একুশে হারালাম যাদের

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:২৭ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০২১
২০২১ সালে যাদের হারিয়েছে দেশ

করোনার বিষে নীল ছিল ২০২০। বিষক্ষয় হয়নি ২০২১ সালেও, যা দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে আরও ঢের। মহামারি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে কেবল জনজীবনই নয়, বিপর্যস্ত হয়েছে দেশের অর্থনীতিও। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের উৎসবমুখর পরিবেশেও লাগাম টেনেছে করোনা। এ অদৃশ্য শক্তির কালো অন্ধকারে হারিয়ে গেছে দেশবরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সংগীত ও অভিনয়শিল্পীসহ নানা ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনদের জীবনপ্রদীপ। আবার অনেকেই বরণ করেছেন স্বাভাবিক মৃত্যু।

বিদায়ী বছরে হারানো সেইসব মানুষদের মধ্যে আছেন হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম), ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, রফিকুল ইসলাম, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান (এটিএম শামসুজ্জামান), সারাহ বেগম কবরী, ফকির আলমগীর, মিতা হক, মুশতারী শফী, খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, রাবেয়া খাতুন, বুলবুল চৌধুরী ও শাহীন আলম। ২১-এ হারানো এ বরেণ্যজনদের নিয়েই বছরান্তে স্মৃতিমন্থনের এ প্রতিবেদন।

হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম)
২০২১ সালের ৪ মার্চ মারা মারা যান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম)। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।

এইচ টি ইমাম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা হয়েও ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে ২০১৪ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা বিষয়ে তিনি একাধিক বই লিখেছেন।

এইচ টি ইমামের জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৫ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শহরে। বাবার চাকরির সুবাদে তার বড় হয়ে ওঠা রাজশাহীতে। কর্মজীবন শুরু শিক্ষকতা দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করার পর সদস্য হিসেবে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন।

রাজনৈতিক জীবনে এইচ টি ইমাম আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও দলীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন। অধিকন্তু তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ
২০২১ সালের ১৬ মার্চ মারা যান বাংলাদেশের সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমদ। দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস ও কিডনি জটিলতায় ভুগে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

মওদুদ আহমদ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জাতীয় পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। পেশায় একজন আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। সাবেক এ সংসদ সদস্য অষ্টম জাতীয় সংসদে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ১৯৪০ সালের ২৪ মে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মাওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমদ এবং মা বেগম আম্বিয়া খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে মওদুদ আহমদ ছিলেন চতুর্থ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর ব্রিটেনের লন্ডনের লিঙ্কন্স ইন থেকে ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। লন্ডনে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে উচ্চ আদালতের আইনজীবী হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন। তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।

১৯৭৭-৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছিলেন মওদুদ আহমদ। ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হলে এক বছরের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা নেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৮৫ সালের নির্বাচনে মওদুদ আহমদ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সরকারের তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এর পরের বছরই তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮৮ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৮৯ সালে তাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং জেনারেল এরশাদ তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি করেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকার জনরোষের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।

১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে মওদুদ আহমদ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা থেকে মোট পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হন তুখোড় এ রাজনীতিক। বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্নে জিয়াউর রহমানকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন তিনি। পরে দলটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন।

মওদুদ আহমদ ছিলেন পল্লীকবি জসীম উদদীনের জামাতা।

রফিকুল ইসলাম
একুশে পদকপ্রাপ্ত নজরুল গবেষক বাংলা একাডেমির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম গত ৩০ নভেম্বর মারা যান। ফুসফুসের জটিলতায় ভুগে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।

রফিকুল ইসলাম ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার কলাকান্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত হন পাক বাহিনীর বন্দিশিবিরে। ২০১২ সালে সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। এছাড়া একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কারসহ নানা সম্মানে ভূষিত হন রফিকুল ইসলাম।

সৈয়দ আবুল মকসুদ
২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মারা যান লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।

আবুল মকসুদ গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের জন্য সুপরিচিত। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ৪০টিরও বেশি। ‘জার্নাল অব জার্মানি’ তার লেখা ভ্রমণকাহিনি। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি।

১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। তার বাবা সৈয়দ আবুল মাহমুদ ও মা সালেহা বেগম। শৈশব থেকে আবুল মকসুদ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা পড়ার সুযোগ পান। আবুল মকসুদের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে এম আনিসুজ্জামান সম্পাদিত সাপ্তাহিক নবযুগ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। এটি ছিল পাকিস্তান সোশ্যালিস্ট পার্টির মুখপত্র। পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সমর্থিত সাপ্তাহিক ‘জনতা’য় কাজ করেন কিছুদিন। একাত্তরে মুক্তযুদ্ধকালে তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ বার্তা সংস্থায়।

হাসান আজিজুল হক
স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকজয়ী প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ৮২ বছর বয়সে গত ১৫ নভেম্বর মারা যান। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগে রাজশাহীর বাসভবনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

হাসান আজিজুল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি লেখালেখি করে গেছেন। তিনি একাধারে গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন।

হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মোহাম্মদ দোয়া বখশ্ ও মা জোহরা খাতুন। জীবনের বেশিরভাগ সময় তার কেটেছে রাজশাহীতে। ১৯৫৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে দর্শনে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। হাসান আজিজুল হক রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় ১৯৬০ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায় ‘শকুন’ শিরোনামে তার একটি গল্প প্রকাশ হয়। এ গল্পের মাধ্যমেই সাহিত্যিক মহলের নজরে আসেন তিনি। ১৯৭৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৪ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানেই কর্মজীবনের ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন।

ফজল-এ-খোদা
গত ৪ জুলাই ভোরে মারা যান ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের গীতিকার ফজল-এ-খোদা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি তার। ফজল-এ-খোদার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

১৯৪১ সালের ৯ মার্চ পাবনা জেলার বেড়া থানার বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার তিন ছেলে, সবাই ঢাকাতেই থাকেন। ছড়াকার হিসেবে লেখালেখি শুরু করেছিলেন ফজল-এ-খোদা। তিনি বেতারে গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৪ সালে টেলিভিশনে গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। দেশাত্মবোধক, আধুনিক, লোক সংগীত এবং ইসলামিক গান লিখে তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

বিবিসির জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় ১২তম স্থানে রয়েছে ফজল-এ-খোদার লেখা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি। এছাড়া তার লেখা উল্লেখযোগ্য গান হলো- ‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’, ‘ভালোবাসার মূল্য কতো, আমি কিছু জানি না’, ‘কলসি কাঁধে ঘাটে যায় কোন রূপসী, ‘বাসন্তী রং শাড়ি পরে কোন রমণী চলে যায়’ প্রভৃতি।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী
গত ২৫ মে মারা যান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। পাকস্থলীর সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। অবস্থার অবনতি হলে ভ্যান্টিলেশনে নেওয়া হয় এ কবিকে। সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি তার।

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর জন্ম ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলায়। তিনি একাধারে কবিতা, উপন্যাস ও শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২০১৮ সালে সরকার তাকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেয়।

এ টি এম শামসুজ্জামান
আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান (এটিএম শামসুজ্জামান) চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি মারা যান। পরিপাকতন্ত্রের জটিলতা নিয়ে কয়েক মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর সূত্রাপুরের নিজ বাসভবনে নেওয়া হলে সেখানে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই বরেণ্য অভিনেতা।

একজন অভিনেতা, পরিচালক ও লেখক হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন এটিএম। অভিনয়ের জন্য আজীবন সম্মাননাসহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ছয়বার। এর মধ্যে দায়ী কে? (১৯৮৭) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে; ম্যাডাম ফুলি (১৯৯৯), চুড়িওয়ালা (২০০১) ও মন বসে না পড়ার টেবিলে (২০০৯) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা বিভাগে এবং চোরাবালি (২০১২) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেতা বিভাগে পুরস্কার পান। ৪২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আয়োজনে তিনি আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন নন্দিত এ অভিনেতা।

সারাহ বেগম কবরী
বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী মারা গেছেন চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল। করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।

চট্টগ্রামের মেয়ে কবরীর পারিবারিক নাম মিনা পাল। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় কবরীর। ১৯৬৫ সালে অভিনয় করেন ‘জলছবি’ ও ‘বাহানা’য়, ১৯৬৮ সালে ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘আবির্ভাব’, ‘বাঁশরি’, ‘যে আগুনে পুড়ি’। ১৯৭০ সালে ‘দীপ নেভে নাই’, ‘দর্পচূর্ণ, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বিনিময়’ ছবিগুলো। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে তার অভিনয় দর্শকদের স্মৃতিতে এখনো অমলিন। ১৯৭৫ সালে নায়ক ফারুকের সঙ্গে ‘সুজন সখী’ ছবিতে অভিনয় করে ছাড়িয়ে যান আগের সব জনপ্রিয়তাকে। পরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাওয়ার। ষাট ও সত্তরের দশকের তুমুল জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা কবরী রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সবশেষ সরকারি অনুদানের ‘এই তুমি সেই তুমি’ চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন ঢাকাই ছবির এ ‘মিষ্টি মেয়ে’।

ফকির আলমগীর
২০২১ সালের ২৩ জুলাই মারা যান বাংলাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।

গণসঙ্গীত ও দেশীয় পপ সঙ্গীতে ফকির আলমগীরের ব্যাপক অবদান। তিনি ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।

ফকির আলমগীর ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মো. হাচেন উদ্দিন ফকির, মা বেগম হাবিবুন্নেসা। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে শিল্পী একজন শব্দসৈনিক হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন।

রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ
একুশে পদকপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ মারা গেছেন ২৫ ডিসেম্বর। সম্প্রতি তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। প্রথমে বাসায় চিকিৎসা নেন। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি এই নন্দিত সাংবাদিকের।

