ট্রাইব্যুনাল আতঙ্কে কারসাজিচক্র, স্থগিতাদেশে স্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:১৪ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫

২০১৫ সালে দেশের শেয়ারবাজারে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো পুঁজিবাজারের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল। পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গঠন করা হয় এ স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল। চলতি বছরের জুনে কার্যক্রম শুরু হওয়া এই ট্রাইব্যুনালে ইতোমধ্যে রায় ঘোষণা করেছেন একাধিক মামলার। রায়ে আদালত অভিযুক্তদের কারাদণ্ডের পাশাপাশি দিয়েছেন অর্থদণ্ড। ফলে পুঁজিবাজারের শেয়ার কেলেঙ্কারি চক্রের মধ্যে ভর করে ভয়ভীতি আর আতঙ্ক। কিন্তু উচ্চ আদালতে একের পর এক স্থগিতাদেশের কারণে অনেকটা স্বস্তিতে ছিলেন কারসাজিকারিরা।

শেয়ারবাজার সম্পর্কিত বিভিন্ন আইনের দুর্বলতা ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব। একই সঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সীমাবদ্ধতার কারণে শেয়ারবাজারের অনেক কেলেঙ্কারি পার পেয়ে যাচ্ছে। স্থগিত হচ্ছে একর পর এক মামলা। ফলে রাঘব বোয়ালরাও রয়েছেন বিচারের বাইরে- এমনটাই বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
 
চলতি বছর ২১ জুন ১৭টি মামলা নিয়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেন বিচারক হুমায়ুন কবির (বিশেষ জজ)। পরে জুলাই মাসে চারটি ও সেপ্টেম্বরে আরো একটি মামলা নিম্ন আদালত থেকে ট্রাইব্যুনালে আসে। সব মিলিয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলা সংখ্যা দাঁড়ায় ২২টি। এর মধ্যে পাঁচটি মামলা রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। আসামিদের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৪টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। দুটি মামলা ট্রাইব্যুনালের বিচারের এখতিয়ারের বাইরে হওয়ায় তা ফেরত পাঠানো হয়।

বর্তমানে আর একটি মামলার কার্যক্রম চলছে ট্রাইব্যুনালে। এটি প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজ লিমিটেড ও এর পরিচালকদের ডিভিপি-সংক্রান্ত মামলা। চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজের মামলার রায় দেয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।

আলোচিত এ মামলার আসামিরা হলেন; কোম্পানির চেয়ারম্যান ও র্যা ঙ্কস গ্রুপের কর্ণধার এম এ রউফ চৌধুরী, প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান, পরিচালক ও এইচআরসি গ্রুপের কর্ণধার সায়ীদ হোসেন চৌধুরী ও অনু জায়গীদার।

মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজ ১৯৯৬ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের মোট ১২৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা লেনদেনের মধ্যে ডিভিপির পরিমাণ ছিল ৮৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন কোম্পানির ৬৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকার বৈদেশিক ডিভিপির ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৩টি শেয়ার বুঝিয়ে দেয় তারা। আসামিরা বিনিয়োগকারী ও কোম্পানির সঙ্গে প্রতারণামূলকভাবে এটি করেছেন।

উচ্চ আদালতের (হাইকোর্ট) স্থগিতাদেশের কারণে বহুল আলোচিত ১৯৯৬ সালের চিটাগাং সিমেন্টের (বর্তমানে হাইডলবার্গ সিমেন্ট) শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলার কার্যক্রম ছয় মাস পেছানো হয়।

মামলার আসামিরা হলেন- ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি ও চিটাগাং সিমেন্ট লিমিটেডের সাবেক পরিচালক মো. রকিবুর রহমান, ডিএসই ও চট্টগ্রাম সিমেন্টের সাবেক পরিচালক এএস শহিদুল হক বুলবুল এবং টিকে গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু তৈয়ব।

এদিকে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা কমেছে। স্বাস্তিতে রয়েছেন কারসাজিকারীরা।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ট্রাইব্যুনালে মামলার কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কিছুটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ‘নতুন মামলা ট্রাইব্যুনালে আনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে নতুন মামলার কার্যক্রম সরাসরি ট্রাইব্যুনালে যাতে করা যায়, সে জন্য আইন প্রণয়নের বিষয়ে ভাবছে কমিশন। এ জন্য আইন প্রণয়নে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন জাগো নিউজকে বলেন, কারসাজিচক্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। এটি পুঁজিবাজারের জন্য একটি ভালো উদ্যোগ।

ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন একের পর এক স্থগিতাদেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তামানে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বেশিরভাগ মামলা ১৯৯৬ সালের। সেই সময়ে শেয়ারবাজারে সম্পর্কিত বিভিন্ন আইনের অনেক ফাঁক-ফোঁকর ছিলো। সেই সময়ের আইনি দুর্বলতার কারণে আসামিরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।

এখন আইনের অনেক সংস্কার হয়েছে। কারসাজিচক্র কিছু করে এখন সহজে পারও পাবে না। ফলে শেয়ারবাজারের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে কাজ করবে।

অর্থনীতিবিদ খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জাগো নিউজকে বলেন, মামলার কার্যক্রমে স্থবিতার ফলে চক্রান্তকারীরা অনিয়ম করতে সাহস পায়। তবে শেয়ার বাজার ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে এটা একটা ভালো দিক। এই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম নিয়মিত চললে দুষ্ট লোকেরা কারসাজি করতে সাহস পাবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুঁজিবাজারের বিভিন্ন অনিয়ম সংক্রান্ত ৫৩৫টি মামলা রয়েছে। এসব মামলা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, জজকোর্ট, মহানগর দায়রা জজ কোর্ট, শ্রম আদালত, জেনারেল সার্টিফিকেট কোর্টসহ বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

২০১০ সালে পুঁজিবাজার ধসের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুপারিশ করা হয়।

পরে ২০১২ সালে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ সংশোধন করে সরকার। অধ্যাদেশের ২৫ ধারায় সেকশন ‘বি’ সংযোজন করা হয়। ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে বিশেষ জজ হুমায়ুন কবিরকে নিয়োগ দেয়া হয়। এর পর ২০১৫ সালের ২১ জুন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়।
 
স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া পাঁচটি রায়
 
প্রথম রায়
ফেসবুকসহ ছয়টি ওয়েব পোর্টালে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচার গুজব রটনাকারী মাহাবুব সারোয়ারকে দুই বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

দ্বিতীয় রায়
বাংলাদেশ (বিডি) ওয়েল্ডিং ইলেকট্রোডস লিমিটেডের শেয়ারদর নিয়ে কারসাজি করায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম নুরুল ইসলাম ও ডেইলি ইন্ডাস্ট্রিজ পত্রিকার সম্পাদক এনায়েত করিমকে তিন বছরের কারাদণ্ড সহ ২০ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, কারসাজি করায় ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে বিডি ওয়েল্ডিংয়ের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে। তখন এ শেয়ারের দাম ছয় টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। আর এ সময়ে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করেন আসামিরা। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হন বিনিয়োগকারীরা।
 
তৃতীয় রায়
শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলায় চিক টেক্সটাইল লিমিটেডের দুই পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. মাকসুদুর রসূল ও ইফতেখার মোহাম্মদকে ৪ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন বিএসইসি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল। সেই সঙ্গে ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে আরো ৬ মাসের কারাদণ্ড ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল।   

চতুর্থ রায়
২০১০ সালে প্লেসমেন্ট শেয়ার কারসাজি মামলায় সাত্তারুজ্জমান শামীমকে বেকসুর খালাস দেন পুঁজিবাজার সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে গঠিত স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল।

পঞ্চম রায়
গত ৩০ নভেম্বর সৌদি বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি (সাবিনকো) লিমিটেডের মামলার রায় হয়। এতে সাবিনকোর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কুতুব উদ্দিন তার বিরুদ্ধে দায়ের করা শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলা থেকে খালাস পান।
 
কুতুব উদ্দিন ২০০০ সালের জুন-জুলাই মাসে সাবিনকোর তিন কোটি টাকা অবৈধভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন। ওই সময় তিনি ও তার পরিচিত কয়েকজন ব্যক্তি বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের সঙ্গে সমঝোতা করে কৃত্রিমভাবে শেয়ারদর বাড়ান। এতে ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর বিএসইসির তৎকালীন পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।
 
এসআই/এসএইচএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।