বছরজুড়ে বিপর্যয় ছিল প্রাথমিক শিক্ষায়
করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়েই বড় ধাক্কা খায় শিক্ষাখাত। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম চালু থাকলেও বিপর্যয়ে পড়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা। এ পর্যায়ে শিক্ষাকার্যক্রম চালু রাখতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে তা ততটা ফলপ্রসূ হয়নি। করোনাকালে প্রাথমিক শিক্ষা অনেকটা হোমওয়ার্ক আর পরীক্ষা নির্ভর হয়ে পড়ে। অটো প্রমোশন আর জিপিএ-৫ পাওয়ার মহোৎসব চলে ২০২১ সালে। এছাড়া বিদ্যালয়ে শারীরিক উপস্থিতিতে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ থাকলেও নোট-গাইড আর কোচিং বাণিজ্য চলে সমানতালে।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে মিড ডে মিল কার্যক্রমে অনিশ্চয়তা, অনিয়মিত উপবৃত্তি সুবিধা, সারাদেশে শিক্ষক সংকট, বছরজুড়ে শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিতের মধ্য দিয়ে ২০২১ সাল কেটে যায়। এসব সমস্যা সমাধানে নেই কোনো উদ্যোগ। ফলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্মকাণ্ডে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে পরবর্তী প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। এসময়ে প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রম সচল রাখতে সংসদ টেলিভিশনে বিষয়ভিত্তিক ক্লাস সম্প্রচার করা হয়। সেটি গ্রাম পর্যায়ে সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় কমিউনিটি রেডিও ও অনলাইনে নেওয়া হয় ক্লাস। তবে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে এ কার্যক্রম পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।
এ অবস্থায় করোনা সংক্রমণ কমে এলে চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে আশিংকভাবে পাঠদান শুরু করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় মাত্র সাড়ে তিন মাসের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে শিক্ষাবর্ষ শেষ করার। এ কারণে চলতি বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা না নিয়ে অটোপাস ও ক্লাস মূল্যায়ন করার ঘোষণা দেওয়া হয়। একইসঙ্গে বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়ে অটোপাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে তাদের শিক্ষার্থীদের নানাভাবে মূল্যায়ন করছে বলে জানা যায়।
পঞ্চম শ্রেণিতে অটোপাস
করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২১ শিক্ষাবর্ষে পুরো সিলেবাস শেষ করতে না পারায় পঞ্চম শ্রেণিতে অটোপাস দেওয়ার ঘোষণা দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। সেটি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সম্মতি দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয় অটোপাসের ঘোষণা।
প্রাথমিকে ক্লাসভিত্তিক অটো প্রমোশন
চলতি বছর অধিকাংশ সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সব ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে মৌখিক বিষয় পড়ানো হয়েছে। এ কারণে সব ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়ে আগের রোল নম্বর নিয়ে পরবর্তী ক্লাসে তোলার ঘোষণা দেওয়া হয়। সে কারণে এবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। তবে কোনো কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাসভিত্তিক পঠন দক্ষতা মূল্যায়নে ক্লাস পরীক্ষা নেওয়া হয়।
প্রাথমিকের উপবৃত্তি পেতে জন্মনিবন্ধন
প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি পেতে হলে জন্মনিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উপবৃত্তির জন্য তথ্য এন্ট্রির সময় জন্মনিবন্ধন সনদ সংযুক্ত করতে হচ্ছে। ২০২১ সাল থেকে এ নিয়ম চালু হয়েছে।
জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা পরীক্ষানির্ভর হয়ে গেছে। এখানে জিপিএ-৫ পাওয়ার উন্মাদনা ও প্রতিযোগিতা চলে। শিক্ষার্থীরা গুণগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর আদলে নোট-গাইড বিক্রি বৃদ্ধি ও কোচিং বাণিজ্য রমরমা হয়ে উঠছে।
তিনি বলেন, শুধু পরীক্ষা নয়, নানাভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা যায়। এমনিতেই প্রাথমিক শিক্ষা নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, করোনায় সেটি আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। সরকারের চেষ্টা ছিল, করোনার মধ্যেও বিভিন্ন মাধ্যমে পাঠদান চালিয়ে নিতে চেয়েছে। তবে নানা কারণে সরকার সফল হতে পারেনি।
বিশেষ করে গ্রামের শিশুরা শিক্ষা থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। মহামারিতে দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সেটি শিক্ষার ওপর প্রভাব ফেলেছে। সরকার বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দিলেও শিক্ষায় তেমন প্রণোদনা দেয়নি। এমনকি এ খাতে বাজেট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শিক্ষা বাজেটে আমরা নিম্নগামী, যোগ করেন রাশেদা কে চৌধুরী।