সাংবাদিকতায় গৌরবময় অবদানের জন্য রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ১৯৯৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। গত ২১ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত হন।

রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ‘দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস’ এবং ‘দ্য নিউজ টুডে’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি চারবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন।

মিতা হক
২০২১ সালের ১১ এপ্রিল মারা যান রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হক। প্রথমে করোনা আক্রান্ত হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেখানে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেও কদিন বাদে হার্ট অ্যাটাক হয় মিতা হকের। এরপর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

মিতা হকের জন্ম ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায়। তিনি প্রয়াত অভিনেতা খালেদ খানের স্ত্রী। তার চাচা দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক ও রবীন্দ্র গবেষক ওয়াহিদুল হক। মেয়ে জয়িতাও রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। মিতা হক প্রথমে চাচা ওয়াহিদুল হক এবং পরে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান ও সনজীদা খাতুনের কাছে গানের দীক্ষা নেন। সব মিলিয়ে প্রায় ২০০টি রবীন্দ্রসংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন গুণী এ শিল্পী। ভারত থেকে ১৪টি ও বাংলাদেশ থেকে ১০টি একক অ্যালবাম মুক্তি পায় তার। সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৬ সালে শিল্পকলা এবং ২০২০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন মিতা হক।

বুলবুল চৌধুরী
গত ২৮ আগস্ট মারা যান কথাসাহিত্যিক ও লেখক বুলবুল চৌধুরী। ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে রাজধানীর পুরান ঢাকায় নিজ বাসায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।

ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। গাজীপুরের সন্তান বুলবুল চৌধুরী লেখালেখি ছাড়াও সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। দৈনিক সমকালসহ কাজ করেছেন বিভিন্ন দৈনিকে।

রাবেয়া খাতুন
চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি একুশে পদক বিজয়ী বাংলাদেশি লেখিকা রাবেয়া খাতুন মারা যান। বেশ কিছুদিন বাধ্যর্কজনিত রোগে ভুগে বনানীতে নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকার বিক্রমপুরে মামা বাড়িতে রাবেয়ার জন্ম। পৈতৃক ভিটা মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর গ্রামে৷ রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় বিদ্যালয়ের গণ্ডির পর তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। ব্যক্তিগত জীবনে সম্পাদক ও চিত্রপরিচালক এটিএম ফজলুল হকের সাথে রাবেয়া খাতুনের বিয়ে হয় ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই। তাদের চার সন্তানের মধ্যে রয়েছেন ফরিদুর রেজা সাগর, কেকা ফেরদৌসী, ফরহাদুর রেজা প্রবাল ও ফারহানা কাকলী।

কর্মজীবনে রাবেয়া খাতুন রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মেঘের পর মেঘ’ অবলম্বনে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র মেঘের পরে মেঘ। ২০১১ সালে তার আরেকটি উপন্যাস ‘মধুমতি’ অবলম্বনে পরিচালক শাহজাহান চৌধুরী একই শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। লেখালেখির পাশাপাশি রাবেয়া খাতুন শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করেছেন।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকিং জগতের তারকা খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মারা যান। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

ইব্রাহিম খালেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর। ২০১১ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। ১৯৬৩ সাল থেকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ইব্রাহিম খালেদ। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ১৯৯৬ সালে অগ্রণী ব্যাংক এবং ১৯৯৭ সালে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮-২০০০ মেয়াদে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে আমৃত্যু পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

মুশতারী শফী
একাত্তরের রণাঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখা শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী গত ২০ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। কিডনি ও রক্তে সংক্রমণসহ নানা জটিলতায় ভুগে মারা যান তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মুশতারী শফীর জন্ম। তার বাবার বাড়ি ফরিদপুরে। একাত্তরের এপ্রিলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার স্বামী মোহাম্মদ শফী ও ছোট ভাই এহসানকে পাকসেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি চট্টগ্রামে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

ষাটের দশকে নারী আন্দোলনে সক্রিয় থাকা মুশতারী শফী নব্বইয়ের দশকে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন জোরদার হলে সেখানেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে ভূমিকার পাশাপাশি এতে নেতৃত্বও দেন। জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে এই শহীদজায়া। স্বাধীনতাযুদ্ধে অনন্য ভূমিকায় ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি তাকে ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করে। ২০২০ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘রোকেয়া পদক’ পান তিনি।

শাহীন আলম
চলতি বছরের ৮ মার্চ মারা যান চলচ্চিত্র অভিনেতা শাহীনূর আলম শাহীন (শাহীন আলম)। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি ও ডায়াবেটিস রোগে ভুগে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর।

মঞ্চ নাটকের মাধ্যমে অভিনয়ে হাতেখড়ির পর ১৯৮৬ সালের এফডিসির নতুন মুখের সন্ধানে চলচ্চিত্রে ডাক পান। ১৯৯১ সালে তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘মায়ের কান্না’। প্রায় দেড়শ ছবিতে অভিনয় করা শাহীন আলম শেষজীবনে কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।

এসইউজে/এমকেআর/এইচএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।