‘বেশি কথাই’ কাল হলো মুরাদের

ইসমাইল হোসাইন রাসেল
ইসমাইল হোসাইন রাসেল ইসমাইল হোসাইন রাসেল
প্রকাশিত: ০৮:৫৪ এএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২১

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসৌজন্যমূলক বক্তব্য দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন ডা. মুরাদ হাসান। তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন নানা সময় তার দাম্ভিকতা আর অনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল চরম পর্যায়ে। সেই দাম্ভিকতা আর অনৈতিক কর্মকাণ্ডেই বছর শেষে পতন ডেকে আনে ডা. মুরাদের।

২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভার ঘোষণা দেন তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। পরদিন ৭ জানুয়ারি শপথ নেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। ওই মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য ডা. মুরাদকে। অন্যদিকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয় ড. হাছান মাহমুদকে। তবে ওই মন্ত্রণালয়ে কোনো প্রতিমন্ত্রী দায়িত্বে ছিলেন না। তবে নানা কারণে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে সেই বছরের ১৯ মে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ডা. মুরাদ হাসানকে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

জানা গেছে, তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন কর্মকর্তাদের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেন ডা. মুরাদ। একজন কর্মকর্তার গায়ে হাত তোলাসহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে গালিগালাজের কারণে তারা উচ্চ পর্যায়ে অভিযোগও করেন। এরপর থেকে তার কাছাকাছি থাকা সরকারি কর্মকর্তারা অনেকটা আতঙ্কেই থাকতেন। তার বিরুদ্ধে সমালোচনা উঠতেই মুখ খুলতে শুরু করেন অনেকে।

বিতর্কের শুরু যেভাবে
বিতর্কিত রাজনীতিক সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান তথ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পর দীর্ঘ সময় বিভিন্ন কার্যক্রমে অনেকটা নীরব ছিলেন। তবে চলতি বছরের শেষদিকে কয়েকদিন ধরেই আলোচনার মধ্যে ছিলেন মুরাদ হাসান, ধারাবাহিকভাবে ভাইরাল হচ্ছিলেন তিনি।

jagonews24

সম্প্রতি বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একজন নেতার কন্যাকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে পড়েন ডা. মুরাদ হাসান। সেসময় তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান নারী অধিকারকর্মীসহ সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা। তবে সেসময় মুরাদ জানান, তিনি এসব বক্তব্য দিয়ে কোনো ভুল করেননি। এগুলো তিনি প্রত্যাহারও করবেন না কিংবা প্রত্যাহার করার ব্যাপারে সরকার ও দলের ওপর থেকে কোনো চাপও নেই। পরে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে উপস্থিত বিএনপির একজন সাবেক নারী এমপিকে ‘মানসিক রোগী’ বলে অভিহিত করে তার সঙ্গে বিতণ্ডায় লিপ্ত হন তিনি।

এ দুটি ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল সমালোচনার দুদিন পরই চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী মুরাদের একটি কথোপকথন ফাঁস হয়, যেখানে তিনি অশ্লীল ভাষায় চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিকে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য বলেন। ফোনে চিত্রনায়ক ইমনকে তিনি বলেন, ঘাড় ধরে যেন মাহিকে তার কাছে নিয়ে যান। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন মহলে ডা. মুরাদের শাস্তির দাবি ওঠে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পদত্যাগ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার মধ্যেই গত ৬ ডিসেম্বর ডা. মুরাদ হাসানকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। সেদিন রাতেই ডা. মুরাদ হাসানকে প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী ৭ ডিসেম্বর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে নিজ মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র পাঠান মুরাদ হাসান। সেদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে পাঠান ডা. মুরাদ। পরে বিকেল ৩টায় তার পক্ষে পদত্যাগপত্রটি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দপ্তরে জমা দেন তথ্য প্রতিমন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। সচিবের পক্ষে তার একান্ত সচিব মাহমুদ ইবনে কাসেম পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠানো এ পদত্যাগপত্রে বলা হয়, ‘গত ১৯ মে ২০২১ স্মারকমূলে আমাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। আমি অদ্য ৭ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে ব্যক্তিগত কারণে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে ইচ্ছুক।’

‘এমতাবস্থায় আপনার নিকট বিনীত নিবেদন এই যে, আমাকে অদ্য ৭ ডিসেম্বর থেকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানের লক্ষ্যে পদত্যাগপত্রটি গ্রহণে আপনার একান্ত মর্জি কামনা করছি।’

ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন ডা. মুরাদ

পদত্যাগের পর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তার কোনো ভুল হলে বা তার কথায় কষ্ট পেলে মা-বোনদের কাছে ক্ষমা চান সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান।

jagonews24

স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি অথবা আমার কথায় মা-বোনদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মমতাময়ী মা দেশরত্ন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সকল সিদ্ধান্ত মেনে নেবো আজীবন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’

বিদেশ গিয়েও ফিরতে হয় দেশেই

ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগের পর বিতর্কিত রাজনীতিক সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান দেশত্যাগ করে কানাডা গিয়েছিলেন। কিন্তু দেশটিতে ঢুকতে না পেরে দুবাই ঢোকার চেষ্টা করেন। সেখানেও ব্যর্থ হওয়ার পর আর উপায় না পেয়ে ১২ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসেন বিতর্কিত মন্তব্য ও নারীদের নিয়ে অশোভন বক্তব্য দিয়ে প্রতিমন্ত্রীর পদ হারানো মুরাদ।

তবে দেশে ফেরার পরও আত্মগোপনেই আছেন ডা. মুরাদ। ১২ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি। মুরাদ এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ইকে-৫৮৬ ফ্লাইটে দেশে ফিরেন। বিমানবন্দরে নামার পর সাংবাদিকদের এড়াতে আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ব্যবহার না করে অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল দিয়ে বের হন তিনি। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন

মুরাদ হাসান ভিআইপি গেটের সামনে এলেও সাংবাদিকদের দেখে আবার ভেতরে চলে যান। পরে বিমানবন্দরের ভেতর দিয়ে অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে যান। সেখানে তার জন্য হোন্ডা সিআরভি ব্র্যান্ডের একটি গাড়ি রাখা ছিল। মাথা ও মুখ ঢেকে সেই গাড়িতে তিনি বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। তিনি পুলিশের উপস্থিতিতে একটি প্রাইভেটকারে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। ডা. মুরাদের বিরুদ্ধে দেশের জেলায় জেলায় মামলা হচ্ছে, অনেক জেলায় মামলার আবেদন করা হয়েছে। ঢাকায়ও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

আইএইচআর/ইএ/এসএইচএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।