আলোচনায় ছিল নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন

মেসবাহুল হক
মেসবাহুল হক মেসবাহুল হক , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:০৪ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

শেষ হচ্ছে ইংরেজি বছর ২০১৭। বছরটির ২৯ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নতুন বাজেট পাস হয়। বাজেট প্রস্তাবনায় নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের তীব্র বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।

নতুন ভ্যাট আইন দুই বছরের জন্য স্থগিত করে এ বাজেট পাস করা হয়। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচন হবে। ফলে নির্বাচনের আগে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের আর কোনো সুযোগ রইল না। দুই বছরের জন্য স্থগিত করায় নির্বাচনের পরেই এ আইন বাস্তবায়নের সুযোগ পাওয়া যাবে। নির্বাচনের পরে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, কোনো ধরনের টেকনিক্যাল প্রস্তুতি সম্পন্ন না করে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐকমত সৃষ্টি না করে এবং সামাজিক তাৎপর্য অনুধাবন না করে একটি ভালো উদ্যোগ কীভাবে নষ্ট হতে পারে, নতুন ভ্যাট আইন এরই প্রমাণ। ভালো মতো প্রস্তুতি নিয়ে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করার পরামর্শ তাদের।

নতুন ভ্যাট আইন থেকে পিছিয়ে আসায় এলোমেলো হয়ে গেছে নতুন বাজেট। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা ছিল অর্থমন্ত্রীর। আর বেশি আয়ের ওপর নির্ভর করেই বিশাল একটি বাজেট তৈরি করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনায় বড় ধরনের ধাক্কা খান অর্থমন্ত্রী ও সরকার। ভ্যাট আইন ছাড়া বাজেট পাস হলেও বাজেটের আর্থিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। ফলে বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠে বাজেট পাসের সঙ্গে সঙ্গেই।

এ বিষয়ে গত ১৬ জুলাই সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ভ্যাট থেকে পিছু হটার কারণে রাজস্বে টান পড়বে। ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হবে। এজন্য এবারের বাজেট বেশ আগেই সংশোধন করা হবে বলেও জানান তিনি।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বাজেট বাস্তবায়ন বেশ কঠিন হবে। কারণ আমরা বাজেটের সাইজ পরিবর্তন করিনি। কিন্তু রাজস্ব আদায়ে বড় একটা ধাক্কা খাব। এটা আমাদের চিন্তা করতে হবে। আমার মনে হয় এবার আমরা যেটা করব সেটা হচ্ছে সংশোধিত বাজেট বেশ আগেই দেব এবং বাজেটের বিভিন্ন ফিগার চেঞ্জ হবে। যেমন রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা পরিবর্তন হবে।’

ভ্যাট আইন ছাড়া বাজেট পাস হলেও বাজেটের আর্থিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন আনেননি অর্থমন্ত্রী। ফলে ৪ লাখ ২৬৬ হাজার কোটি টাকার বাজেটকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৩৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে এই ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা হচ্ছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) খাতেই আদায়ের কথা আছে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। মোট রাজস্ব আদায় পরিকল্পনার মধ্যে ভ্যাটের অংশই সবচেয়ে বেশি, ৩৬ দশমিক ৮ শতাংশ।

ভ্যাট থেকে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আদায়ের লক্ষ্য হচ্ছে ৬৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ভ্যাট থেকে আদায় বেড়েছিল মাত্র ১৪ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বাড়াতে হবে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। এ হারে ভ্যাট আদায় এর আগে কখনোই এনবিআর করতে পারেনি। ফলে বাজেটের আয়-ব্যয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

সূত্র জানায়, নতুন ভ্যাট আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়েছিল ২০১২ সালে। এর আগে মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদন পায়। জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার আগে রীতি অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়। এরও চার বছর পরে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দু’বার ব্যর্থ হলেন অর্থমন্ত্রী।

পাসের পর আইনটির বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যবসায়ীদের আপত্তির মুখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়েছিল। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ হচ্ছে, কমিটির নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি এনবিআর। তবে ব্যবসায়ীরা নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে আলোচনা করলেও সরকারের নিজের মধ্যে এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি দলের মধ্যেও আলোচনা হয়নি। যদিও এটি ছিল ২০০৯ সালের পর থেকে অর্থনীতিতে সরকারের নেয়া সবচেয়ে বড় সংস্কার প্রস্তাব, কিন্তু সেটিও বাস্তবায়ন করতে পারল না সরকার। ফলে এই বাজেটকেও একটি সংস্কারহীন বাজেট বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

