২০১৫ সালের আলোচিত সব হত্যাকাণ্ড


প্রকাশিত: ০৩:১৯ এএম, ২১ ডিসেম্বর ২০১৫

বিদায়ের পথে ২০১৫ সাল। নানা কারণেই ২০১৫ ছিল আলোচিত সমালোচিত। বছরটিতে বেশ কয়েকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রধান টার্গেট ছিল মুক্তমনা লেখক-প্রকাশক ও ব্লগার এবং বিদেশি নাগরিকরা। একে একে ব্লগার, লেখক-প্রকাশক ও বিদেশি নাগরিক হত্যার পর নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোর আলোচনায় উঠে আসে। এর অধিকাংশ ঘটনার তদন্তে কূলকিনারা করতে পারেনি গোয়েন্দা পুলিশ।

অভিজিৎ রায়
২০১৫ সালের শুরুতেই ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিজিৎ রায়কে। পরদিনই এর দায় স্বীকার করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। হত্যাকাণ্ড তদন্তে বাংলাদেশ ঘুরে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এফবিআই) সদ্যরা ১১টি আলামত নিয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডে অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকি দেয়ায় শফিউর রহমান ফারাবি নামে এক যুবককে আটক করে র্যা ব। পরে র্যা ব দাবি করে, অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকি দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে ফারাবি।

ওয়াশিকুর রহমান
চলতি বছরের ৩০ মার্চ সকালে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়িতে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পালানোর সময় এলাকার কয়েকজন হিজড়া দুই হত্যাকারীকে আটকে পুলিশে দেয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।’ তবে কয়েক দফায় রিমাণ্ডেও উল্লেখযোগ্য তথ্য পায়নি পুলিশ।

ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস
একইভাবে মে মাসের ১২ তারিখ সিলেটে খুন হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস। ডিএমপি’র গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্লিপার সেলের কাজ। তবে ২৭ দিন পর জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয় দৈনিকের ফটোসাংবাদিক ইদ্রিস আলীকে গ্রেফতার করে সিআইডি পুলিশ।

নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়
গত ৭ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ের দক্ষিণ গোড়ানে ভাড়া বাসায় ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় (২৭) দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হন। সেদিন রাতেই তার স্ত্রী আশা মনি বাদী হয়ে খিলগাঁও থানায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন।

এ ঘটনায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুই জঙ্গি নাহিয়ান ও মাসুদ রানাকে গ্রেফতার করে ডিবি। এই হত্যাকাণ্ডের ৭ দিন আগে সাইফুল ইসলাম নামে একজনকে জঙ্গিকে গ্রেফতার করলেও হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করার কথা স্বীকার করে সাইফুল। তবে গত মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে ব্লগার নিলাদ্রী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ছাত্রশিবির জড়িত বলে জানায় পুলিশ।

বায়েজিদে ল্যাংটা ফকির ও আব্দুল কাদের হত্যা
গত ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানার বাংলাবাজারে মাজারে প্রবেশ করে ল্যাংটা ফকির ও আব্দুল কাদের নামে দু’জনকে নৃশংসভাবে গলা কেটে খুন করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ ‘জেএমবি’র সদস্য সুজন আটক হওয়ার পর হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বলে জানায় পুলিশ।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) কাজী মুত্তাকী ইবনু মিনান বলেন, সুজন ল্যাংটা ফকিরসহ দু’জনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। ‘কথিত পীর’ ল্যাংটা ফকিরকে ভক্ত-মুরিদরা সিজদা দিয়ে শ্রদ্ধা জানাত। এ কর্মকাণ্ডকে ইসলাম বিরোধী মনে করে জেএমবি ল্যাংটা ফকিরকে খুন করা হয়। বাঁচাতে এসে খুন হয় কাদের।

ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেল্লা হত্যা
২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর কূটনীতিক পাড়া গুলশানে ৯০ নম্বর সড়কে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেল্লাকে গুলি করে খুন করে দুর্বৃত্তরা। পরে এ ঘটনায় দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। জঙ্গি হুমকি পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ’ এই দাবি জানিয়েছে। ওয়েবসাইটটি তাদের অফিসিয়াল পেইজে এ সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে।

পরবর্তীতে সিজার তাভেল্লা হত্যায় বিএনপির এক শীর্ষ নেতা জড়িত বলে জানায় ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি বলেন, তাভেল্লাকেই হত্যা করা হবে এমন টার্গেট ছিল না। টার্গেট ছিল যেকেনো সাদা চামড়ার বিদেশি নাগরিক হত্যা। ওই কথিত বড় ভাইয়ের উদ্দেশ্য ছিল সরকারকে বেকায়দায় ফেলা।

