কৌশলী ইসির ব্যালটে ‘আস্থার’ ভোট

সিরাজুজ্জামান
সিরাজুজ্জামান সিরাজুজ্জামান , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:০৩ এএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭

২০১৭ সাল ছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের বছর। তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে সাবেক সচিব খান মোহাম্মদ নূরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) করে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। ২০১৮ সালে ক্ষমতার পালাবদলের নির্বাচন হবে এই ইসির মাধ্যমেই। এ জন্য কমিশন গঠন নিয়ে সবার আগ্রহ ছিল। বিগত কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন ২০১৬ সালের প্রায় পুরো সময়টাতেই নানা কারণে আলোচনা এবং সমালোচনার মধ্যে ছিল। কমিশনের কিছু বিতর্কিত নির্বাচন ও নজিরবিহীন সহিংসতার কারণে সবার আস্থা হারায় সংস্থাটি। সেই আস্থাহীনতার মধ্যেই দায়িত্ব নেয় বর্তমান কমিশন।

বিদায় কাজী রকিবউদ্দীন, স্বাগত নূরুল হুদা
রকিবউদ্দীন কশিনের অধীনেই ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। এছাড়া ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস নির্বাচন হয় বলে দাবি করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ঘটেছে ব্যাপক প্রাণহানি। তবে মেয়াদ শেষে বিদায়ী সিইসি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের সামনে ছিল যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা। এ কঠিন পরিস্থিতিতে দেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প ছিল না। বিদায়ী সিইসি বলেন ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেছি, বিদায়ী সালাম দিয়েছি। উনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের থ্যাংকস দিয়েছেন।’ অন্যদিকে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সাবেক সচিব কে এম নূরুল হুদা জাগো নিউজকে বলেছেন, রাষ্ট্রপতি আমাকে সাংবিধানিক এ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়ায় কৃতজ্ঞ। সাংবিধানিক দায়িত্বটি আমি নিরপেক্ষভাবে সংবিধান ও আইন মেনে পালন করব।

রোডম্যাপ ঘোষণা
আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশের প্রধান দল বিএনপি বিগত নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় বিরোধী দলেও নেই। তাই আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে সবার আগ্রহ তুঙ্গে। আর দায়িত্ব পাওয়ার পরই সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আইনি বিষয় পর্যালোচনা ও সংস্কার, সংসদীয় এলাকার নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা তৈরি, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণসহ সাতটি করণীয় বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে চলতি বছরের ১৬ জুলাই রোডম্যাপ ঘোষণা করে বর্তমান কমিশন। সেই রোডম্যাপ অনুযায়ী কাজ করছে ইসি।

স্মার্টকার্ড বিতরণ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর স্মার্টকার্ড বিতরণ উদ্বোধন করেন। কথা ছিল ২০১৭ সালের মধ্যে সব ভোটারের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেবে ইসি। কিন্তু বিতরণ শুরুর পর এক বছরে ৯ কোটি ভোটারের মধ্যে ২০ শতাংশ কার্ডও বিতরণ করতে পারেনি ইসি। বর্তমানে দেশে ভোটার ১০ কোটি ১৮ লাখের বেশি। লক্ষ্য ছিল এর মধ্যে ৯ কোটি ভোটারের হাতে ডিসেম্বরের মধ্যে স্মার্টকার্ড পৌঁছে দেয়া। ডিসেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত ১ কোটি ৫০ লাখ স্মার্টকার্ড উৎপাদন ও পার্সোনালাইজেশন হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে এ প্রকল্পের আওতায় নাগরিকদের স্মার্টকার্ড দিতে ২০১৫ সালে ফ্রান্সের অবার্থর টেকনোলজির সঙ্গে চুক্তি করেছিল নির্বাচন কমিশন। এই চুক্তির মেয়াদও এ বছর শেষ হয়। ফ্রান্সের ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণে কার্ড বিতরণ সম্ভব হয়নি বলে দাবি করে আসছে ইসি। পরে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে দেশেই তৈরি হচ্ছে স্মার্টকার্ড। এখন জেলায় জেলায় বিতরণ চলছে।

অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ
চলতি বছরের ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংলাপ শুরু করে ইসি। এরপর প্রায় তিন মাস পর্যন্ত গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পর্যবেক্ষক, নারী নেত্রী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপ করে কমিশন। ৪০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শেষ করে নিজেদের সফল বলেও ঘোষণা দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তবে এই সংলাপের মধ্যেই সিইসির বক্তব্যকে কেন্দ্র করে উত্তাপ ছড়ায়। ১৫ অক্টোবর বিএনপির সঙ্গে সংলাপের দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা বলায় তোপের মুখে পড়েন তিনি। পরে সিইসি বলেন, বিএনপির ওয়েবসাইট থেকে তিনি এসব তথ্য পেয়েছেন। এছাড়া ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছিল, জিয়াউর রহমান তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন’ এটা আমি বলেছি বলে দাবি করেন সিইসি।

এর তিনদিন পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের দিন বঙ্গবন্ধুর ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি। রোহিঙ্গা সমস্যা কূটনৈতিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ নেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিশ্বমাতৃকার আসন অলংকৃত করেছেন বলে দাবি করেন সিইসি। এ সময় সিইসি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে রায় কার্যকর করেছে। আওয়ামী লীগ দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দিয়েছে। শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির প্রসার, অবকাঠানোর উন্নয়ন এবং প্রকৃতি সংরক্ষণে আজ ধরিত্রীর বিশ্ব মুকুট শেখ হাসিনার মাথায়। তার এই বক্তব্যের পর সব ঠান্ডা হয়ে যায়। অনেকেই সিইসির কৌশলী ভূমিকার প্রশংসা করেন। সংলাপে প্রাপ্ত সুপারিশ বই আকারে প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছে ইসি। আর সুপারিশগুলো মধ্যে ইসির এখতিয়ারভুক্তগুলো পূরণ করবেন তারা। আর সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সুপারিশগুলো সরকারের কাছে পাঠাবে।

সীমানা পুনর্নির্ধারণে ব্যর্থতা
ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, ডিসেম্বরের মধ্যে সংসীয় সীমানা পুনর্নির্ধারণের কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন সময় সিইসির বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে কয়েকটি ছাড়া সীমানা পুনর্নির্ধাণের কাজে হাত দেবেন না তারা। অথচ সংলাপের সময় বিএনপির দাবি ছিল সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দাবি, বর্তমান সীমানাতেই নির্বাচন করা। সংবিধান অনুযায়ী ভোটারের ভিত্তিতে সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়ে থাকে। দেশের অনেক জায়গায় ভোটার সংখ্যা বাড়লেও মাত্র কয়েকটিতে পরিবর্তন করে বর্তমান সংসদীয় আসনেই নির্বাচন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ছিটমহলসহ বেশ কয়েকটি সংসদীয় সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হবে।

সেরা নির্বাচনের সনদ
দায়িত্ব নেয়ার পর বছর না ঘুরলেও খান মো. নূরুল হুদা কমিশনের পালকে এখন পর্যন্ত অনেক সাফল্য যোগ হয়েছে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সংহিংসতা ঘটলেও রংপুর সিটিতে আনন্দঘন পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি বিএনপিরও প্রশংসা কুড়িয়েছে কমিশন। এমন কি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রসিক নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, সবাইকে এর ফলাফল মেনে নেয়া উচিত। যদিও এর আগে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন, রংপুরে কারচুপি হয়েছে। সেখানে নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে বলে বিএনপির মেয়র প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা সারাদিন দাবি করলেও ফলাফল ঘোষণা শেষে জানান, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।

তবে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে দেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা উল্লেখ করেছে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি)। দেশের ২৮টি সংগঠন নিয়ে গঠিত এই সংস্থা নির্বাচন সম্পর্কে তাদের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলেছে। এছাড়া বহুল আলোচনার পর বাদ দেয়া হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী প্রতীক দাঁড়িপাল্লা। নির্বাচন কমিশন ওই প্রতীক বাদ দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, ২০০৮ সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করেছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী প্রতীক দাঁড়িপাল্লা। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এরপর তাদের প্রতীকও নিষিদ্ধ করেছে ইসি।

এইচএস/ওআর/আরএস/আইআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।