শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদায় ইসলাম
দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র। আল্লাহ তাআলা মানুষকে শ্রম শক্তি দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। শ্রম যেমন হবে ফলাফলও সে অনুযায়ীই হবে। শ্রমের ফলাফল যেমনই হোক আল্লাহর কাছে বান্দার শ্রমের মর্যাদা অনেক বেশি। কারণ এ শ্রমের মাধ্যমেই আখিরাতের সফলতা লাভের ঘোষণা এসেছে।
যিনি শ্রম দেন বা কাজ বাস্তবায়ন করেন তিনি হলেন শ্রমিক। শ্রমিক যদি তাঁর কাজ যথাযথভাবে আদায় করে, তবেই সে পাবে তার সুস্পষ্ট ফলাফল। মানুষের জীবনের সকল কর্ম বা শ্রমের মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া এবং আখিরাতের কর্মফল। যে কারণে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদায় সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন।
যদিও দুনিয়াতে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৮৮৪ সাল থেকে শ্রমিকদের শ্রম অধিকার ও ন্যায্য হিস্যা লাভের আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তীতে এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৮৮৬ সালের ৪ মে সন্ধ্যা বেলায় শ্রম ও শ্রমিকের অধিকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বস্তবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের বাণিজ্যিক এলাকা হে মার্কেটের সামনে শ্রমিক জনতা জড়ো হয়। সে দিন আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলি চালালে ১১ জন শ্রমিককে হত্যা করা হয়। আন্দোলনকারী বন্দিদের মধ্য থেকে ৬ জনকে উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসি দেয়া হয়। অনেক আন্দোলন সংগ্রামের পর মে মাসের ১ তারিখকে কোনো কোনো দেশ ‘শ্রম দিবস’ আবার কেউ কেউ ‘শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।
অথচ পৃথিবীর সূচনা লগ্ন থেকেই শ্রমের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই ইসলাম শ্রমের মর্যাদা যেমন দিয়েছে তেমনি শ্রমিকের মর্যাদাও দিয়েছে। পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম আলাইহিস সালাম নিজে কৃষিকাজে শ্রম দিয়ে সংসারে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতেন। পাশাপাশি মা হাওয়া আলাইহিস সালাম কাপড় বুনন, সেলাই এবং কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাণ করে হজরত আদম আলাইহিস সালামের শ্রম সহযোগিতায় অবদান রাখতেন।
হজরত নুহ আলাইহিস সালাম মহাপ্লাবনের পূর্বে আল্লাহর নির্দেশে নিজ শ্রমের মাধ্যমে এক বিশাল কিস্তি নির্মাণ করেছিলেন। তিনতলা ও বহু কক্ষবিশিষ্ট এই কিস্তি নির্মাণের শ্রম বিফলে যায়নি। এ শ্রমের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায় মানুষের অনেক কল্যাণ এবং সকল জীবের অস্তিত সংরক্ষণসহ তাঁ প্রিয় বান্দাদের মহাপ্লাবন থেকে হিফাজত করেছিলেন।
ইসলামে ইবাদাত কবুলের পূর্বশত করা হয়েছে হালাল রুটি এবং রুজিকে। মানুষের সঠিক ও কঠোর শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দ্বারাই জীবিকা নির্বাহের নির্দেশনা রয়েছে। শ্রমের মধ্যে যদি ফাঁকি বা প্রতারণা থাকে তবে সে অর্থের জীবিকা ভক্ষণে ইবাদাত করলে তা হবে নিষ্ফল ইবাদাত।
শ্রমকে মানুষ কষ্ট মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে শ্রমের মাধ্যমেই মানুষ সুস্থ ও সবল দেহ লাভ করে থাকে। শ্রম মানুষের সুস্থ ও সবল থাকার কার্যকর টনিক হিসেবে কাজ করে। অলসতা ও কর্ম বিমুখতা মানুষকে অসুস্থ ও অন্যায় পথে পরিচালিত করে।
বিশ্বনিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিশু জীবনে দুধমাতা হালিমার গৃহ থেকে শুরু করে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র জীবনই কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করে গেছেন। যার নমুনা তুলে ধরা হলো-
>> হজরত হালিমা সাদিয়ার গৃহে তিনি নিরবে নিভৃতে দুধভাই আবদুল্লাহর সাথে ছাগল ও ভেড়া চড়াতেন। হাদিসে এসেছে, তিনি বলেছেন- "আল্লাহ দুনিয়াতে এমন কোন নবি পাঠাননি যিনি ছাগল ও ভেড়া চরাননি। তখন সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসুল! আপনিও? তিনি বলেন, হ্যাঁ! আমিও কয়েক কীরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল ও ভেড়া চরাতাম। (বুখারি)
>> যৌবনে চাচার সংসারের সহযোগিতায় ব্যবসায় আত্ম নিয়োগ করেন। এমনকি তিনি হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার ব্যবসায়ও শ্রম দিয়েছেন।
>> নবুয়ত প্রাপ্তির পর ইসলামের প্রচার ও প্রসারে কঠোর শ্রম দেন।
>> এমনকি হিজরতের পর মদিনার প্রায় মসজিদ নির্মাণে স্বশরীরে অংশ গ্রহণ করেন।
>> ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত করতে সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন।
>> যুদ্ধ জয়ের কৌশল হিসেবে পরিখা খননেও অংশ গ্রহণ করেন। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এর রকম অসংখ্য শ্রমের উদাহরণ রয়েছে।
শ্রম বিশ্বমানবতাকে দিয়েছেন সম্মান ও মর্যাদার আসন। শ্রমের মাধ্যমেই মানুষ প্রমাণ করেছেন যে, তাঁরা সৃষ্টির সেরা জীব। তাই আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি জগতের অসংখ্য সৃষ্টিকে মানুষের অধীন করে দিয়ে বলেন, ‘তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত-দিন, চন্দ্র ও সূর্যকে এবং নক্ষত্ররাজিও অধীন হয়েছে তাঁরই বিধানে। অবশ্যই এতে রয়েছে বুদ্ধিমান জাতির জন্য নিদর্শন এবং তিনি সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের বস্তু তোমাদের জন্য।’ (সরা নহল : আয়াত ১২-১৩)
শ্রমিকের মর্যাদা
ইসলাম শুধু শ্রমের মর্যাদাই নয় বরং শ্রমিকের মর্যাদাও নিশ্চিত করেছেন। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে ভিক্ষাবৃত্তি তথা অপরের কাছে চাওয়া থেকে নিষেধ করে শ্রমের মাধ্যমে সাবলম্বী হওয়ার উপদেশ প্রদান করেছেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেঁটে খাওয়া শ্রমিকদের সঙ্গে উত্তম আচরণের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, তোমরা যাদেরকে চাকর বলে ডাকো। তারা মূলত তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। সুতরাং যার ভাই তার অধীনস্থ হয়, সে যেন তাকে সেই জিনিস খেতে দেয়, সে নিজে যা খায়; সে যেন তাকে সে কাপড়ই পরিধান করায়, যা সে নিজে পরিধান করে এবং সে যেন তার ওপর এমন কোনো কাজের বোঝা চাপিয়ে না দেয়, যা তার জন্য অসহনীয় হয়। (বুখারি, মুসলিম)
শ্রমিকের শ্রমের সম্মানজনক ও ন্যায্য মজুরি দেয়ার নির্দেশও রয়েছে ইসলামে। হাদিসে শ্রমিকের মজুরি এমনভাবে নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে, যাতে সে মালিকের মতো পরিবার-পরিজন নিয়ে সুন্দরভাবে খেয়ে পড়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারে, সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারে, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা-সমানভাবে পেতে পারে।
‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না’ এই অসম নীতিকে ইসলাম সমর্থন করে না। শ্রমিকের কঠিন পরিশ্রমের পারিশ্রমিক প্রদানের ব্যাপারে বিশ্বনবি বলেছেন,‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার ন্যায্য মজুরি দিয়ে দাও।’ (ইবনে মাজা)
বুখারির বর্ণনায় এসেছে, ‘মহান আল্লাহ বলেন, ক্বিয়ামাতের দিন আমি তিন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হব-
১. যে আমার নামে কোনো চুক্তি করে তা বাতিল করেছে;
২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করেছে এবং
৩. যে শ্রমিকের দ্বারা পুরোপুরি কাজ আদায় করে নিয়েছে, কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করেনি।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এর চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই, যা মানুষ স্বহস্তে উপার্জনের মাধ্যমে ভক্ষণ করে।
পরিশেষে
শ্রম ও শ্রমিক দিবসে ইসলামের রীতি-নীতি ও বিধানের আলোকে দেশের সর্বোচ্চ মহল সরকার থেকে শুরু করে সমাজের প্রত্যেক দায়িত্বশীলের উচিত, শ্রমের মর্যাদা এবং শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায় করা। কারণ সমাজের সবচেয়ে দামী ও উপকারী শ্রেণী হচ্ছে শ্রমিক সমাজ। মানব সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতির চাকা ঘুরছে শ্রমিকদের হাতে। একটি টেকসই ও উন্নত সমাজ বিনির্মাণে সবাই শ্রমিকদের পরিশ্রমের কাছে ঋণী।
আল্লাহ তাআলা সমাজের সর্বস্তরের দায়িত্বশীলদেরকে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং তাদের অধিকার রক্ষা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস