ট্যাঙ্কের ওপর নাচানাচির ঘটনাই ঘটেনি
হাসানুল হক ইনু। রাজনীতির হাতেখড়ি ছাত্রজীবনে। স্বাধীনতার সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধের সংগঠক। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা উত্তর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল করেন। আন্দোলন-সংগ্রাম, কারাভোগ রাজনীতির চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন জাসদের এ সভাপতি।
আরও পড়ুন : যুদ্ধের চশমা দিয়ে আগামী নির্বাচন দেখছি
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর নবগঠিত সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান হয়নি। এ নিয়ে রাজনীতির মাঠে-ময়দানে নানা আলোচনা-সমালোচনার পর ঠাঁই হয় সংসদীয় কমিটিতে। তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয় তাকে।
সম্প্রতি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ এবং চলমান রাজনীতির নানা বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন হাসানুল হক ইনু। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি।
জাগো নিউজ : ‘জাসদ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল’- আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন মন্তব্য জোটের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে কিনা?
হাসানুল হক ইনু : কতিপয় নেতা-নেত্রী বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে তথ্য ছাড়া অবান্তর কথাবার্তা বলেন। চুলচেরা বিশ্লেষণের পরই শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও জাসদ একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় বাদী-বিবাদী কোনো পক্ষই জাসদ সম্পর্কে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। হত্যাকারী কারা, তার নেপথ্যের নায়করা কারা- সেটা সবাই জানেন। দৃশ্যমান হত্যাকারীদের আমরা দেখেছি। নেপথ্য নায়কদের বিষয়ে দেশবাসীর জানা উচিত।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সুফলভোগী কারা? সেটা যদি আপনারা তালিকাবদ্ধ করেন, সেই সুফলভোগীদের তালিকা ধরে আপনারা হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে গবেষণা করতে পারেন। এ সুফলভোগীদের তালিকায় জাসদ নেই। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর ১৭ আগস্টে জাসদ খুনি মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে মিছিল করে। খুনি মোশতাকের ৮৩ দিনের শাসনকালে জাসদের ওপরে অমানুষিক নির্যাতন চালায় সামরিক কর্তৃপক্ষ। সারা বাংলাদেশে শতাধিক নেতাকর্মী নিহত হন। ওই ৮৩ দিনে ‘জাসদ দমননীতি’ চালানো হয়। অনেকে গ্রেফতার হন। সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জাসদ দমন-পীড়নের শিকার হয়, কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করে তারা।
বঙ্গবন্ধুর বিকল্প সামরিক শাসক নয়- এ নীতি ধরে খুনি মোশতাক এবং পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান সরকারের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আমরা অবস্থান নেই। ফলে কর্নেল তাহেরসহ অনেকেই প্রাণ হারান।
আরও পড়ুন : সাংবাদিক নেতারাই বিভেদ তৈরির চেষ্টা করছেন
জাগো নিউজ : ট্যাঙ্কের ওপর উল্লাস-সংক্রান্ত একটি ছবি বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়। বলা হয়, আপনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ট্যাঙ্কের ওপর উল্লাস করেছিলেন। এ বিষয়ে মানুষ জানতে চায়…
হাসানুল হক ইনু : ফেসবুকে এটা নিয়ে একটা গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করে জামায়াতের বাঁশের কেল্লা (ফেসবুক পেজ)। এখানে প্রথম তথ্যটা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ১৫ আগস্ট সারাদিনে ঢাকা শহরে কোনো জনগণ উল্লাস করেনি। কোনো গণমাধ্যমে এ নিয়ে কোনো রিপোর্ট নেই। ১৬ আগস্টে কোনো গণমাধ্যমে এ রকম কোনো ছবি প্রকাশিত হয়নি। কোনো পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে উল্লাস এবং সারা ঢাকা শহরে সেনাবাহিনীর কোনো মুভমেন্টের খবর প্রকাশিত হয়নি। বঙ্গভবন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শাহবাগ বেতার কেন্দ্র, রামপুরা টেলিভিশন কেন্দ্র, ক্যান্টনমেন্ট আর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাইরে কোনো ট্যাঙ্কের মুভমেন্ট ছিল না।
সারা ঢাকা শহরে ভয়ে এমনকি সৈনিকরাও ভীত ছিল। তারাও কোনো মুভমেন্ট করেনি। দায়িত্বের সঙ্গে বলছি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শোনার পর জনগণ হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ আগস্ট কোনো রকম উল্লাস প্রদর্শন হয়নি। কোনো রকম আনন্দ মিছিল হয়নি এবং ট্যাঙ্কের ওপরে নাচানাচির ঘটনাও ঘটেনি।
আরও পড়ুন : তারুণ্যকে আমরা স্বপ্ন দেখাতে পারি নাই
