উচ্চারণসহ সুরা লাহাবের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব
সুরা লাহাব। ইসলাম ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণকারী কোনো ব্যক্তির নামে নাজিল হওয়া একমাত্র সুরা এটি। কোরআনুল কারিমের ৫ আয়াত বিশিষ্ট ১১১তম সুরাটি মাসাদ নামেও পরিচিত। সুরাটিতে রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও ইসলাম বিদ্বেষীদের জন্য শিক্ষা।
অর্থ ও উচ্চারণসহ সুরা লাহাব
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ
‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।
تَبَّتۡ یَدَاۤ اَبِیۡ لَهَبٍ وَّ تَبَّ
‘তাব্বাত ইয়াদা আবি লাহাবিউ ওয়াতাব্ব।’
ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুই হাত এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক।
مَاۤ اَغۡنٰی عَنۡهُ مَالُهٗ وَ مَا کَسَبَ
‘মা আগনা আ’নহুমালুহু ওয়ামা কাসাব।’
তার ধন-সম্পদ এবং যা সে অর্জন করেছে তা তার কোনো কাজে আসবে না।
سَیَصۡلٰی نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ
‘সাইয়াসলা নারাং যাতা লাহাব।’
অচিরেই সে নিমজ্জিত হবে লেলিহান আগুনে।
وَّ امۡرَاَتُهٗ ؕ حَمَّالَۃَ الۡحَطَبِ
‘ওয়ামরাআতুহু; হাম্মা লাতাল হাতাব।’
এবং তার স্ত্রীও; যে ইন্ধন বহনকারিণী।
فِیۡ جِیۡدِهَا حَبۡلٌ مِّنۡ مَّسَدٍ
‘ফি ঝিদিহা হাবলুম্মিম মাসাদ।’
তার গলদেশে খেজুর আঁশের পাকানো রশি। (মাখরাজসহ বিশুদ্ধ উচ্চারণে সুরাটি শিখে নেওয়া জরুরি )
সুরার মূল বক্তব্য
যারা ইসলাম ও হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান আনে এবং তাঁর মহান আদর্শকে অনুসরণ ও অনকুরণ করে; তাদের জন্য দুনিয়া ও পরকালের সাফল্য সুনিশ্চিত। পক্ষান্তরে যারা ইসলাম ও প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে, বিশেষ করে বিশ্বনবিকে কষ্ট দেয়, কথা ও কাজে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করে, তাদের শাস্তি দুনিয়া ও পরকালে অবধারিত। সুরা লাহাবে সে দৃষ্টান্ত সুস্পষ্ট। এখনও যারা ইসলাম ও বিশ্বনবি সম্পর্কে বিদ্বেষ পোষণ করবে, তাদের দুনিয়া ও পরকালে ধ্বংস সুনিশ্চিত।
কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করার ফলে আবু লাহাবের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা ধ্বংস হওয়ার বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র সুরা নাজিল করে জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে আবু লাহাব, তার স্ত্রী ও সন্তানের (ওতবা) অনিবার্য ধ্বংস হয়েছিল। তাদের ধ্বংসের আগেই মহান আল্লাহ এ সুরা নাজিল করে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন।
সুতরাং সুরাটি মুসলিম উম্মাহর জন্য এক মহা সতর্কবার্তা। এখনও যারা ইসলাম, মুসলমান এবং বিশ্বনবিকে নিয়ে কটাক্ষ করে তাদের ধ্বংস সুনিশ্চিত।
সুরাটি প্রিয় নবির মোজেজা
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, সুরাটি যখন নাজিল হয়, তখন আবু লাহাবের স্ত্রী একটি পাথরখন্ড হাতে নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্যে বের হন। সে সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা শরিফের আঙিনায় বসা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু।
আবু লাহাবের স্ত্রীকে যুদ্ধাংদেহী ও কঠোর মনোভাব নিয়ে আসতে দেখে হজরত আবু বকর ভয় পেয়ে গেলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! সে হয়তো আপনাকে দেখে ফেলবে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না, সে আমাকে দেখতে পাবে না। এরপর তিনি কোরআনুল কারিমের এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন-
وَ اِذَا قَرَاۡتَ الۡقُرۡاٰنَ جَعَلۡنَا بَیۡنَکَ وَ بَیۡنَ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ حِجَابًا مَّسۡتُوۡرًا
আর তুমি যখন কুরআন পড় তখন তোমার ও যারা পরকালে বিশ্বাস রাখে না তাদের মধ্যে আমি এক অদৃশ্য পর্দা রেখে দেই।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ৪৫)
বাস্তবেও তাই ঘটলো। আল্লাহ তাআলা আবু লাহাবের স্ত্রীর চোখে কুদরতি আবরণ দিয়ে ঢেকে দিলেন। ফলে সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখতে পেলনা।
আবু লাহাবের স্ত্রী এসেই হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললো, জানতে পেরেছি, তোমার সঙ্গী নাকি কাব্যে আমার সমালোচনা করেছে। হজরত আবু বকর বললেন, না তিনি তা করেননি।
আবু লাহাবের স্ত্রী বলল, কোরাইশ জানে, আমি তাদের সর্দারের মেয়ে। একথা বলেই সে চলে গেল।
হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞসা করলেন, সে কি আপনাকে দেখিনি? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘না’, সে আমাকে দেখিনি। কারণ, ফেরেশতা আমাকে আড়াল করে রেখেছিল।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)
সুরাটির সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ
সুরাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহদোর চাচা আবু লাহাব ও তার স্ত্রী সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। সে নিজে ও তার স্ত্রী আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে যে আচরণ করেছে তাতে আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি অভিশাপ করেছেন। পাপাচারের কাজে তারা উভয়ে যা যা করেছে জাহান্নামেও তারা একে অপরকে শাস্তি প্রদানে সহযোগিতা করবে। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি এমনই অভিশাপ দিয়েছেন। এ কারণেই মহান আল্লাহ বলেন-
تَبَّتۡ یَدَاۤ اَبِیۡ لَهَبٍ وَّ تَبَّ
ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুই হাত এবং সে নিজেও।
আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আব্দুল উজ্জা। চমকদার গৌরবর্ণের কারণে তার ডাক নাম হয় আবু লাহাব। কারণ ‘লাহাব’ বলা হয় আগুনের লেলিহান শিখাকে, যার রং গৌরবর্ণ। সে অনুসারে আবু লাহাব অর্থ গৌরবর্ণ বিশিষ্ট। এই আবু লাহাব ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কট্টর শত্রু ও ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিল। সে নানাভাবে প্রিয় নবিকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করত।
হজরত রাবিআ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অন্ধকার যুগে যুল-মাআজ বাজারে দেখলাম। তিনি বলছিলেন, হে মানব সম্প্রদায় ! তোমরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা ‘ বলো; সফলকাম হবে। আর মানুষ তাঁর চারপাশে ভিড় জমাচ্ছিল। তাঁর পেছনে এক গৌরবর্ণ, ট্যারা চোখবিশিষ্ট সুন্দর চেহারার লোক (আবু লাহাব) বলছিল, এ লোকটি ধর্মত্যাগী, মিথ্যেবাদী। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের প্রচারে যেখানে যেখানে যেতেন এ লোকটি (আবু লাহাবও) সেখানেই পিছনে পিছনে যেত। তারপর আমি লোকদের জিজ্ঞাসা করলে লোকেরা বলল, এ লোকটি তাঁরই সহোদর চাচা ‘ (মুসনাদে আহমদ)
مَاۤ اَغۡنٰی عَنۡهُ مَالُهٗ وَ مَا کَسَبَ
তার ধন-সম্পদ এবং যা সে অর্জন করেছে তা তার কোনো কাজে আসবে না।
