ষোড়শ সংশোধনী বাতিল মুক্তিযুদ্ধের ওপর আঘাত
মাহবুবে আলম, রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল)। উচ্চ আদালতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলার আপিল, রাষ্ট্রপক্ষের প্রস্তুতি, ষোড়শ সংশোধনী, নিম্ন আদালতের আচরণবিধিসহ বিচার বিভাগের নানা বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ভূমিকা ও পদত্যাগ প্রসঙ্গেও।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন করবেন বলেও অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। তিন পর্বের দ্বিতয়ীটি থাকছে আজ।
জাগো নিউজ : ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে আপিল করবে রাষ্ট্রপক্ষ। কী চাইবেন আপিলে?
মাহবুবে আলম : আমরা ইতোমধ্যে ফাইল করেছি। শুনানিতে অংশ নেয়ার অপেক্ষায় আছি।
মামলাটি নিয়ে অনেক পরিশ্রম করেছি। এ মামলার রায় আমার কাছে দুঃখজনক মনে হয়েছে। সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদে আমরা ফিরে যেতে পারব না, এরচেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে!
জাগো নিউজ : সংবিধান রচয়িতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এমন দুই আইনজীবীও ষোড়শ সংশোধনী বাতিল চেয়ে মামলায় লড়লেন...
মাহবুবে আলম : এটি আমাকে অবাক করেছে। যারা সংবিধান রচনা করলেন, তারাই মূল সংবিধানে ফিরতে বাধা হলেন। এটি আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক ঘটনা। জাতি একদিন ওই ঘটনা নিয়ে সমালোচনা করবে। যদি আপত্তিই থাকে, তাহলে ১৯৭২ সালের সংবিধানে তারা কেন স্বাক্ষর করেছিলেন?
জাগো নিউজ : শুনানিতে অংশ নিলো রাষ্ট্রপক্ষও। আপনাদের যুক্তি কেন আমলে নেয়া হলো না?
মাহবুবে আলম : আমরা অবশ্যই আর্গুমেন্ট (যুক্তিতর্ক) করেছি। ভেরি সিরিয়াসলি (গুরুত্বসহকারে) আর্গুমেন্ট করেছি, সংবিধানের মূলে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে। এটি সংবিধান পরিবর্তনের বিষয় ছিল না। সংবিধান পরিপন্থী কিছু থাকলে রায় অন্যদিকে যেতে পারতো।
আমাদের লক্ষ্য ছিল সংবিধানের মূলে ফেরা।
জাগো নিউজ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য রায়টি ইতিবাচকভাবে দেখছিলেন আইনজীবীরাও…
মাহবুবে আলম : ১৯৭২ সালে সংবিধান রচিত হয়েছিল সবকিছু আমলে নিয়েই। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে সংবিধান রচিত হয়নি।
জাগো নিউজ : সংবিধানের মূলে ফেরার কথা বলছেন। সংবিধান সংশোধন আওয়ামী লীগও একাধিকবার করেছে। বাস্তবতার নিরিখে সংশোধন হতেই পারে।
মাহবুবে আলম : পঞ্চদশ সংশোধনীতে এমন কোনো বিষয় বলা হয়নি যে, এটি ভালো; এটি রাখতেই হবে।
জাগো নিউজ : এ সরকারই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম রেখেই পঞ্চদশ সংশোধনী করলো, যা মূল সংবিধানের পরিপন্থী।
মাহবুবে আলম : এগুলো কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার যুক্ত করেনি। এমনকি এগুলো রাখতেই হবে, এমনটিও যুক্ত করেনি।
একজন সাংবাদিকের লেখা একটি বইয়ের ওপর ভিত্তি করে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেয়া হয়েছে। অথচ দালিলিক তথ্য-উপাত্ত গুরুত্ব পায়নি। পার্লামেন্টে অনেক আলোচনা হয়। তা আমলে নেয়া হয়নি। এটিই অবাক করেছে।
জাগো নিউজ : এ রায় বহু প্রশ্নের জন্ম দিল, এটি তো অস্বীকারের উপায় নেই...
মাহবুবে আলম : রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে আমাদের সংবিধান রচনা হয়েছে। এটি ভুললে চলবে না। অনেক প্রশ্নই জন্ম দিতে পারে। কিন্তু আমাদের মূল কী, সেটার প্রতি আগে গুরুত্ব দিতে হবে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল মুক্তিযুদ্ধের ওপর আঘাত।
জাগো নিউজ : ষোড়শ সংশোধনীর রায় দিয়ে বিতর্কিত হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও আনা হলো। এ অভিযোগ নিয়ে কী বলবেন?
মাহবুবে আলম : এটি সরকারের পলিসি। কতগুলো সিদ্ধান্ত দিয়ে বিচার বিভাগের খুবই ক্ষতি করেছেন এস কে সিনহা। বিশেষ করে ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে চরম বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তিনি।
জাগো নিউজ : এস কে সিনহা এ রায় নিয়ে প্রশংসাও কুড়িয়েছেন বেশ।
মাহবুবে আলম : যারা প্রশংসা করেছেন, তারা না বুঝেই করেছেন। বুঝতে হবে রায়টি মুক্তিযুদ্ধের পরিপন্থী।
জাগো নিউজ : তাহলে কেন এমন রায়? নেপথ্যের কোনো কারণ?
