বছরজুড়ে মশা মারলেও কমেনি উপদ্রব, নিরুপায় দুই সিটি
রাজধানী ঢাকায় হাজারও সমস্যা। শেষ নেই জনদুর্ভোগের। তবে সব ছাড়িয়ে সামনে আসে ‘মশার উৎপাত’। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বাড়ছে। আবার কিউলেক্স মশার উৎপাতেও অতিষ্ঠ নগরবাসীকে এ মশার উৎপাত থেকে মুক্তি দিতে কাজ করে দুই সিটি করপোরেশন। তবে নানা উদ্যোগ নিয়েও মশার উপদ্রব কমাতে পারছে না সংস্থা দুটি। বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ দিয়ে দুই সিটি ‘মশা মারতে কামান দাগলেও’ তা কাজে আসছে না। এক কথায় মশার কাছে যেন নিরুপায় সিটি করপোরেশন।
চলতি বছর এডিস মশার উৎপাত বেড়েছে। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভোগাচ্ছে নগরবাসীকে। অন্যান্য বছর শীত এলে এডিস মশার উৎপাত কমে যায়। ডেঙ্গুর সংক্রমণও কমে যায়। তবে এবার ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়েও প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। মৃত্যুর খবরও জানাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৬১ হাজার ২৬৩ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৩৮ হাজার ৬২২ এবং ঢাকার বাইরের ২২ হাজার ৬৪১ জন। ডেঙ্গুতে এ বছর ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মারা গেছেন ২৭১ জন, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে মৃত্যুর হিসাবে রেকর্ড।
এদিকে, নভেম্বরের শেষ দিক থেকে ঢাকায় এডিস মশার প্রকোপ কিছুটা কমতে শুরু করেছে। হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীও কমেছে। তবে এখনো তা নির্মূল হয়নি। এরইমধ্যে আবার শুরু হয়েছে কিউলেক্স মশার উপদ্রব। ফলে বছরজুড়ে মশার পেছনে ছুটছে দুই সিটি করপোরেশন।
ঢাকায় মশা নিধনে কাজ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে এ কাজের ফলাফল নিয়ে ব্যাপক অসন্তুষ্টি নাগরিকদের।
নগরবাসীর অভিযোগ, ঢাকা দুই মেয়র মশা নিধনে ব্যর্থ। মশা নিধনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীও ঠিকমতো ওষুধ ছিটান না। মশার ওষুধের গুণগত মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। তারপরও এডিস মশা বাসা-বাড়ির আঙিনায় জন্মায়- এমন কথা বলে দায় এড়িয়ে গেছে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি। অথচ ডেঙ্গুজ্বরে আড়াইশোর বেশি মানুষ মারা গেছে। কিউলেক্স মশাও তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না।
ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নাগরিকদের যেসব জরুরি সেবা দেওয়া হয়, তার মধ্যে মশক নিধন অন্যতম। এ সেবাটি সারা বছরই রুটিন দেওয়া হয়। তবে কিউলেক্স মশার চেয়ে এডিস মশা নিয়ে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। এখন কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণেও বিভিন্ন কর্মসূচি চলছে।
তবে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশন কতটা সফল হবে, তা নিয়ে শুরুতেই উঠছে নানান প্রশ্ন। কারণ ডেঙ্গু নিয়ে নগরবাসীর অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন
এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে বছরজুড়ে বিভিন্ন কাজ হাতে নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় বরাবরই সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে এ সংস্থাকে। এখন কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সংস্থাটি।
গত ৪ ডিসেম্বর নগর ভবনে শুষ্ক মৌসুমে মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে ডিএনসিসি। সভায় ডিএনসিসির আওতাধীন এলাকায় মশার বর্তমান পরিস্থিতি এবং মশা নিধনে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়। পরে ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৫ দিনের জন্য ১, ১৭, ৪৯, ৫০ ও ৫২ নম্বর ওয়ার্ডে মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সব বিভাগের সমন্বিত ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ পরিচালনা শুরু করে ডিএনসিসি।
উত্তরা ৭ নম্বর রোডের বাসিন্দা মহসিন আলম। তিনি বলেন, ‘এডিশ মশার উপদ্রব এখনো শেষ হয়নি। এর মধ্যে দিন-রাত সবসময় কিউলেক্স মশা কামড়ায়। সারাদিনই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হয়।’
ডিএসসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন ডিএনসিসির এ পাঁচটি ওয়ার্ডে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেশি। এর মধ্যে বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী খাল, জলাশয় ও ডোবায়ই সবচেয়ে বেশি মশার লার্ভা ছিল। দেখে মনে হয়েছে, সেখানে মশার চাষ হচ্ছে। এসব জলাশয়, ডোবা পরিষ্কার রাখতে সিভিল অ্যাভিয়েশন, রাজউক, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে বলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মশা নিধন সিটি করপোরেশনের অন্যতম প্রধান কাজ। তবে করপোরেশনের একার পক্ষে এটি সম্ভব নয়। এজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। সেবা সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। যদিও আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিভিল অ্যাভিয়েশন, রাজউক, রেলওয়ে, পানি উন্নয়ন বোর্ড নিজ নিজ জলাশয়, ডোবা নিজেরা পরিষ্কার করবে বলে জানিয়েছে।’
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘মশা নিধনে সারা বছরই তারা কাজ করছেন। এখন ওই পাঁচটি ওয়ার্ডের পর নগরের অন্যান্য ওয়ার্ডে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’চালানো হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
উত্তর সিটির মতো দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও সারাবছর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোসহ জনসচেতনা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এখন এডিস মশার পাশাপাশি কিউলেক্সেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এডিস মশা জন্মায়। কিন্তু কয়েকবছর ধরে জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের কারণে সারাবছরই এডিস মশা জন্মাচ্ছে। এ মশা নিয়ন্ত্রণে ডিএসসিসিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ নগরের যে আয়তন ও ভবন, সে অনুযায়ী ডিএসসিসির জনবল নেই। প্রতিদিনই মশার লার্ভা জন্মানোর মতো নতুন নতুন জায়গা তৈরি হচ্ছে। তবে ডিএসসিসি তার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ডিএসসিসির মধ্যে জুরাইন, শ্যামপুর, কদমতলী, ডেমরা, নাসিরাবাদ এলাকায় সবচেয়ে বেশি কিউলেক্স মশার উপদ্রব রয়েছে। নাসিরাবাদের বাসিন্দা খালেদ সরকার বলেন, সারাবছরই মশার আতঙ্কে থাকতে হয়। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে মশার উপদ্রব সবচেয়ে বেশি। অথচ এ এলাকায় সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মীকে মশার ওষুধই ছিটাতে দেখা যায় না।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিসেম্বর, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বাড়ে। এ মশা নিধনে নগরের সব ডোবা, নালা, খাল পরিষ্কার করা হয়েছে। সকাল-বিকেল মশার ওষুধ ছিটাচ্ছেন মশক নিধনে নিয়োজিত কর্মীরা।’
কিউলেক্স মশা ক্ষতিকর নয়, বিরক্তিকর- জানিয়ে ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘এ মশা কানের কাছে শব্দ করে, এটা বিরক্তিকর। কিন্তু এ মশায় কারও রোগ হয় না। ঢাকার কোথাও এমন তথ্য পাইনি।’
এডিস মশা ‘প্রায় নিয়ন্ত্রণে’দাবি করে শামসুল কবির বলেন, ‘দক্ষিণ সিটি এলাকায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর তিন-চারজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে, যা দুই মাস আগের তুলনায় অনেক কম। তারপরও আমরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।’
এমএমএ/এএএইচ/এসএইচএস/এএসএম