটছে অন্য পথে
অধ্যাপক এম এম আকাশ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। চেয়ারম্যান, ব্যুরো অব ইকোনমিকস রিসার্চ। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ আলোচনায় দেশের উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে নির্মোহ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বলেন, ‘উচ্চবিত্তের জাতীয় শিকড় বাংলাদেশে নেই। বিদেশে বাড়ি তাদের। তাদের সন্তানরা বাইরে পড়েন। দেশের খেটে খাওয়া মানুষই অর্থনীতির কাঠামো শক্ত রেখেছে।’
গণতন্ত্রহীন রাজনীতিতে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন এই বিশ্লেষক। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : আওয়ামী লীগ এরশাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ক্ষমতায় এসেছে বলে আগের পর্বে উল্লেখ করেছেন। দলটি তার অতীত নীতিতে না থাকলেও ভিন্ন পথে হাঁটতে চেষ্টা করেছে। অন্তত এরশাদের নীতির বাইরে শেখ হাসিনার জনকল্যাণমুখী নীতি তো কিছুটা আছেই বটে…
এম এম আকাশ : আওয়ামী লীগের নীতিতেও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ- এর প্রতিনিধিরা প্রভাব রাখছে, যা এরশাদের সময় প্রবল ছিল। আবার কখনও কখনও বঙ্গবন্ধুর ছাঁয়া ধাক্কা দিয়ে আওয়ামী লীগকে সামনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়েছে।
জাগো নিউজ : এখন আওয়ামী লীগ কোন পথে? পদ্মা সেতু ইস্যুতে কিন্তু বিশ্বব্যাংককে আওয়ামী লীগই চ্যালেঞ্জ করল?
এম এম আকাশ : শেখ হাসিনার জন্য এখন দুটি সমস্যা। সব লুটেরা এখন ধনতন্ত্র কায়েম করতে চায়। শেখ হাসিনার পক্ষেও আর সমাজতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব নয়। কারণ, সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়া, কিউবা এখন মিশ্র অর্থব্যবস্থায় গেছে। শেখ হাসিনাও এখন কোনো না কোনোভাবে মিশ্র অর্থব্যবস্থার পথে। তবে শুক্লপক্ষ নেতৃত্বে নেই।
জাগো নিউজ : সেটা কি চীনের মতো?
এম এম আকাশ : শেখ হাসিনা নিজে তেমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন। চারদিকে চীনের কথাই গুরুত্ব পাচ্ছে। ‘নয়াচীন’ নামে বঙ্গবন্ধুর যে বই প্রকাশ পেল, তা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে এবারের মেলায়। বইটি ছাত্রলীগের হাতে হাতে দেখতে পেলাম।
চীন ছিল আমাদের স্বাধীনতার শত্রু। বর্তমান চীনের সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবের কথা তাদের মিত্র ভিয়েতনামই বলছে! সেই চীনের ‘বাজার সমাজতন্ত্র’ না ‘বাজার ধনতন্ত্র’, আওয়ামী লীগ পদ্ধতি হিসেবে কোন অংশটি গ্রহণ করতে চাইবে তা ভবিষ্যৎ রাজনীতিই নির্ধারণ করবে।
জাগো নিউজ : চীনে তো একদলীয় শাসনব্যবস্থা। বাংলাদেশও কি সে পথে হাঁটবে?
এম এম আকাশ : আমার কাছে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সেদিকেই যাচ্ছে। অন্তত গত নির্বাচনে তার কিছুটা ছাপ মিলেছে। সংসদ এবং সংসদের বাইরে কোনো বিরোধিতা নেই। অন্য দলগুলোকে সংসদে আসতে দেয়া হয়নি। দেশে এখন প্রায় একদলীয় শাসনব্যবস্থাই বিরাজ করছে।
জাগো নিউজ : চীনের কমিউনিস্ট পার্টি মাও সেতুং, কার্ল মার্কস, লেনিনের সমাজতন্ত্র ধারণের কথা বলে। যদিও মিশ্র অর্থব্যবস্থা চীনেও। আওয়ামী লীগ কী ধারণ করছে?