মাহবুবে আলম : এ নিয়ে আমার কোনো পর্যবেক্ষণ নেই। উচ্চ আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা আপিল করেছি।
জাগো নিউজ : আওয়ামী লীগ সরকারই এস কে সিনহাকে নিয়োগ দিয়েছিল। তার কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রথমে সরকারও প্রশংসা করেছিল।
মাহবুবে আলম : প্রশংসিত হতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এত কথা, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠবে কেন?
জাগো নিউজ : এস কে সিনহার বিদেশ যাওয়া, পদত্যাগ নিয়ে যত আলোচনা হলো সরকারের মধ্যে, এখন কিন্তু তার দুর্নীতি নিয়ে হচ্ছে না…
মাহবুবে আলম : এস কে সিনহার একার বিরুদ্ধে নয়, একাধিক বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতির মামলা এস কে সিনহা নিজে বসে ডিসমিস করে দিয়েছেন। বিষয়টির তদন্ত, সুরাহা করতে তো সময় লাগবে।
জাগো নিউজ : প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ! তাহলে সাধারণের দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়?
মাহবুবে আলম : দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা একজন বিচারপতির জন্য সবচেয়ে দুঃখের বলে মনে করি। তার জীবনের সবচেয়ে ব্যর্থতা হচ্ছে অন্য বিচারপতিরা তার সঙ্গে বসতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। এটি একজন বিচারকের জন্য আত্মহত্যার শামিল বলে মনে করি।
জনগণ না বুঝে বিরূপ মন্তব্য করছেন। তিনি বিচারকের আসনে বসতে পারেননি এ কারণে যে, অন্য বিচারকরা তার সঙ্গে বসতে চাননি।
জাগো নিউজ : অন্য বিচারপতিদের অনাস্থার বিষয়টি তো এস কে সিনহার পদত্যাগের পরে আসলো?
মাহবুবে আলম : বিচারকরা আগেই এস কে সিনহার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে আসছিলেন। পদত্যাগের আগেই বিচারকরা তার সঙ্গে বসতে অনীহা প্রকাশ করেন।
জাগো নিউজ : তাহলে জনগণের আস্থার প্রশ্নে কী বলবেন?
মাহবুবে আলম : এস কে সিনহার ঘটনায় বিচার বিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বেড়েছে। প্রধান বিচারপতির প্রতি অন্য বিচারপতিরা অনীহা প্রকাশ করেছেন, এটি একটি সাহসী ঘটনা। এ ঘটনা রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষা বটে। শিক্ষা সুপ্রিম কোর্টের জন্যও।
একটি প্রতিষ্ঠান যে একক ব্যক্তির নয়, তা এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং এটিই হচ্ছে বিচার বিভাগের মাহাত্ম্য।
জাগো নিউজ : এস কে সিনহার দুর্নীতির বিচার নিয়ে আপনার নিজের পর্যবেক্ষণ কী?
মাহবুবে আলম : প্রধান বিচারপতির দুর্নীতির বিষয়ে জনগণ কী ভাবছে, এতে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা কমবে কি-না, তা বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে।
জাগো নিউজ : নিম্ন আদালতের আচরণবিধি প্রণয়নে আইন মন্ত্রণালয়কেও রাখা হলো। এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অন্তরায় বলে মনে করছেন অনেকে। আপনার অভিমত কী?
মাহবুবে আলম : এ অভিযোগ ঠিক নয়। বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা আমাকে দিয়ে পুরো নীতিমালাটি পড়িয়েছেন। সেখানে বলা আছে, সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তাহলে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে।
জাগো নিউজ : আইন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবমুক্ত রাখার জন্যই আচরণবিধির আবেদন ছিল। মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ত থাকা মানে তো পূর্বের ন্যায়...
মাহবুবে আলম : আইন মন্ত্রণালয়ের কাজটি কী? এতটুকু দায়িত্ব না থাকলে তো আইন মন্ত্রণালয়কে তুলেই দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রেও তো আইন মন্ত্রণালয়কে রাখা হয়েছে এসব কাজে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এমনটিই হয়ে আসছে।
জাগো নিউজ : যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনৈতিক বাস্তবতার তুলনা হয়?
মাহবুবে আলম : তাই বলে তো আপনি নিম্ন আদালতের বিষয়টি ফ্রি করে দিতে পারেন না। কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতেই হবে।
জাগো নিউজ : নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকের সময় নিম্ন আদালতের আচরণবিধি সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত রাখার কথা ছিল...
মাহবুবে আলম : সুপ্রিম কোর্ট তো প্রশাসনিক কাজ করতে পারবে না। সাচিবিক অনেক কিছুই তো আইন মন্ত্রণালয়কে করতে হয়। ট্রেনিং, ছুটি, বদলি, পদোন্নতির ব্যাপার আছে।
জাগো নিউজ : নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়োগের মতো বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট দেখছে এখন। অন্য বিষয়গুলোতে দায়িত্ব পালন করতেই পারে?
মাহবুবে আলম : সব সুপ্রিম কোর্ট করলে আইন মন্ত্রণালয় কী করবে? আর এখানেই এস কে সিনহার বড় ভুল বলে মনে করি।
সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ মতো রাষ্ট্রপতি নিম্ন আদালতের বিচারকদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা তো সংবিধান দিয়েছে। এস কে সিনহা সে ক্ষমতাও কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন। এটি তো হতে পারে না।
এএসএস/এমএআর/আরআইপি