এ ঘটনায় মো. রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল ওরফে বিদ্যুৎ রাসেল, মিনহাজুল আরিফিন রাসেল ওরফে ভাগিনা রাসেল ওরফে কালা রাসেল, তামজিদ আহমেদ রুবেল ওরফে মোবাইল ওরফে শুটার রুবেল এবং শাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরীফ নামে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে পুলিশ।

জাপানি নাগরিক হোসি কুনিও হত্যা
অন্যদিকে গত ৩ অক্টোবর বেলা ১১টার দিকে রংপুরের কাউনিয়ায় মাহিগঞ্জ আলুটারি এলাকায় অজ্ঞাতপরিচয় দুই বন্দুকধারীর গুলিতে জাপানি নাগরিক হোসি কুনিও নিহত হন। পরে আইএসের টুইটার বার্তার বরাত দিয়ে রয়টার্সের এক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, কুনিও হত্যায় জড়িত আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)।

এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবির বলেন, রংপুরে জাপানি নাগরিক হোসি কুনিও হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে আটক জেএমবি নেতা ইসহাক আলী (২৫)।

প্রকাশক দীপন হত্যা
৩১ অক্টোবর বিকেলে রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলার ১৩২ নম্বর দোকানে জাগৃতি প্রকাশনার স্বত্ত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনাতেও জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়।

এ ঘটনায় ২ নভেম্বর দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান শাহবাগ থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তদন্তের দায়ভার দেয়া হয় মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশকে।

মুফতি জাহিদ হাসান মারুফ নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষককে আটক করা ছাড়া পৌনে ২ মাস পেরিয়ে গেলেও এঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ঢাকা ও আশুলিয়ায় ২ পুলিশ সদস্য হত্যা
২২ অক্টোবর গাবতলীর দারুসসালাম থানাধীন পর্বত সিনেমা হলের সামনে চেকপোস্টে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা। এ ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে আনা হয়। তবে পরবর্তীতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান এ ঘটনাতেও জঙ্গি সংগঠন জড়িত।

অন্যদিকে, গত ৪ নভেম্বর সকাল ৭টা ৫০ মিনিটের দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে আশুলিয়ার বাড়ৈপাড়া এলাকায় নন্দন পার্কের উল্টো পাশে চেকপোস্টে প্রস্তুতিকালে দুর্বৃত্তদের চাপাতি কোপে নিহত হন কনস্টেবল মুকুল হোসেন (২৪)। আরেক কনস্টেবল নূরে আলমকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়।

এ ঘটনাতেও পরদিন দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট সাইট ইনটেলিজেন্স এ তথ্য জানায়। এ ঘটনার তদন্তেও নেই অগ্রগতি।

খিজির খান হত্যা
৫ অক্টোবর রাজধানী মধ্যবাড্ডার গুদারাঘাটে জ-১০/১ নং বাড়িতে পিডিবি’র সাবেক এ চেয়ারম্যান খিজির খানকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এসময় তার পরিবারের সদস্যদের হাত-পা-মুখও বেধে ফেলে যায় তারা। এঘটনার পরদিন রাজধানীর বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা (নম্বর-৭) দায়ের করেন নিহতের ছোট ছেলে আশরাফুল ইসলাম।

খিজির খান নক্সাবন্দিয়া মুজাদ্দেদিয়ার একজন পীর ছিলেন। অনুসরণ করতেন নুরীকওম তরিকাহ। রহমতিয়া খানকাহ শরীফের ঢাকার শাখাটিও পরিচালনা করতেন তিনি। তারিকুল ইসলাম ওরফে মিঠু ও আলেক বেপারী নামে জেএমবির দুই সদস্যকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিবি পুলিশ জানায়, পীর খিজির খানকে খুন করেছে জেএমবি সদস্যরা।

তাজিয়া মিছিলে হামলা
২৪ অক্টোবর রাজধানীর পুরান ঢাকায় মহররম উপলক্ষে তাজিয়া মিছিল বের হওয়ার সময় রাত আড়াইটার দিকে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে সানজুম (২৮) এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ জন আহত হন। এ ঘটনায় রাজনৈতিকভাবে জামায়াত শিবিরের দিকে ইঙ্গিত করা হলেও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতাকেই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ।

জেইউ/জেডএইচ/এসকেডি/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।