বাজেট পাশের আগে ব্যবসায়ীরা নতুন ভ্যাট আইনের তুমুল বিরোধিতা করেছেন। বাজেট উপস্থাপনের পর নিজ দলের সাংসদেরাই ভ্যাট আইনের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। আবার ভোক্তারাও শঙ্কিত ছিলেন আইনটি নিয়ে। কারণ, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে বলে আশঙ্কা ছিল। নির্বাচনের দেড় বছর আগে সরকার কোনো পক্ষকেই অসন্তুষ্ট করতে চায়নি। জনরুষ্ট থেকে জনতুষ্টির বাজেট করার আগ্রহ থেকেই শেষ মুহূর্তে এ পরিবর্তন। সমাপনী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও বলেছেন, করদাতাদের তিনি সন্তুষ্ট করতে পারেননি।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নতুন ভ্যাট আইন উড়তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে বা এর ‘ক্রাশ ল্যান্ডিং’ হয়েছে। কেন এমনটি হলো? এ নিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কোনো ধরনের টেকনিক্যাল প্রস্তুতি সম্পন্ন না করে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি না করে এবং সামাজিক তাৎপর্য অনুধাবন না করে একটি ভালো উদ্যোগ কীভাবে নষ্ট হতে পারে, নতুন ভ্যাট আইন এরই প্রমাণ।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইনটি দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এর মূল কারণ হলো, ব্যবসায়ীরা সাড়া দিচ্ছেন না। নতুন আইনটি ‘ভালবলা সত্ত্বেও বাস্তবায়ন স্থগিত করা হয়েছে। সরকার ব্যবসায়ীদের ওপর নতুন আইনটি চাপিয়ে দিতে চায়নি। তাদের অসন্তুষ্ট করে ঝুঁকি নিতে চায়নি সরকার। লাভ হয়েছে ব্যবসায়ীদের, কিন্তু ক্ষতি হয়েছে বাজেটের।

‘প্রশ্ন হলো কীভাবে বাজেটের ক্ষতি হলো। সরকার একটি উচ্চাভিলাসী খরচের পরিকল্পনা করে বাজেট দিয়েছে। কর আহরণের মাধ্যমেই উচ্চাভিলাসী খরচের যোগান দেয়া হবে। এ জন্যই নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। নতুন আইন হলে দুর্নীতি কমবে, স্বচ্ছতা বাড়বে; তেমনি রাজস্ব আদায়ও বাড়বে। এই বাজেটের প্রধান আকর্ষণ ভ্যাট আইনটি শেষ পর্যন্ত হলো না। কিন্তু রাজস্ব লক্ষ্য কমানো হয়নি। তাই খরচের যোগান দিতে রাজস্ব লক্ষ্য অর্জনই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।’

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম বলেন, ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আমরা শুরু থেকেই বলে আসছিলাম, এ আইন বাস্তবায়নের জন্য এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না। আইনটি বাস্তবায়নের জন্য আনুষাঙ্গিক যেসব প্রস্তুতি দরকার ছিল, সরকারের পক্ষ থেকে তা নেয়া হয়নি। এসব প্রস্তুতি সম্পন্ন না করে আইনটি বাস্তবায়নে যাওয়া ঠিক হবে না বলেও আমরা বলেছিলাম। এ অবস্থায় আইনটির বাস্তবায়ন দুই বছর পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।

আশা করছি, সরকার এ দুই বছর সময়কে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের প্রস্তুতির জন্য ভালোভাবেই কাজে লাগাবে। ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রস্তুতিও যথাযথভাবে সম্পন্ন করা হবে। আর যদি সেটি সম্ভব না হয়, তাহলে এবার এসে যেসব কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি দুই বছর পর আবারও সেই পরিস্থিতি দেখা দেবে।

সূত্র জানায়, বাজেট দেয়ার পরে জাতীয় সংসদে আলোচনা শেষে পাসের সময় কিছু কিছু পরিবর্তন আনা রীতিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবারই ছোটখাট পরিবর্তন আনা হয়। তবে এবার ভ্যাট আইন স্থগিত করার মতো যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এমনটা অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি। কারণ নতুন ভ্যাট আইন ছিল এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় রাজস্ব প্রস্তাব। বাজেট বাস্তবায়নের ওপর এর প্রভাবও পড়বে বেশি।

এর আগে ২০০৫ সালে বাজেট পাসের দেড় মাসের মাথায় আমদানি শুল্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছিল। সে সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন এম সাইফুর রহমান। মূলত বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পণ্যের শুল্ক হারে পরিবর্তন এনেছিলেন তিনি। এভাবে শর্ত পূরণ করে ৩০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া গিয়েছিল।

২০০৫ সালে দাতাদের কারণে পরিবর্তন আনা হলেও এবার বরং ভ্যাট আইন করার জন্যই বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের পরামর্শ ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাপ ও দলের সদস্যদের সমালোচনার মুখেই ভ্যাট আইন স্থগিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ২০০৫ কে ছাড়িয়ে যায় ২০১৭।

এমইউএইচ/এমআরএম/আইআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।