এম এম আকাশ : প্রশ্ন এখানেই। চীনে একটি দল ক্ষমতায় থাকছে। জমি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। ‘আলি বাবা’র মতো প্রতিষ্ঠান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য— সবমিলিয়ে একটি মিশ্র জটিলতা।
চীনের নীতি হচ্ছে একবার ডানে, আরেকবার বামে। চীনের পথ হচ্ছে আঁকাবাঁকা। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এখন অনেকটাই বামপথে। যারা কমিউনিস্ট পার্টি করেন তাদের অনেক টাকা জমিয়েছে, তাদের বাদ দেয়া হচ্ছে। শি জিনপিং বলছেন, যারা কমিউনিস্ট পার্টি করবেন, তারা ব্যবসা করতে পারবেন না।
কিন্তু আওয়ামী লীগ তো এই নীতির উল্টো। যারা ব্যবসা করছেন তাদের নিয়ন্ত্রণেই আওয়ামী লীগ। তার মানে, চীনের উদাহরণ দিলেও আওয়ামী লীগ হাঁটছে অন্য পথে। আওয়ামী লীগের শুরু ছিল পেটিবুর্জোয়ার দল। শেখ মুজিব বা ওই সময়ের নেতারা মুড়ি দিয়ে সকালের নাস্তা করতেন। এখন কোনো আওয়ামী লীগের নেতা মুড়ি দিয়ে সকালের নাস্তা করেন বলে মনে হয় না। অবশ্য আমার মতো বামরাও নয়।
আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি আর ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ির মতো ছোট নয়। তাদের সন্তানরা আর ইডেন বা ঢাকা কলেজে পড়ে না। এমনকি শেখ হাসিনার ছেলে-মেয়েরাও দেশে পড়ে নাই। সুতরাং পিতার প্রতি কমিটমেন্ট রেখে শেখ হাসিনা কিছুটা চাইলেও তার শ্রেণিভিত্তিটা তাকে সমর্থন করবে না। তার পক্ষে শ্রেণিত্যাগ করাটা এখন কঠিন।
জাগো নিউজ : শ্রেণিভিত্তিক সমর্থন না করলেও শেখ হাসিনা কিন্তু জনপ্রিয় এবং জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে তিনি একটি পথ বের করতে চাইছেন হয়তো…
এম এম আকাশ : নেতারা প্রায়শই বলে থাকেন, আমাদের সমাজতন্ত্র হচ্ছে ‘চীনা সমাজতন্ত্র’। শেখ হাসিনাও হয়তো ‘বাঙালি কল্যাণমুখী ধনতন্ত্র/সমাজতন্ত্র’ রূপ দিতে চাইছেন। যদিও তিনি ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাইবেন না। শেখ হাসিনা হয়তো স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশগুলোর মতো কল্যাণমুখী অর্থব্যবস্থার কথা বলবেন। অর্থাৎ কল্যাণমুখী পুঁজিবাদ।
জাগো নিউজ : তাহলে এই পথকে ইতিবাচকভাবেই দেখা যায়?
এম এম আকাশ : অত সহজ নয়। এর পূর্ব শর্ত হচ্ছে, পুঁজিপতিদের দিয়ে উদ্বৃত্ত উৎপাদন করিয়ে সেখান থেকে রাজস্ব আদায় করে সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। এজন্য যে রাজনৈতিক দল দরকার, তা আওয়ামী লীগ নয়।
গত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ যে সরকার গঠন করেছে তার অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপিরা ব্যবসায়ী। তাদের সম্পদ বেড়েছে পাহাড়সম। সরকারে থাকা বামপন্থী নেতাদেরও সম্পদ বেড়েছে কয়েক গুণ।
অর্থাৎ যারাই ক্ষমতাসীনদের কাছাকাছি থাকতে পেরেছেন, তারা ধনশালী হয়ে উঠছেন। এটি খুব সাধারণ ব্যাপার এখন। আরেকটি সাধারণ ব্যাপার হচ্ছে, তৃণমূলের নেতারা চোঙ্গা ফুঁকিয়ে রাজনীতি করেন। তারা আর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন না। টাকা দিয়ে এখন মনোনয়নপত্র কেনা যাচ্ছে, ক্ষমতায়ও আসা যাচ্ছে।
কিন্তু ভোট সুষ্ঠু হলে এসব ব্যক্তি কোনোভাবেই জিততে পারবেন না। আবার তাদের জেতাতে না পারলে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে। শেখ হাসিনা যদি ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার ঝুঁকি নেন, তাহলে তাকে মৃত্যুর ঝুঁকিও নিতে হবে। কারণ তার সামনে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার নজির আছে। তিনি জানেন, যেদিন ক্ষমতা হারাবেন, সেদিনই তার ‘নিত্য অনুসারী বুলেট’ তাকে হত্যা করতে পারে। সুতরাং ক্ষমতা হারানো হচ্ছে শেখ হাসিনার জীবন-মরণ প্রশ্ন!
জাগো নিউজ : শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে বারবার। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা বললেন। এমন বিপদের কথা জেনে যে কেউ-ই ক্ষমতা হারাতে চাইবেন না…
এম এম আকাশ : হ্যাঁ, হারাতে চাইবেন না বলেই তাকে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে হচ্ছে। এ কারণেই ডিজিএফআই বা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে। দলের মতামতও কিছুটা নেয়া হয়।
কিন্তু প্রতিবেদন যা-ই আসুক, ক্ষমতায় ব্যবসায়ীরাই আসছেন। এই ব্যবসায়ীদের অল্পকিছু উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, বেশিরভাগই লুটেরা।
শেখ হাসিনা জানেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তার ক্ষমতায় আসা হবে না। এ কারণেই তাকে নির্বাচনে প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তাকে প্রশাসন সাজাতে হয়েছে। প্রশাসনে অপেক্ষাকৃত আওয়ামী লীগ ঘরানাদের বসানো হয়েছে।
এতে প্রশাসন ও দলে শেখ হাসিনা খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় দলের ভূমিকা প্রায় নগণ্য। আর আওয়ামী লীগের এখন কোনো মিত্র নেই, যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় সহায়তা করবে। এ কারণেই প্রশাসনের ওপর শেখ হাসিনাকে অতিনির্ভর হতে হয়েছে।
জাগো নিউজ : প্রশাসনে অতিনির্ভরতা বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
এম এম আকাশ : অতিনির্ভরতা প্রশাসনকে বিশেষ একটি ক্ষমতার জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে যাবার কথা নয়। যেখানে সিভিল প্রশাসন ও সামরিক প্রশাসন দুটোই থাকছে।
জাগো নিউজ : চীনের কথা বলছিলেন। চীনে তো এমন প্রশাসনই দেখা যায়। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে সেখানে…
এম এম আকাশ : না। চীনের বিষয়টি আলাদা। চীনের সামরিক বাহিনী কমিউনিস্ট পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করে না। কমিউনিস্ট পার্টি সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে।
বাংলাদেশে ঘটছে উল্টাটা। দেশে আওয়ামী লীগের আর সেই অর্থে দলীয় কোনো ক্ষমতা দেখছি না। একটি দলের ক্ষমতা হচ্ছে, তার রাজনৈতিক ভিত্তি। সেই ভিত্তি না থাকলে অন্য শক্তি এসে ভর করবেই। বাংলাদেশ এখন এমনই সন্ধিক্ষণে।
জাগো নিউজ : কিন্তু শক্তিমত্তার এমন প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও শেখ হাসিনা এগিয়ে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছেন, যে গল্পে সাধারণ মানুষও ভরসা রাখছে…
এম এম আকাশ : আলোচনার শুরুতে যে চারটি ইতিবাচক ফ্যাক্টরের কথা বলেছি, সেখানে যদি শেখ হাসিনা আরেকটু সফল হতে পারেন, তাহলে নেতিবাচক ফ্যাক্টরগুলো আড়ালে চলে যাবে। এটি হলে শেখ হাসিনা কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষের বর্ডারে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন দীর্ঘকাল। এটি আমার একটি হাইপোথিসিস (অনুমাননির্ভর উচ্চতর ধারণা)।
জাগো নিউজ : আর বর্ডার ক্রস করলে…
এম এম আকাশ : আরেকটি হাইপোথিসিস হচ্ছে, এইভাবে বেশিদিন চলবে না। কৃষ্ণপক্ষ তার কাছে আরও চাইবে। তখন আর ভারসাম্য অবস্থা থাকবে না। সব গ্রাস করে নেবে। যদি না প্রশাসনে বা সামরিক প্রশাসনে সৎ ও যোগ্যদের জায়গা না দেয়া হয়।
জাগো নিউজ : সরকার ও দলে আনুগত্যের প্রশ্নে শেখ হাসিনা অদ্বিতীয়। ভারসাম্য রাখতেই পারেন তিনি…
এম এম আকাশ : ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শেখ হাসিনার দলের বিরুদ্ধে গেছে। ব্যাপক সাড়া পড়লেও মাঝপথে এসে অভিযান বন্ধ করে দিতে হলো। যদিও শেখ হাসিনা প্রমিজ করেছিলেন, এমন অভিযান চলবে। আমরা কিন্তু আর দেখতে পাচ্ছি না।
শেখ হাসিনার অনুসারীরা আত্মশুদ্ধির কথা বলছেন। আত্মশুদ্ধির প্রশ্ন এলে নানা জায়গায় হাত দিতে হবে এবং এজন্য শক্তি দেখাতে হবে। শক্তি দুই রকম। প্রথমত, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শক্তির প্রকাশ। বঙ্গবন্ধু যেটা করেছিলেন। চাটার দলকে বাদ দিয়ে তিনি কৃষক-শ্রমিক নিয়ে বাকশাল গঠন করতে চেয়েছিলেন। তিনি কমিউনিস্টদের সঙ্গে নিয়ে সব ঠিক করতে চেয়েছিলেন। যদিও তিনি পারেননি। তাকে হত্যা করা হলো।
শেখ হাসিনাও হয়তো জানেন, বেশি করতে গেলে পিতার মতো হতে পারে।
জাগো নিউজ : তার মানে প্রধানমন্ত্রী আপসের নীতিই অবলম্বন করছেন…
এম এম আকাশ : হ্যাঁ। তা-ই করতে হচ্ছে। কিন্তু বেশি আপস করলে কৃষ্ণপক্ষ শুক্লপক্ষকে আড়াল করে ফেলবে, আর সেটাই হবে শেখ হাসিনার ট্র্যাজেডি।
এএসএস/এমএআর/জেআইএম