মায়ের মৃত্যুতে শিশুর অনুভূতি জানতে চাওয়া

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৬:৪২ পিএম, ০৫ জুন ২০২৪

৪ জুন ভোর ৬টায় অভিনেত্রী সীমানাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। এ খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে শোবিজ অঙ্গনে। সীমানার মরদেহ চ্যানেল আইতে নিয়ে এলে সেখানে তৈরি হয় শোকাবহ পরিবেশ। দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা অভিনেত্রীকে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সে সময় অভিনেত্রীর দুই ছেলে শ্রেষ্ঠ ও স্বর্গ সেখানে অবস্থান করে।

চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে শোকাহত স্বজনদের মাঝেও দিব্যি ছোটাছুটি করে, খেলাধুলা করে মা-হারা দুই ভাই। তাদের মা যে আর পৃথিবীতে নেই, সেটি তখনো বুঝে উঠতে পারেনি দুই অবুঝ শিশু। মায়ের ছবির পাশে দাঁড়িয়ে দুষ্টুমিতে মেতে ছিল ওরা। বাচ্চা দুটি এখনো বোঝেনি, বোঝার কথাও নয়, তাদের মা আর ফিরবে না। সদ্য মা-হারা দুই বাচ্চাকে দেখে অনেকেই হয়ে উঠেছিলেন অশ্রুসজল।

মায়ের মৃত্যুতে শিশুর অনুভূতি জানতে চাওয়া

এ পর্যন্ত হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিয়েছে অন্যত্র। যখন বড় ছেলে শ্রেষ্ঠকে ক্যামেরা এবং বুমের সামনে দাঁড় করিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। ছেলেটি সাবলীল ভাবে মায়ের অসুস্থতা ও মৃত্যু সম্পর্কে সব বলে যাচ্ছিল। এমনই ভিডিও যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে; তখন নিন্দার ঝড় ওঠে। সবাই গণমাধ্যমকর্মীদের কাণ্ড-জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

লেখক ও সাংবাদিক রনি রেজা তার টাইমলাইনে লিখেছেন, ‘সম্পাদকহীন বা ভুঁইফোড় কোনো মিডিয়া নয়, প্রতিষ্ঠিত চ্যানেলগুলোই এমন সাংবাদিকতা করলো। মা মরা বাচ্চা ছেলেটার কাছে তার অনুভূতি জানতে চাইলো। এটা কোনোভাবেই সাংবাদিকতার নীতির সঙ্গে যায় না। এমনটি কেন হলো? কারণ ১২ হাজার টাকা বেতনের কর্মী চায় মিডিয়াগুলো। কিছু তরুণ তো স্ক্রিনে চেহারা দেখানোর জন্য বিনা টাকায়ও কাজ করতে রাজি। আর আপনারাও সেই সুযোগ লুফে নিয়ে সাংবাদিকতাটাকে এই পর্যায়ে নামালেন।’

মায়ের মৃত্যুতে শিশুর অনুভূতি জানতে চাওয়া

তিনি আরও লিখেছেন, ‘বারো-পনেরো হাজার টাকায় অদক্ষ ছেলেটা বুম হাতে ভিউয়ের নেশায় এমন কাজ করেছে বুঝলাম। নিউজরুমে যারা বেশি বেতনের পদধারীরা আছেন, তারা কিভাবে এটি অনএয়ার করালেন? এরও কারণ আছে। কয়েক বছর ধরে মিডিয়াগুলোতে আরেকটা কু-ট্রেন্ড চরমভাবে চর্চিত হচ্ছে। বেশি বেতনের অভিজ্ঞদের বাদ দিয়ে ওই টাকায় একাধিক অ্যামেচার নিয়োগে ঝুঁকছে মিডিয়াগুলো। ফলে এখন বেতন বেড়ে গেলে আনন্দিত হওয়ার চেয়ে আতঙ্কিত হতে দেখি অনেককে। তো এভাবে চলছে যখন, কী আর আশা করা যায়! একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে লজ্জিত হওয়া ছাড়া তো কিছু করার নেই।’

কথাশিল্পী ফারহানা আহমেদ লিখেছেন, ‘শ্রেষ্ঠ, অভিনেত্রী সীমানার বড় ছেলে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জন্য সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে গত ২৯ মে থেকে ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন অভিনেত্রী সীমানা। গত ৪ জুন সেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। শ্রেষ্ঠ (৭) ও স্বর্গ (৩) নামে দুটি পুত্রসন্তান রেখে যান। ছবিতে সীমানার বড় ছেলে। তার মায়ের মৃত্যুর পর তাকে আমাদের বিশিষ্ট সাংবাদিক সম্প্রদায় জেঁকে ধরেছে তার অনুভূতি জানার জন্য।
* তোমার কেমন লাগছে? এই প্রশ্নটি যিনি এই সদ্য মা-হারা ছেলেকে করেছেন তার মধ্যে মনুষ্যত্বের আর কিছু অবশিষ্ট আছে বলে আমি মনে করি না।
* ছেলেটি তবু গুছিয়ে বলে চলেছে। তার মাকে সে কতটা ভালোবাসে। মায়ের স্বপ্ন, মায়ের প্রতি তার প্রগাঢ় অনুভূতি। হতভম্ব অবস্থা।’

মায়ের মৃত্যুতে শিশুর অনুভূতি জানতে চাওয়া

আরও পড়ুন

তিনি আরও লেখেন, ‘একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করবো। যুদ্ধের সময়ে এক গ্রামে অনেক লোক মরেছে। কেউ একজন ওই গ্রামের এক লোককে জিজ্ঞেস করেছিল, কতজন মানুষ মারা গেছে? লোকটা খানিক ভেবে বলেছিল, মানুষ মারা গেছে কয়েকশ। আর মিলিটারি মরেছে ১০ জন। এই সাক্ষাৎকারের পর আমার মনে থাকবে। সাংবাদিকদের মৃত্যু আমরা আলাদা করে গণনা করবো। ছিহ! লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে আসে। এই ধরনের সাংবাদিকতা করার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। সাংবাদিকদের প্রতি যে সম্মান ছিল হৃদয়ে, আজকের পর আর থাকলো না।

বি. দ্র. অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সবাই কি এক! যদি তা-ই হয়, তাহলে সাংবাদিকদের উচিত একজোট হয়ে এই অমানবিক কাজের বিরুদ্ধে কথা বলা। আমি খুবই সাধারণ মানুষ। তবু এই আচরণের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ জানালাম।’

মায়ের মৃত্যুতে শিশুর অনুভূতি জানতে চাওয়া

সাংবাদিক জেসমিন পাপড়ি লিখেছেন, ‘মৃত্যু ভাবনা সব সময় আমাকে তাড়া করে। কিছুদিন যাবত আবার শরীরটা খুব খারাপ। এ সময়ে পরীদের নিয়ে দুশ্চিন্তাও বেড়েছে স্বাভাবিকভাবে। এর মধ্যে আজ খুব সকালে ঘুম ভাঙার পরে অভিনেত্রী সীমানার মৃত্যু সংবাদ পড়ে মনটা খুব ভারি হলো। তার ভক্ত আমি নই। তবু কাছাকাছি বয়সের এই মানুষটা দুটো অবুঝ শিশু রেখে অকালে চলে গেলেন! হঠাৎ অসুস্থতা থেকে মাত্র ১৪ দিনের মাথায় একেবারে থেমে যাওয়া! এমন মৃত্যু যেন শত্রুরও না হয়- দোয়া করি। একটু আগে দেখলাম সদ্য মা-হারা শিশুর সামনে অসংখ্য ক্যামেরা... যেন ওদের শোক করার অধিকারও নেই। ...তবে স্বস্তি পাচ্ছি এটুকু ভেবে যে, আমি অন্তত সেলিব্রেটি নই। প্রয়াত সীমানার শিশু সন্তানের ছবিটা যোগ করলাম। দেখুন সাংবাদিকতা সরি ভিউয়ের জন্য কী টর্চার বাচ্চাকে করা হচ্ছে! লজ্জায় মরে যাই!’

সাংবাদিক শাহ জামাল শিশির লিখেছেন, ‘আমিও অল্প বয়সে বাবা হারিয়েছি, তবে এত কম বয়সে না। মিডিয়ার কল্যাণে অভিনেত্রী সীমানার এই সাত বছরের বাচ্চার সাক্ষাৎকার দেখলাম। অবলীলায় মায়ের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করছে। এই ছেলে একদিন বড় হবে, এই ভিডিও দেখবে আর সারাজীবন কাঁদবে। বড় বড় হাউজে যারা চাকরি করেন, তাদের তো এটুকু কমনসেন্স থাকা উচিত। ভাইরালের নেশায় আমরা আসলে মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে ফেলছি। কার সামনে কোন পরিস্থিতিতে বুম রাখা উচিত; সেই হিতাহিত জ্ঞান আমাদের লোপ পেয়েছে। ভালো থেকো ‘শ্রেষ্ঠ’।’

এমএ সাহেদ নামের একজন লিখেছেন, ‘ছেলেটা বড়দের মানসিক শক্তিকে মোটিভেট করবে। এই বয়সে যেভাবে মিডিয়া ম্যানেজ করছে, জীবনে অনেক বড় হবে, দোয়া রইল।’

এমন ঘটনার জন্য গণমাধ্যমকর্মীরাই বেশি লজ্জিত হয়েছেন। ফলে তারা প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলেছেন, আমরা আশা করবো, গণমাধ্যমকর্মীদের আর এমন পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হবে না। আরও বেশি মানবিক হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন তারা।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।