আমি তখন আত্মগোপনে ছিলাম। কারণ মোশতাক কর্তৃপক্ষ আমাকে খুঁজছিল। আমরা ১৭ আগস্ট মিছিল করি। আমি বাহাত্তর সাল থেকে যখন জাসদের রাজনীতি শুরু করি তারপর কোনো প্যান্ট-শার্ট পরিনি। আমি সবসময় পায়জামা-পাঞ্জাবি পছন্দ করি। ওখানে প্যান্ট-শার্ট পরা লোক একটা আছে। সেখানে ছবিটাকে চিহ্নিত করে জামায়াতিরা এ মিথ্যাচার করেছে আওয়ামী লীগ-জাসদে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য।
ট্যাঙ্কের ওপর বা সামরিক ট্রাকের ওপরে জনগণের উল্লাস ৭ নভেম্বরের পর হয়েছিল। তখন ট্যাঙ্কের ওপর ওইভাবে নাচার বয়স আমার ছিল না। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেন-দরবার বা ঝগড়া-বিবাদে ব্যস্ত ছিলাম কর্নেল তাহের ও আমি। ওই যে ট্যাঙ্কের ওপরে যে ছবিটা, ৭ নভেম্বরে এ ধরনের বহু ছবি আছে। মানে মানুষের ছবি আছে, সাধারণ মানুষরা ট্যাঙ্কের ওপরে উঠে নাচানাচি করছে।
আমরা রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছি। ওই রাজনৈতিক কারণেই আমরা খন্দকার মোশতাকের অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরোধিতা করি। বঙ্গবন্ধু হত্যা-খুনের সঙ্গে জাসদ যদি জড়িত থাকে, তাহলে শেখ হাসিনা তো বুঝেশুনেই জাসদের সঙ্গে ঐক্য করেছেন। উনি কি না বুঝে জাসদের সঙ্গে ঐক্য করেছেন? জাসদ রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছে এবং রাজনৈতিক কারণেই আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য। অন্য বহু দল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছে। জাসদ কোনো রকম সমর্থন দেয়নি বরং খুনি মোশতাকের সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে।
জাগো নিউজ : একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘অনিয়ম’ নিয়ে টিআইবি ও কানাডা তাদের পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
হাসানুল হক ইনু : টিআইবির যে চয়ন পদ্ধতি, এটা কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়। অভিযোগ সুনির্দিষ্ট হতে হবে। তাদের চয়ন পদ্ধতি, গবেষণা পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নয়। সুতরাং তাকে যখন নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে হবে, তখন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে হবে। যতক্ষণ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ লিপিবদ্ধ হচ্ছে না, ততক্ষণ মুখের কথার ওপরে মন্তব্য করার অধিকার কারো নেই। টিআইবির নেই, কানাডারও নেই।
জাগো নিউজ : বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বিষয়টি কতটুকু যৌক্তিক?
হাসানুল হক ইনু : মানবাধিকার সম্পর্কে তারা এত কথা বলে অথচ বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় যে আইনগুলো আছে, সেগুলো সম্পর্কে তারা কথা বলে না। বাংলাদেশে হাজার হাজার সাংবাদিক আছেন। দুজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেটা নিয়ে সমস্ত গণমাধ্যম ধ্বংস করে দেয়ার স্টেটমেন্ট দিয়ে দিচ্ছে। আবার সেটার প্রতিকারও চাচ্ছে তারা। ইংল্যান্ডে গত চার বছর আগে শতাধিক সাংবাদিক কারাগারে ছিল। সাংবাদিক হোক, রাজনৈতিক নেতা হোক আর এমপি হোক, যদি আইন ভঙ্গ করে তাহলে কি তাকে গ্রেফতার করা যাবে না? আইন ভঙ্গের অপরাধে রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করলেই মানবাধিকার চলে গেল- এমন ঢালাও বক্তব্য দেয়া উচিত নয়।
জাগো নিউজ : বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ না নেয়ার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
হাসানুল হক ইনু : আমাদের সরকার সম্পর্কে ও নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে কিছু অভিযোগ উত্থাপনের পরও তারা আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। যে যুক্তিতে তারা নির্বাচনে অংশ নিল সেই একই যুক্তিতে তাদের নির্বাচিত এমপিরা পার্লামেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তারা যে অভিযোগটা দিচ্ছেন, সেই অভিযোগ লিপিবদ্ধ করার জন্য সংসদে আসতে পারেন।
সংসদে থাকুক বা না থাকুক তাতে মাঠের আন্দোলনে কোনো হেরফের হবে না। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তারা সংসদে অংশগ্রহণ করুক। তাদের দাবিগুলো বা অভিযোগগুলো তারা সংসদে লিপিবদ্ধ করুক।
এখন সংসদ অকার্যকর করা, তার জন্য শপথ না নেয়া অর্থাৎ একটা খুঁত তৈরি করে দাও। খুঁত তৈরি করে রাজপথে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি কর। আন্দোলনের নামে জঙ্গি-সন্ত্রাস কর, আগুন সন্ত্রাস কর। ২০০৯ সাল থেকে খালেদা জিয়া বিরোধী দলের নেতা হিসেবে কোনো ফাংশন করেননি। তাহলে উনি সংসদটাকে অকার্যকর করতে চেয়েছেন। অস্বাভাবিকভাবে সরকার বদল করে অস্বাভাবিক সরকার আন, প্রতিষ্ঠা কর...। ২০০৮ সালের ভোটে পরাজয়ের পর বিএনপি এ রাজনীতির চক্র থেকে বের হতে পারেনি। নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি বানচাল কর, অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি কর, সরকার উৎখাত কর- এ কৌশলে যারা থাকে তারা কিন্তু তথ্য দিয়ে কথা বলে না।
এইউএ/এসআর/এনডিএস/জেআইএম