ইভ্যালি-ইঅরেঞ্জ-কিউকম কাণ্ডে সরগরম ছিল আদালতপাড়া
নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষী ২০২১ সাল। বিদায়ী এ বছরটির মাঝামাঝি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এর অন্যতম কারণ ছিল প্রতারণা, গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহ না করা। যার পরিপ্রেক্ষিতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগীরা। এতে দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ ও কিউকমের কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেফতারের পর তাদের একাধিকবার রিমান্ডেও নেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার ও রিমান্ড নিয়ে সরগরম ছিল ঢাকার আদালতপাড়া।
বিদায়ী বছরে ঢাকার আদালতে যেসব আলোচিত মামলা ও মামলার রায় হয়েছে, তা নিয়ে পাঁচ পর্বের সালতামামির আজ থাকছে চতুর্থ পর্ব।
ইভ্যালিকাণ্ডে একাধিক মামলা
গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডের বাসা থেকে ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর বিভিন্ন মামলায় তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন।
ইভ্যালির বিরুদ্ধে ‘রঙ বাংলাদেশে’র দুই মামলা
ইভ্যালির বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে দেশীয় পোশাকের ব্র্যান্ড ‘রঙ বাংলাদেশ’। গিফট ভাউচার বিক্রি বাবদ চেক প্রত্যাখ্যান হওয়ার অভিযোগে ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলকে আসামি করে ঢাকার আদালতে দুটি মামলা করে রঙ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
গুলশান থানায় ইভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা
আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বগ্রাম এলাকার বাসিন্দা মো. আরিফ বাকের গুলশান থানায় মামলা দায়ের করেন।
ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন
তাহসান, মিথিলা ও শবনমের বিরুদ্ধে মামলা
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দেশের জনপ্রিয় তিন তারকা তাহসান খান, রাফিয়াত রশিদ মিথিলা ও শবনম ফারিয়াসহ নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় সাদ স্যাম রহমান নামে ইভ্যালির এক গ্রাহক এ মামলা দায়ের করেন।
ইভ্যালির সিইও ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইনজীবীর মামলা
ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন আলমগীর হোসেন রিগ্যান নামে এক আইনজীবী। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম মাহমুদা আক্তারের আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়।
ইভ্যালির সিইও ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চেক প্রতারণার মামলা
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে চেক প্রতারণার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম আফনান সুমির আদালতে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন।
ই-অরেঞ্জ কাণ্ড
দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ শপের বিরুদ্ধেও প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়।
১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোনিয়ার বিরুদ্ধে মামলা
প্রতারণার মাধ্যমে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান থানায় মামলা করা হয়। এ মামলায় মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানসহ তিনজন কারাগারে রয়েছেন। কারাগারে বন্দি অপর আসামি হলেন প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আমান উল্লাহ।
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে হাতিরঝিল থানায় মামলা
পণ্য সরবরাহ না করে প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের এক কোটি ২০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ৭ অক্টোবর সাজ্জাদ ইসলাম নামে ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
গুলশান থানায় মামলা ও আত্মসমর্পণের পর কারাগারে
গত ১৭ আগস্ট প্রতারণার অভিযোগে মো. তাহেরুল ইসলাম নামে এক ভুক্তভোগী গুলশান থানায় ই-অরেঞ্জের পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এ মামলার অপর দুই আসামি হলেন বিথী আক্তার ও কাওসার। ওই দিন আসামি সোনিয়া ও তার স্বামী আদালতে আত্মসমর্পণ করে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর হাকিম আবুবকর ছিদ্দিকের আদালত জামিনের আবেদন খারিজ করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এরপর গত ১৮ আগস্ট গুলশান থানার প্রতারণার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ই-অরেঞ্জের পাঁচজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তা মঞ্জুর করে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান
সাড়ে ৯ কোটি আত্মসাতের অভিযোগে সোনিয়াসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা
প্রতারণার মাধ্যমে ২৭ গ্রাহকের ৯ কোটি ৫৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ২ অক্টোবর ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিনসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়। ঢাকা মহানগর হাকিম মোর্শেদ আল মামুন ভূইয়ার আদালতে ভুক্তভোগীদের পক্ষে মো. নাসিম প্রধান বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এ মামলার অপর আসামিরা হলেন- সোনিয়া মেহজাবিনের স্বামী মাসুকুর রহমান, শেখ সোহেল রানা, মো. আমান উল্লাহ চৌধুরী, জায়েদুল ফিরোজ, নাজনীন নাহার বিথী ওরফে বিথী আক্তার ও নাজমুল হাসান রাসেল।
প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কোতোয়ালী থানায় মামলা
প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানের বিরুদ্ধে রাজধানীর কোতোয়ালী থানায়ও মামলা করা হয়। এ মামলায় মাসকুর রহমানের দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
কিউকমকাণ্ড
অর্থ আত্মসাতের মামলায় আরজে নীরব গ্রেফতার
রাজধানীর গুলশান থানায় অর্থ আত্মসাতের মামলায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের হেড অব সেলস (কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন) অফিসার হুমায়ুন কবির ওরফে আরজে নীরবকে গ্রেফতার করা হয়। গত ৮ অক্টোবর তাকে রাজধানীর আদাবর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ওইদিনই তেজগাঁও থানার মামলায় নীরবের একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে ১০ অক্টোবর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ১৮ অক্টোবর লালবাগ থানার একটি মামলায় তার আরও একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ওই মামলায় রিমান্ড শেষে ২৫ অক্টোবর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর গুলশান থানার মামলায় গত ২৮ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর গত ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে জামিন পান আরজে নীরব।
কিউকমের সিইও রিপন গ্রেফতার
রাজধানীর পল্টন থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও প্রতারণার অভিযোগে ই-কমার্স সাইট কিউকমের সিইও রিপন মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ অক্টোবর ডিবি মতিঝিল বিভাগ তাকে গ্রেফতার করে। এরপর এ মামলায় দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
কিউকমের সিইও রিপনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা
প্রতারণার অভিযোগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রিপন মিয়ার বিরুদ্ধে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায়ও মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় তার একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
ধামাকাকাণ্ড
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে আরও একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিং ডটকমের বিরুদ্ধে। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ধামাকার চেয়ারম্যান ও এমডিসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগী এক কাপড় ব্যবসায়ী। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ১০-১৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটির তদন্ত শুরু করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাগারে যেতে হয় আরজে নীরবকে
ধামাকা শপিংয়ের সিওওসহ তিনজন গ্রেফতার
গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ধামাকা শপিং ডটকমের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) সিরাজুল ইসলাম রানাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর প্রতারণা মামলায় ধামাকার সিইওসহ দুজনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে গাজীপুরের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক মো. ইকবাল হোসেন এ আদেশ দেন।
এদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের অফিস বন্ধ হয়ে গেছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় বনানীতে ভিড় করেন গ্রাহকরা। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে খবরটিকে বিভ্রান্তিকর বলে দাবি করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করে আলেশা মার্ট। এর প্রায় ৪৫ হাজার গ্রাহক রয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন গ্রাহকরা।
জেএ/ইএ/বিএ/এএসএম