প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে পরামর্শ হিসেবে এই শিক্ষাবিদ বলেন, প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণিতে উন্নীত করতে হবে। বাস্তবায়ন করতে হবে শিক্ষানীতি-২০১০। স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে। দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণসহ শিক্ষার মান পুনরুদ্ধারে তৈরি করতে হবে পরিকল্পনা। এর মাধ্যমে করোনায় আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
সব শিশু জরিপের আওতায়
চলতি বছরে শূন্য থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত সব শিশুকে জরিপের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রাথমিকে ভর্তির বাইরে যেন কোনো শিশু না থাকে সেজন্য এ জরিপ।
সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার
সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে অভিন্ন নকশার শহীদ মিনার তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ওই নকশা অনুযায়ী শহীদ মিনার স্থাপন করতে হবে। বিদ্যালয়ের যেখানে সেখানে শহীদ মিনার স্থাপন করা যাবে না।
প্রাথমিক শিক্ষকদের অভিন্ন পরিচয়পত্র
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিন্ন পরিচয়পত্র রাখার সিদ্ধান্ত নেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের পরিচয়পত্র ইস্যু করবেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা-থানা শিক্ষা কর্মকর্তা। অফিস প্রধানরা তার অফিসে কর্মরত সবার এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে তার অধস্তন অফিস প্রধানের পরিচয়পত্র দেবেন।
মিড ডে মিল অনিশ্চয়তায়
মিড ডে মিল কার্যক্রমের মেয়াদ চলতি মাসে শেষ হচ্ছে। এ কার্যক্রম নিয়মিত চালিয়ে নিতে একটি প্রস্তাবিত ডিপিপি (প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাবনা) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে সারাদেশের প্রাথমিকস্তরের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খিচুড়ি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। তবে সেই খিচুড়ি রান্না শিখতে কর্মকর্তাদের বিদেশ পাঠানোর প্রস্তাব করা হয়। সেটি প্রকাশ হলে দেশজুড়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। পরে সেই প্রস্তাবনা বাতিল করে নতুন প্রস্তাবনা দিতে বলা হলেও সেটি এখনো দেওয়া হয়নি। এ কারণে মিড ডে মিল চালিয়ে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় লটারিতে কেন্দ্র সচিব নির্বাচন
প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় নিজ বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা কেন্দ্র সচিব হতে পারবেন না। লিখিত পরীক্ষার দিন লটারি করে কেন্দ্র সচিব নির্বাচন করা হবে। লিখিত পরীক্ষায় পাস করা প্রার্থীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে ভাইভা বোর্ডে প্রবেশের আগে তার জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই-বাছাই করা হবে।
ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি
করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেকে এক জেলা থেকে অন্য জেলা বা নিজ জেলায় চলে গেছে। অনেক শিশু বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে গেছে। অনেক ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হওয়ায় তারা আর স্কুলে আসছে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস চালু হওয়ার পর জেলা পর্যায়ে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখা গেছে। তবে ঢাকা মহানগরে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ৭০ শতাংশ রয়েছে।
উপবৃত্তির অর্থ অনিয়মিত
করোনা পরিস্থিতির কারণে গত ছয় মাস ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তির অর্থ পাচ্ছে না। এখাতে বরাদ্দ করা অর্থ থাকলেও কর্মকর্তাদের অবেহেলার কারণে তা বণ্টন করা হচ্ছে না বলে অনেকের অভিযোগ।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, স্কুল ফিডিং, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন, শিক্ষকদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ‘বই উৎসবের’ মাধ্যমে ১০ কোটিরও অধিক পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের তাদের মাতৃভাষায় প্রথম থেকে তৃতীয়য় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি এখন দৈনন্দিন জীবনের সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। তথ্যপ্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে শিশুদের শিক্ষাকে সহজ, সুন্দর ও সাবলীল করে তুলতে আমরা নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছি। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের লক্ষ্যে ৫০ হাজার ৪১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৮ হাজার ৯২১টি ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ইন্টারনেটসহ সাউন্ড-সিস্টেম সরবরাহ করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের নানা প্রতিবন্ধকতার পরেও বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চালিয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এমএইচএম/কেএসআর/এমআরআর/এএ/জিকেএস