গুলশান হামলায় প্রাণ যায় দেশি-বিদেশি ২০ জিম্মির


প্রকাশিত: ০৪:৪১ এএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬

নানা ঘটনার কারণে ২০১৬ সাল ছিল আলোচিত। বছর জুড়েই প্রত্যেকটি জঙ্গি অভিযানে প্রশংসা পাওয়ার মতো সফলতা দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত বছর হোসনি দালানের হামলাকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে প্রত্যেকটি সেক্টরেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে ১ জুলাই কূটনৈতিকপাড়ার হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা ছিল বছরের সবচেয়ে উদ্বেগের।
 
শ্বাসরুদ্ধকর ১২ ঘণ্টার জিম্মি দশায় আটকা পড়ে ৫০ জনের মতো দেশি-বিদেশি নাগরিক। শুরুতেই মুখোমুখি গোলাগুলিতে প্রাণ হারান পুলিশের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, কূটনৈতিক এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে এ ধরনের হামলা ও জিম্মি সঙ্কট বাংলাদেশে এই প্রথম। নিঃসন্দেহে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতার পরিচয় বহন করে কূটনৈতিকপাড়ার এ হামলা। জঙ্গিদের কৌশলও ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অজানা। হুমকি থাকলেও গুলশানের মতো স্থানে হামলা হতে পারে তা ছিল অনেকটাই চিন্তার বাইরে।
 
এরপর অনেকটা ঘোষণা দিয়েই শুরু হয় দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযান। আট জঙ্গি আস্তানাসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয় ৩৪ জঙ্গি। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজায় ডিএমপি। কূটনৈতিকপাড়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনা হয়।
 
কী ঘটেছিল ১ জুলাই
বিদেশিদের কাছে জনপ্রিয় গুলশানের ৭৯ নং সড়কে লেকের নিকটস্থ হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ। ১ জুলাই ( শুক্রবার) সন্ধ্যায় ইফতারের পর গুলশানের ফাঁকা রাস্তা ও গলিপথ পেরিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ৭৯ নং রাস্তার গলিতে ঢুকে পড়ে জঙ্গিরা। হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর সুপারভাইজার সুমন রেজা জানান, আট থেকে ১০ জন যুবক হঠাৎ সেখানে ঢুকে পড়ে। তাদের একজনের হাতে তলোয়ার এবং অন্যদের কাছে ‘ছোট আকারের বড় ম্যাগাজিনের’ আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। হামলাকারীরা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে ভেতরে ঢোকে এবং ফাঁকা গুলি শুরু করে। হামলাকারীরা ১০ থেকে ১২টি বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর সোয়া ৯টার দিকে সেখানে হাজির হয় গুলশান ও বনানী থানা পুলিশ। বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন পূর্বানুমান ছাড়াই সাহসিকতার সঙ্গে গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করা মাত্র অতর্কিত গোলাগুলির মধ্যে পড়েন। গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। এরপর থানা পুলিশ, সোয়াত টিম, বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিট, ডিবি পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষিত টিম সেখানে হাজির করা হয়। গোলাগুলিতে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ।
 
পুলিশ কনস্টেবল আলমগীর ও প্রদীপ এবং গাড়িচালক আবদুর রাজ্জাক রানাসহ অন্তত ২৫ জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়। রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে রেস্তোরাঁটিতে অস্ত্রধারীরা পরপর দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। রাত ১১টার দিকে র‌্যারেব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, রেস্তোরাঁর কিছু কর্মচারী বের হয়ে এসেছে। তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এখন আমরা চেষ্টা করছি, যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়। বিপথগামী যারা ভেতরে আছে, তাদের সঙ্গেও আমরা কথা বলার চেষ্টা করছি।’
 
ঘটনার সঙ্গে বিদেশি ষড়যন্ত্রের সন্দেহ ও আতঙ্ক ঠেকাতে টেলিভিশনে লাইভ রিপোর্টিং বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান র‌্যাবের মহাপরিচালক। তবে জিম্মি সঙ্কটের তথ্য প্রকাশ পাবার পর দেশি বিদেশি নাগরিকদের নজর ছিল অনলাইন পোর্টালগুলোতে। দেশি বিদেশি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলো সংবাদ প্রচার করতে থাকে। গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় আটকা পড়ার খবরে সেখানে উপস্থিত হন উৎকণ্ঠিত  আত্মীয়-স্বজন।

পুলিশ বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা আটকে দেয় হামলার পরপরই। আশপাশের বিপণিবিতান ও রেস্তোরাঁয় আসা লোকজন রাস্তায় আটকা পড়েন। বন্ধ করে দেয়া হয় সর্বসাধারণের ঢোকার রাস্তাও। পরিস্থিতি থমথমে হয়ে ওঠে। রাত ১টার দিকেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন নৌবাহিনীর একটি কমান্ডো দল। দেখা যায় সেনাবাহিনীর একটি প্রতিনিধি দলকেও। ৭৯ নম্বর সড়কের মোড়ে পুলিশের কয়েকটি সাঁজোয়া যান এনে রাখা হয়। অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি প্রস্তুত রাখা হয় ফায়ার সার্ভিস এবং বিদ্যুৎ বিভাগের গাড়ি। ভোর ৫টার দিকে হ্যান্ড মাইকে সাধারণ পোশাকের সবাইকে ৭৯ নং সড়কের বাইরে অবস্থান নিতে বলা হয়।
 
braverdrink

ভোর রাতের দিকে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের দায় স্বীকারের খবর আসে। আইএসের মুখপত্র আমাক খবর প্রচার করে যে, হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪০ জন, যাদের কয়েকজন বিদেশি। ভোর পৌনে ৪টার দিকে পুলিশ ১৮ বছর বয়সী এক তরুণকে রক্তাক্ত অবস্থায় আটক করে নিয়ে যায়। ভোরে পুলিশ ও র্যা ব সদস্যরা হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর আশপাশের পুরো এলাকা ঘিরে অবস্থান নেয়। সকাল সাড়ে ৭টার পর কমোন্ডো অভিযান শুরু হয়। এতে প্যারা কমান্ডোদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানকে অংশ নিতে দেখা যায়।

প্রথম আধা ঘণ্টায় সহস্রাধিক রাউন্ড গুলির পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায় দূর থেকে। সোয়া ৮টার পর সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢোকে। ওই কম্পাউন্ডের বাইরের দিকে থাকা পিজা কর্নার এ সময় গুঁড়িয়ে যায়। অভিযানের শেষ দিকে ফায়ার সার্ভিস কর্মী ও চিকিৎসক স্ট্রেচার নিয়ে ওই ক্যাফের ভেতরে যান। কমাণ্ডো অভিযানে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসেন কয়েকজন। অভিযান শেষে পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক জানান, ‘১৩ জন সেইফ।
 
দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে আইএসপিআর জানায়, ২০ বিদেশি জিম্মিকে রাতেই হত্যা করা হয়। ৩ বিদেশিসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। একটি একে-২২ রাইফেল, চারটি পিস্তল, চারটি অবিস্ফোরিত আইইডি উদ্ধার করা হয়। সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশন্সের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ নামের ওই অভিযান সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়ে সকাল সাড়ে ৮টায় শেষ হয়। ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যে সকল অপরাধীকে নির্মূল করে সকাল সাড়ে ৮টায় অভিযানের সফল সমাপ্তি ঘটে’।
 
পরবর্তীতে ডিএমপি সূত্র জানায়, নিহত বিদেশিদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি ও একজন ভারতের নাগরিক। অপর তিনজন বাংলাদেশি। অভিযানে নিহত ৫ জঙ্গি হলেন, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সাবিহ মোবাশ্বের, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল।কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের প্রধান (সিটি) মনিরুল ইসলাম জানান, গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় অস্ত্র এসেছিল ভারত হয়ে। আর অর্থ এসেছিল মধ্যপ্রাচ্য থেকে।
 
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির বক্তব্যে উঠে আসে গুলশান হামলার মাস্টার মাইন্ড মেজর জিয়া ও তামিম। গুলশান হামলাসহ অন্য হামলায় জড়িতদের ধরতে শুরু হয় দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযান।এরপর ঢাকার কল্যাণপুর, রূপনগর, আজিমপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট ও এলিট ফোর্স র‌্যাব। এসব অভিযানে ‘নব্য জেএমবির’শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীসহ নিহত হয় ৩৪ জঙ্গি সদস্য।

জেইউ/ওআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।