আবু লাহাবের সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি তার কোনো কাজে আসেনি। তার ছেলে ওতবাকে সিরিয়ার পথে বাঘে খেয়ে ফেলেছিল। আবু লাহাব বদরের যুদ্ধের ৭ দিন পর বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়। তার পুরো দেহে পচন ধরে। সংক্রামক ব্যাধির কারণে তার আত্মীয়-স্বজন তাকে জীবিত অবস্থায় নির্জনে ফেলে দেয়। মৃত্যুর পর ৩ দিন পর্যন্ত তার লাশ পড়ে থাকে। কেউ তার লাশ ধরেনি। অবশেষ হাবশি ক্রীতদাসরা তাকে মাটি চাপা দিয়ে দেয়। তার দুঃসময়ে তার সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি কোনো কিছুই তার কাজে আসেনি।
سَیَصۡلٰی نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ - وَّ امۡرَاَتُهٗ ؕ حَمَّالَۃَ الۡحَطَبِ
অচিরেই সে নিমজ্জিত হবে লেলিহান আগুনে। এবং তার স্ত্রীও; যে ইন্ধন বহনকারিণী।
আবু লাহাব অচিরেই জাহান্নামে নিক্ষেপিত হবে এবং তার স্ত্রীও। আবু লাহাবের স্ত্রীর নাম ছিল ‘আরওয়া’। সে ছিল হারব ইবনে উমাইরার কন্যা। তাকে ‘উম্মে জামিল’বলা হতো। আবু লাহাবের মতো তার স্ত্রীও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিদ্বেষী ছিল। সে এ ব্যাপারে তার স্বামীকে সাহায্য করতো। আরবের বাক পদ্ধতিতে পেছনে নিন্দাকারীকে ‘হাত্বাব’ বা খড়িবাহক বলা হতো।
তাছাড়া আবু লাহাবের স্ত্রী প্রিয় নবিকে অনেক কষ্ট দিত। তার চলার পথে কাঁটাযুক্ত খড়ি বিছিয়ে দিতো। তার এ হীন কাজের কারণে কোরআনে তাকে হাম্মা লাতাল তাত্বাব বলে সম্ভোধন করা হয়েছে। তার স্থানও জাহান্নাম।
সে জাহান্নামে খড়ি এনে তার জাহান্নামী স্বামীর ওপর নিক্ষেপ করবে, যাতে আগুন আরও প্রজ্বলিত হয়ে উঠে। যেমন দুনিয়াতেও সে তার স্বামীকে কুফুর ও জুলুমের কাজে ইন্ধন যোগাত। পরিণামে আল্লাহ তাআলা এ নারীকে ‘খড়ি বহনকারী’ বলে অপমানজনক উপাধী দিয়ে উপহাস করেছেন। (তাফসিরে তাবারি, ইবনে কাসির)
فِیۡ جِیۡدِهَا حَبۡلٌ مِّنۡ مَّسَدٍ
তার গলদেশে খেজুর আঁশের পাকানো রশি।
হজরত সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিলের গলায় সব সময় একটি মূল্যবান হার থাকতো; সে দম্ভ প্রকাশ করে বলতো- মোহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরোধিতা এবং শত্রুতা সাধনে আমি এই মূল্যবান হার ব্যয় করবো। হয়তো এ কারণেই জাহান্নামে তাকে এমন শাস্তি দেওয়া হতে পারে। আর গলায় রশির টান বা ফাঁস লেগেই তার মৃত্যুও হয়েছিল।
সুরাটির গুরুত্ব
সুরাটি দুইটি কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে সুরাটিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শত্রুদের শাস্তি ঘোষণা করা হয়েছে। আবার অন্যদিকে সুরাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত ও রেসালাতের সত্যতার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। কেননা আবু লাহাব, তার স্ত্রী ও সন্তান (ওতবা) প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে শত্রুতার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করেছে।
মনে রাখতে হবে
যারা বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করেছে বা ভবিষ্যতে করবে; তাদের সবার জন্যই ভয়াবহ পরিণতি অবশ্যম্ভাবী। চাই সে দেড় হাজার বছর আগের আবু লাহাব, তার স্ত্রী ও সন্তানই হোক আর বর্তমান সময়ের ইসলাম, মুসলমান ও বিশ্বনবির সঙ্গে শত্রুতা পোষণকারী হোক। কারণ শত্রুতা পোষণে তাদের কার্ম যেমন এক ও অভিন্ন; তাই শাস্তি এবং ধ্বংসও হবে এক ও অভিন্ন।
পক্ষান্তরে...
সৌভাগ্য তাদের যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামর আনীত বিধান ও রেসালাতের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও অনুসরণ করে। তাদের জন্যই রয়েছে সুসংবাদ ও মুক্তি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুরা লাহাবের শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। ইসলাম ও রেসালাতে পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম