বনি ইসরাইলের পরিচয়
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদের অনেক জায়গায় বনি ইসরাইলদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। বনি ইসরাইল নামে অনেক বড় আলাদা স্বতন্ত্র একটি সুরা নাজিল করেছেন। বনি ইসরাইলদে দান করেছেন অসংখ্য নিয়ামাত, যার উল্লেখ রয়েছে কুরআনে। তাই সংক্ষেপে বনি ইসরাইলের ঐতিহাসিক পরিচয় তুলে ধরা হলো-
আল্লাহ তাআলার প্রিয় নবি হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের বসবাস ছিল ইরাক সিরিয়া ও হিজাজে। তাঁর ঔরস থেকে সুপ্রসিদ্ধ দুটি বংশ ধারা নেমে এসেছে। যার প্রথমটি মিসরীয় স্ত্রী হজরত হাজেরার গর্ভে জন্মগ্রহণকারী হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর মাধ্যমে, যা বনি ইসমাইলন নামে পরিচিতি। আর দ্বিতীয়টি ইরাকী স্ত্রী হজরত সারার গর্ভে জন্মগ্রহণকারী হজরত ইসহাকের পুত্র হজরত ইয়াকুব ওরফে হজরত ইসরাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে। এ জাতি বনি ইসরাইল নামে পরিচিত। আর তৃতীয় স্ত্রী কাতুরার মাধ্যমে একটি বংশধারাও ছিল যা ব্যাপক পরিচিতি পায়নি।
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের পৈত্রিক নিবাস ছিল ইরাক। তাঁর পৌত্র হজরত ইয়াকুবের ছেলে হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম ঘটনাচক্রে কুদরাতিভাবে মিসরে গমন করেন। একপর্যায়ে তিনি মিসরের শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন। মিসরের দুঃসময়ে সফল শাসক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে। হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম পিতা হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামকে মিসরে নিয়ে আসেন। সে সুবাধে সেখানেই বনি ইসরাইলিরা অবস্থান করতে থাকে। সুদীর্ঘ চারশত বছর বনি ইসরাইলিরা মিসরে শাসনকার্য পরিচালনা করে।
পরবর্তীতে মিসরের শাসনভার চলে যায় ফিরাউনদের হাতে। এ ফিরাউন নামক মিসরের শাসকরা ছিল জালিম। বনি ইসরাইলদের উপর তারা নিয়মিত কঠোর অত্যাচার-নির্যাতন চালাতো। ফিরাউন নামধারী সর্বশেষ শাসক এক দুঃস্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার পর বনি ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ফিরাউন। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যদি বনি ইসরাইলিদের ঘরে কোনো পুত্র সন্তান জন্ম নেয় তবে তাকে তৎক্ষনাৎ হত্যা করা হবে। কারণ তার এ বিশ্বাস জন্মেছিল যে, বনি ইসরাইলের কোনো সাহসী সন্তানের হাতেই তার পতন ঘটবে। এ অনিবার্য পতন ঠেকাতেই ফিরাউন এমন পাশবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল।
আল্লাহর মহাকুদরত এ ফিরাউনের ঘরেই লালিত-পালিত হন বনি ইসরাইলের সন্তান পয়গাম্বর মুসা আলাইহিস সালাম। কালের আবর্তে এক সময় মুসা আলাইহিস সালাম ফিরাউনের মুখোমুখি হন। নির্যাতিত বিন ইসরাইলিদের ফিরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত করতে সবাইকে সংঘঠিত করেন। নিরাপত্তার জন্য তাদের নিয়ে হিজরত করেন। খবর পেয়ে ফিরাউন বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে পিছন থেকে ধাওয়া করেন। মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কুদরাতে লোহিত সাগর পাড়ি জমান। আর ফিরাউন সৈন্য-সামন্তসহ মুসা আলাইহিস সালামের পিছু নিলে সমুদ্রের মধ্যে দলবলসহ সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়। অবশেষে মুসা আলাইহিস সালাম মিসরের একটি দ্বীপ ভূমি সিনাই অঞ্চলে বনি ইসরাইলদেরকে নিয়ে আশ্রয় নেয়। এখানেই শুরু হয় বনি ইসরাইলদের কাল যাপন।
পরিশেষে...
বনি ইসরাইলদের উত্থান বহু শতাব্দী ধরে অব্যাহত ছিল এবং তাঁরাই পৃথিবীতে তাওহিদের পতাকাবাহী ছিলেন। হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে হজরত ইসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত প্রায় চার হাজার নবি-রাসুল বনি ইসরাইল কাওমে প্রেরিত হয়েছেন। বহু নামি-দামি বাদশা, সেনাপতি ও রাষ্ট্র নায়ক বারবার জন্ম নিয়েছেন। এবং তাদের জন্য হিদায়েতের আলো নিয়ে এসেছেন অসংখ্য নবি-রাসুল। যারা স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ইরাক-মিসর-হিজাজ এবং সর্বশেষ ইয়াছরিব তথা মদিনার পাশ্ববর্তী অঞ্চলে আবাদ এবং বসতি করেছিল। আর বনি ইসরাইল হলো তাদের বংশীয় পরিচয়। ধর্ম মতে তারা ছিল ইয়াহুদি কিতাবি।
শেষ নবি ও রাসুল আগমনের পূর্ব পর্যন্ত বিকৃত হলেও তাওরাত তাদের মাঝে বিদ্যমান ছিল। ওহি ও নবুয়তের ধারা এবং শান্তি ও শাস্তির পুরষ্কার বিষয়ে তারা বিশ্বাসী ছিল। ফলে শেষ সময়ের মানুষরাও জাগতিক-ধর্মীয় উভয় ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদেরকে শেষ ভরসা মনে করতো।
এমনকি আরবের মুশরিক সম্প্রদায়ও বনি ইসরাইলিদের রীতি, চরিত্র, ধর্ম ও আক্বিদা বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং বহু ক্ষেত্রে তারা তাদেরকেই আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করতো। সর্বোপরি তাদের ধর্মগ্রন্থ যদিও বিকৃত ছিলো তথাপিও শেষ নবি ও রাসুলের আগমন সংবাদও তাদের বর্ণনা ও কল্পকাহিনীতে উঠে এসেছিল। যার অপেক্ষায় ছিল গোটা আরব ভুখণ্ড।
এমএমএস/এমএস