তৌফা-তহুরা ও মুক্তামণির সফল অস্ত্রোপচার

মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল
মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০১:৫৮ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

চলতি বছর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গাইবান্ধার ‘পাইগোপেগাস’ শিশু তৌফা ও তহুরা এবং বিরল চর্মরোগে আক্রান্ত সাতক্ষীরার শিশু মুক্তামণির সফল অস্ত্রোপচার স্বাস্থ্যসেবায় সাফল্যগাথা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছে।

দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তুষ্টি থাকলেও ঢামেকের চিকিৎসকরা এ তিন শিশুর সফল অস্ত্রোপচারে নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও আন্তরিকতার অকাট্য প্রমাণ দিয়েছেন। সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশের চিকিৎসকরা যেখানে অস্ত্রোপচার করাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করে মুক্তামণির অস্ত্রোপচার করতে গড়িমসি করেছেন সেখানে ঢামেকের চিকিৎসকরা ঝুঁকি নিয়ে অস্ত্রোপচার করে সফলতা দেখিয়েছেন।

অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়ে কয়েকমাস আগে বাড়ি ফিরে গেছে তৌফা ও তহুরা। মুক্তামণির চিকিৎসা এখনও শেষ না হলেও প্রায় ছয়মাস হাসপাতালে কাটিয়ে তিনদিন আগে গ্রামের বাড়ি গেছেন বেড়াতে। বছর জুড়ে আলোচনায় ছিল এ তিন শিশুর সফল অস্ত্রোপচার।

ফিরে দেখা তৌফা-তহুরার গল্পগাথা
২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কোমরে জোড়া লাগানো অবস্থায় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার রামজীবন ইউনিয়নের কাশদহ গ্রামে নানার বাড়িতে তৌফা ও তহুরার জন্ম হয়। এ দুই শিশুর বাবা রাজু মিয়া একজন সাধারণ দিনমজুর, মা শাহিদা গৃহিণী। জন্মের পরে গত ১৬ অক্টোবর প্রথম অস্ত্রোপচার হয়। শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শাহেনুর ইসলামের অধীনে অস্ত্রোপচার হয়।

ঢামেকের একাধিক চিকিৎসক জাগো নিউজকে জানান, জন্মের পর থেকে ১০ মাস তৌফা ও তহুরা একসঙ্গে বড় হয়েছে। পিঠের কাছ থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। জন্মের পর দুজনের পায়খানার রাস্তা ছিল না। জন্মের ৮ দিনের মাথায় এ হাসপাতালের একই বিভাগে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাদের পায়খানার রাস্তা তৈরি করা হয়। তবে তাদের মাথা-হাত-পা ছিল আলাদা। তৌফা-তহুরা যেভাবে জোড়া লাগানো ছিল, চিকিত্সা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘পাইগোপেগাস’।

দ্বিতীয় দফায় চলতি বছরের ১ আগস্ট তৌফা-তহুরার দেহে অস্ত্রোপচার করা হয়। শিশু দুটোর অস্ত্রোপচারে বিভিন্ন বিভাগের ১৬ জন সার্জন যুক্ত ছিলেন। অন্যদের মধ্যে শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আব্দুল হানিফ ডা. রাজিউল হাসান, ডা. এস এম শফিকুল আলম, ডা. অসীত চন্দ্র সরকার, ডা. আশরাফুল হক, ডা. আব্দুল হানিফ ও ডা. কানিজ হাসিনা অস্ত্রোপচারে অংশগ্রহণ করেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রথম জোড়া লাগানো শিশু হাসান-হোসাইনের অস্ত্রোপচার হয় ২০০২ সালে। অস্ত্রোপচার করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু সার্জারি বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন। পরে ২০০৮ সালে একই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু সার্জারি বিভাগের ওই সময়ের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সফিকুল হক বর্ষা-বন্যা নামক দুই বোনকে অস্ত্রোপচার করে আলাদা করেন। অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিনও ওই অস্ত্রোপচার বোর্ডের সদস্য ছিলেন।

একবছর আগে একই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু শল্যবিদ অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন জোড়া লাগানো আলীকে আলাদা করেন। আলীও এখন সুস্থ আছে। এদিকে বাংলাদেশে জোড়া শিশু আলাদা করার সফলতার হার বিশ্বের যেকোনো দেশের সমান।

ফিরে দেখা মুক্তামণি
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কামারবাইশা গ্রামের মুদি দোকানি ইব্রাহিম গাজী ও আসমা খাতুন দম্পত্তির জমজ দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে ১২ বছরের কিশোরী মুক্তামণি। দেড় বছর বয়সে তার ডান হাতে একটি ছোট গোটা দেখা হয়। পরবর্তীতে সেটি বড় হতে থাকে। বছর তিনেক আগে ডান হাতে বিরল ধরনের চর্ম রোগে হেমেনজিওমা আক্রান্ত হয়। রক্তনালীতে টিউমার হওয়ার কারণে হাত ফুলে যায় মুক্তামণির। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করার এক পর্যায়ে চর্মরোগে আক্রান্ত ডান হাতটি গাছের বাকলের মতো ফুলে ভয়াবহ আকার ধারণ করলে স্কুলে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায় মুক্তামণির। লোকলজ্জার ভয়ে আড়ালে থাকা শিশুটিকে নিয়ে জাগো নিউজসহ একাধিক গণমাধ্যমে গত ৯ জুলাই প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তা তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব মো. সিরাজুল ইসলামের নজরে আসে।

তিনি শিশুটির সুচিকিৎসার দায়িত্ব নেন এবং মুক্তামণিকে গত ১১ জুলাই ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে তার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়।

প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করার পর শুরু হয় অস্ত্রোপচার। মুক্তামণির অস্ত্রোপচারে ঢামেক বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন, বার্ন ইউনিট পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, অধ্যাপক সাজ্জাদ খোন্দকার, অধ্যাপক রায়হানা আউয়াল, দুইজন সহযোগী অধ্যাপক, ৭ জন সহকারী অধ্যাপকসহ অন্যান্য চিকিৎসক এবং ঢামেক হাসপাতালের অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোজাফফর হোসনসহ আরেকজন এবং বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের চারজন চিকিৎসক অংশ নেন। প্রায় ছয়মাসের চিকিৎসাকালে কমপক্ষে পাঁচ বার অস্ত্রোপচার হয়।

অস্ত্রোপচারের আগে পরে কয়েকবার মুক্তামণিকে আইসিইউতে রাখতে হয়। পুরোপুরি সুস্থ না হলে মুক্তামণি আগের তুলনায় ভালো রয়েছে বলে জানান বার্ন বিশেষজ্ঞরা। তিনদিন আগে মুক্তামণিকে হাসপাতাল থেকে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে একমাসের ছুটি দেয়া হয়। ছুটি শেষে ফিরে আসলে আবার তার চিকিৎসা শুরু হবে।

এমইউ/জেএইচ/এসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।