বছরজুড়ে আলোচনায় ইসি, সংলাপ ও বিচারাঙ্গন

আমানউল্লাহ আমান
আমানউল্লাহ আমান আমানউল্লাহ আমান , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:৪৭ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

চলতি বছরের পুরো সময় ধরে রাজপথে তেমন কোনো কর্মসূচি না থাকলেও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় ছিল রাজনৈতিক অঙ্গন। বছরের শুরুতেই নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হলেও সঙ্গে ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বার্ষিকী পালনের বিষয়টিও। বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপনের পাশাপাশি বছরের অধিকাংশ সময়জুড়ে আলোচনায় ছিল ‘উচ্চ আদালত’, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিল’ ও প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ। বছরের শেষ সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা কর্মসূচির পাশাপাশি রাজনৈতিক উত্তাপও বাড়তে শুরু করে। একই সঙ্গে নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও দেখা দিচ্ছে রাজনীতির মাঠে।

২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে নিজ বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। এই হত্যাকাণ্ডের আতঙ্ক নিয়েই শুরু হয় নতুন বছর। ওই ঘটনায় ‘পৃথক নিরাপত্তা’ বাহিনীর দাবি করেন অধিকাংশ সংসদ সদস্য। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ২১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া থেকে জাতীয় পার্টির নেতা সাবেক সংসদ সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল ডা. কাদের খানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।

২০১৭ সালের শুরুতে ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একই দিন ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয় রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। পাল্টাপাল্টি সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা উত্তাপ ছড়ালেও শেষ পযন্ত পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় নিজেদের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ায় বিএনপি। ওই দিন রাজধানীতে সমাবেশ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

ইসি গঠন: নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিএনপির সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। প্রায় ৩১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দুই মাসব্যাপী এই সংলাপ চলে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। পরে ২৫ জানুয়ারি ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। ৬ ফেব্রুয়ারি কে এম নুরুল হুদাকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিশন গঠন করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। কমিশনের বাকি সদস্যরা হলেন সাবেক সচিব মো. রফিকুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বেগম কবিতা খানম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী।

রামপাল: বছরের শুরুতেই বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণাধীন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবন থেকে দূরে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবিতে ২৬ জানুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল পালন করে তেল, গ্যাস, বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটি। এর রেশ কাটতে না কাটতেই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অর্ধদিবস হরতাল পালন করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)।

থেমিস সরানো: ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে কওমি মাদরাসার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণের সামনে স্থাপিত গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরানোর পক্ষে মতো দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা এখানে থাকা উচিত নয়। পরে ২৬ মে রাতে হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের অব্যাহত দাবির মুখে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্যটি সরানো হয়। এর প্রতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণজাগরণ মঞ্চ ও প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠন। পরে পুলিশি বাধার মুখে কর্মসূচি পণ্ড হয়ে যায়।

এরশাদের নেতৃত্বাধীন জোট : বছরের ৭ মে ৫৮টি রাজনৈতিক দল নিয়ে ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক জোটের ঘোষণা দেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। একই সঙ্গে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার ঘোষণা করেন তিনি। এর নয়দিনের মাথায় ১৬ মে ১১টি রাজনৈতিক দল এ জোট থেকে বেরিয়ে পৃথক জোট করার ঘোষণা দেয়।

ষোড়শ সংশোধনী : ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। শুনানি শেষে ২০১৬ বছরের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারকের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়।

পরে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে চলতি বছরের ৮ মে আপিল বিভাগের ‘ফুল বেঞ্চে’ শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা। গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানিতে আপিল বিভাগ আদালত বন্ধু হিসেবে ১০ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর বক্তব্য শোনেন। তাদের মধ্যে ড. কামাল হোসেনসহ নয়জনই সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন। পরে ৩ জুলাই বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

তবে হাইকোর্টের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ ‘এক্সপাঞ্জ’ করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করার রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি। ১ আগস্ট রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট। ১৪ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং তার কিছু পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া এ রায় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় ‘বাকবিতণ্ডা’। ক্ষমতাসীন সরকার, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা এ আদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেন। অপরদিকে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা রায়ের পক্ষে অবস্থান নেন। অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে এক মাসের ছুটি চেয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে ৩ অক্টোবর আবেদন করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ছুটির আবেদন নিয়ে নানা আলোচনার মুখে ১৪ অক্টোবর দেশ ত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি। দেশত্যাগের সময় অসুস্থতার কথা অস্বীকার করেন তিনি। এ নিয়ে জ্বল্পনা-কল্পনা চলার মধ্যেই ১১ নভেম্বর প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করার চিঠি পাঠান রাষ্ট্রপতি বরারব। কানাডা যাওয়ার পথে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনে তিনি রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্রটি জমা দেন।

ইসির সংলাপ : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দল, বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীদের সঙ্গে সংলাপ করে নবগঠিত নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ৩১ জুলাই সুশীল সমাজ, ১৬ ও ১৭ আগস্ট গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় ও ২৪ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করে নির্বাচন কমিশন। ১৯ অক্টোবর শেষ হওয়া সংলাপে মোট ৪০ রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে।

আইসিটি আইনে ৫৭ ধারা: বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করার অভিযোগে ৫৭ ধারা মামলায় কারাগারে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এই ঘটনায় হঠাৎ করেই আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়ে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা। পরে ২ আগস্ট আইসিটি আইনে ৫৭ ধারায় মামলা করার আগে পুলিশ সদর দফতরের আইন শাখার পরামর্শ নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়।

বিএনপির সমাবেশ: দীর্ঘদিন পর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিপ্লব ও সংহতি দিবসের সমাবেশ করে বিএনপি। সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি লোকসমাগম করে। চলতি বছরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপির পক্ষ থেকে সমাবেশ করতে পারাটা ছিল রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের বিষয়।

যুক্তফ্রন্ট : দীর্ঘদিন আলোচনা-বৈঠক শেষে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও বিকল্প ধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে প্রধান করে আত্মপ্রকাশ করে নতুন জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’। ৪ ডিসেম্বর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া এই জোটে রয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্য। বৃহত্তর দুই রাজনৈতিক জোটের বাইরে গঠিত এই তৃতীয় জোটকে স্বাগত জানায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী পক্ষ বিএনপি। জোট গঠন প্রক্রিয়ায় শুরু থেকে যুক্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত জোটে যোগ দেননি সংবিধান প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন।

খালেদা জিয়ার মামলা ও দুর্নীতির অভিযোগ : বছরের শেষের দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিভিন্ন মামলায় আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাকর পরিবেশ সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধ্যপ্রাচ্যে অর্থপাচার করার অভিযোগের বিষয়টি প্রকাশ করেন একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আল্টিমেটাম দেয়া হয়। পরে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়।

এইউএ/ওআর/এসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।