ফিরে দেখা : ‘সাত খুন’

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:১২ এএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭

নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলায় সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মুহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানাসহ ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে বাকি ১১ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করে রায় দেন আদালত। এর আগে এই মামলায় ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

এছাড়া ৩৫ আসামির মধ্যে বিচারিক (নিম্ন) আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে দেয়া সাজায় দণ্ডপ্রাপ্ত নয়জনের দণ্ডও বহাল রাখা হয়েছে। চলতি বছরের ২২ অাগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন, র‌্যাব-১১-এর ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, সিপাহী আবু তৈয়্যব আলী, কনস্টেবল শিহাবউদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, আরওজি-১ এবি মো. আরিফ হোসেন, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আলআমিন শরীফ ও সৈনিক এমডি তাজুল ইসলাম।

মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাদের যাবজ্জীবন দণ্ড দেয়া হয়েছে তারা হলেন- সৈনিক আসাদুজ্জামান নুর, সার্জেন্ট এনামুল কবীর, নুর হোসেনের সহযোগী মুর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু ওরফে মিজান, মো. রহম আলী, মো. আবুল বাসার, সেলিম, মো. সানাউল্লাহ অরফে সানা, ম্যানেজার শাহজাহান ও জামাল উদ্দিন।

সাতশ’ পৃষ্ঠার এই রায়ে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, তারা যদি ছাড়া পেয়ে যায় তবে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে। রায়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধলা হলো-

কিছু উচ্ছৃঙ্খল র‌্যাবের কারণে অর্জন ম্লান হতে পারে না
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, কিছু উচ্ছৃঙ্খল র্যাব সদস্যের কারণে এ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে না। তাদের সন্ত্রাসবিরোধী গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ধূলিসাৎ হতে পারে না। কিন্তু এ ঘটনায় বাহিনীর কতিপয় সদস্যের শয়তানি প্রবৃত্তি মানবসভ্যতার মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।

পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আমলে নিয়ে আদালত এ রায় ঘোষণা করেছেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেছিলেন জবানবন্দি জোর করে আদায় করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো তথ্য-প্রমাণ তারা দিতে পারেননি এবং আদালতে আসামিপক্ষের এসব যুক্তি বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। তাই আদালত আসামিদের স্বীকারোক্তি আমলে নিয়েই এ রায় প্রদান করেছেন।

আদালত বলেন, র‌্যাব একটি এলিট ফোর্স। মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য তারা বহুবিধ কাজ করেছে। কতিপয় ব্যক্তির জন্য সামগ্রিকভাবে এই বাহিনীকে দায়ী করা যায় না। তাদের ভাবমূর্তি নষ্টেরও কারণ নেই। কতিপয় অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের দণ্ড প্রদান করা হয়েছে।

র‌্যাব সদস্যরা এতটাই নির্দয় ছিল যে...
আদালত তার পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, যে সাতজনকে হত্যা করা হয়, র‌্যাব হেফাজতে তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা ছিল ভয়াবহ এবং অকল্পনীয়। র‌্যাব সদস্যরা এতটাই নির্দয় ছিল যে, তাদের হত্যার পর তলপেটে ছুরি দিয়ে কেটে বস্তাবন্দি করা হয়। প্রতিটি বস্তার সঙ্গে ১০টি ইট করে বেঁধে দেয়া হয় যাতে মরদেহ নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। তাদের এই নৃশংসতা প্রমাণ করে মৃতদেহের ওপর তারা কতটা নির্দয় ছিল।

নূর হোসেনই এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড
রায়ে বলা হয়, আসামিরা যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তাতে উঠে এসেছে, এ হত্যাকাণ্ডটি ছিল সুপরিকল্পিত এবং ষড়যন্ত্রমূলক। আর্থিক লেনদেন হয়েছে নূর হোসেনের সঙ্গে। এই নূর হোসেনই হলেন হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড। তার সঙ্গে ছিলেন তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ ও কমান্ডার মাসুদ রানা। তবে আসামিপক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এ মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী কোনো সাক্ষ্য নেই এবং আর্থিক লেনদেনেরও কোনো প্রমাণ নেই।

রায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল ও নিহত নজরুলের স্ত্রীর সন্তোষ প্রকাশ
রায় ঘোষণার পর স্বস্তি প্রকাশ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ে যাবজ্জীবন প্রাপ্তদের বিষয়ে আপিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, আসামিরা যে ধরনের অপকর্ম করেছে তার উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টেও এ রায় বহাল থাকবে এবং দ্রুত দণ্ড কার্যকর হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

আসামিপক্ষের দাবি: রায়ে ন্যায়বিচারের প্রতিফলন ঘটেনি
অন্যদিকে রায়ের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূর হোসেন এবং অবসরপ্রাপ্ত মেজর আরিফ হোসেনের আইনজীবী লুৎফুর রহমান আকন্দ ও এসএম শাহজাহান বলেছেন, রায়ে ন্যায়বিচারের প্রতিফলন ঘটেনি।

সাত খুনের ঘটনাক্রম ও দুটি মামলা এবং নিন্ম আদালতের রায়
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নাসিক কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দনসরকারসহ সাতজন। তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি মরদেহ। পরদিন মেলে আরেকজনের মরদেহ। নিহত অন্যরা হলেন- নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম।

ঘটনার একদিন পর নিহত নজরুলের স্ত্রী বিউটি ও চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল দুটি মামলা করেন। একসঙ্গে দুই মামলার বিচার শেষে ১৬ জানুয়ারি রায় দেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন। এতে প্রধান আসামি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। মোট ৩৫ আসামির মধ্যে বাকি নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

বিচারিক আদালতের রায়ে এ মামলায় দণ্ডিত ৩৫ আসামির মধ্যে ২৫ জনই র‌্যাবের সদস্য। ফৌজদারি অপরাধে একসঙ্গে এত র্যাব সদস্যের সাজা এর আগে আর হয়নি। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৫ জন সেনাবাহিনী, দু’জন নৌবাহিনী ও আটজন পুলিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে ছিলেন। সাত খুনের মামলা হওয়ার পর তাদের সবাইকে চাকরিচ্যুত করা হয়। একসঙ্গে সাতজনকে হত্যার পর মরদেহ ডুবিয়ে দেয়ার ওই ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেয়। ওই হত্যাকাণ্ডে এলিট বাহিনী র্যাবের কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও শিরোনাম হয়।

এফএইচ/বিএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।