দুনিয়ায় একবার শাস্তি পেলে কি পরকালে আবার সাজা পাবে?

ধর্ম ডেস্ক
ধর্ম ডেস্ক ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৩৮ পিএম, ০৬ আগস্ট ২০২১

যদি কেউ কুরআনে ঘোষিত শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে আর দুনিয়াতে সে অপরাধের শাস্তি কার্যকর করা হয়; তবে পরকালেও কি ওই ব্যক্তিকে একই অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হবে? এ সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?

‘না’; কুরআনের হদযোগ্য কোনো অপরাধের শাস্তি যদি দুনিয়ায় যথাযথভাবে দেওয়া হয় তবে পরকালে ওই অপরাধের শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে। একই অপরাধে দ্বিতীয়বার সাজা ভোগ করার কোনো সম্ভাবনা নেই। কুরআনের শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধের বিচার করা হলে পরকালে এ অপরাধের শাস্তি পুনরায় হবে কিনা বিষয়টি নিয়ে হাদিসে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে।

কোনো ব্যক্তি গোনাহের কারণে বা কোনো অপরাধের কারণে যদি ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক শাস্তি পায় বা কোনো কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তির সম্মুখীন হয় তবে তার ওই অপরাধের গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। ওই ব্যক্তি শাস্তি পাওয়ার কারণে নির্ধারিত পাপ কাজের পরকালীন শাস্তি থেকেও মুক্তি পাবে। এ কথার সমর্থনে হাদিসে এসেছে-

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ তাআলা যখন তাঁর বান্দার কল্যাণ চান তখন দুনিয়াতে তার শাস্তি ত্বরান্বিত করেন, আর যখন কোনো বান্দার অকল্যাণ চান তখন তার পাপগুলো জমা রেখে কেয়ামতের দিন তাঁর প্রাপ্য (শাস্তি/সাজা) পূর্ণ করে দেবেন।’ (তিরমিজি)

শাস্তি ক্ষমা হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে হাদিসের বর্ণনা

কুরআনে ঘোষিত শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধের শাস্তি যদি কুরআন-সুন্নাহর বিধান ও দিকনির্দেশনা অনুযায়ী দেওয়া হয় তবে ওই বান্দা পরকালে বিচার হওয়া অপরাধের শাস্তি দ্বিতীয়বার ভোগ করবে না। কেননা এক ব্যভিচারী র শাস্তি কার্যকর করার পর প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে গোনাহ থেকে মুক্ত বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। হাদিসে এসেছে-

১. হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা যখন তাঁর কোনো বান্দার কল্যাণ চান তখন তাড়াতাড়ি দুনিয়াতে তাকে বিপদে (অপরাধের শাস্তিতে) নিক্ষেপ করেন। আর যখন তিনি তাঁর কোনো বান্দার অকল্যাণ চান তখন তাকে তার অপরাধের শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। তারপর কেয়ামাতের দিন তিনি তাকে পরিপূর্ণ শাস্তি দেন।’ (তিরমিজি)

পাপ বা অপরাধের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক ধরনের শাস্তি নেমে আসে। উল্লেখিত হাদিস সম্পর্কে শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ কিছু দিকনির্দেশনামূলক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন-

> ‘অনেক সময় মানুষের এই শাস্তি হয় রোগ ব্যাধি;

> কখনো সন্তানের মৃত্যু;

> কখনো দারিদ্রতা;

> কখনো সম্পদ বিনষ্ট;

> কখনো অন্যান্য কঠিন বিপদ-মুসিবত দ্বারাও বড় বড় অপরাধের শাস্তি হয়ে যায়। আর এসব শাস্তির দ্বারা আল্লাহ তাআলা বান্দার গোনাহ ক্ষমা করে দেন। সেই সঙ্গে এসব বিপদের বিনিময়ে তাকে উৎসাহিত করেন যেন সে বিপদে-মুসিবতে সবর ও সওয়াবের প্রত্যাশা করে।’

. হাদিসের অন্য বর্ণনায় এসেছে- ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বিপদ যত মারাত্মক হবে, প্রতিদানও তত বড় হবে।’ (কেননা) আল্লাহ তাআলা যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন তখন তাদের (বিপদে ফেলে) পরীক্ষা করেন। যে লোক তাতে (বিপদে) সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য (আল্লাহ তাআলার) সন্তুষ্টি বিদ্যমান থাকে। আর যে লোক তাতে অসন্তুষ্ট হয় তার জন্য (আল্লাহ তাআলার) অসন্তুষ্টি বিদ্যমান থাকে।’ (ইবনে মাজাহ)

৩. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক নারী সাহাবির শাস্তিযোগ্য অপরাধের শাস্তি দিয়ে তার তাওবাহ কবুল হয়েছে মর্মে ঘোষণা দিয়েছিলেন। হাদিসে এসেছে-

এক নারী সাহাবি রাসুলু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, আমি জিনা (ব্যভিচার) করেছি। জিনার  কারণে গর্ভবর্তী হয়েছি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, তুমি চলে যাও। সন্তান হলে এবং তার দুধ পান করানোর সময় শেষ হলে এসো। যখন তার সন্তানের দুধ পানের মেয়াদ শেষ হলো, তখন সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, তোমার এ সন্তানকে কারো দায়িত্বে দিয়ে দাও। যখন সে তার সন্তানকে অন্য একজনের দায়িত্বে রেখে আসলেন, তখন তাকে (অপরাধের শাস্তি হিসেবে) পাথর নিক্ষেপে হত্যার নির্দেশ দেয়া হলো। তার জন্য বুক সমান গভীর একটি গর্ত করা হলো এবং তাকে সেখানে দাঁড় করিয়ে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হলো। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জানাজার নামাজ পড়ালেন।

হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি তার জানাজা নামাজ পড়ালেন? এতো ব্যভিচারিনী। (এ কথা শুনে) তিনি বললেন, (হে ওমর!) এ নারী এমন তাওবাহ করেছে; তা যদি দুনিয়াবাসীর মধ্যে ভাগ করে  দেয়া হয়; তবে তা সবার জন্য যথেষ্ট হবে। এর  চেয়ে বড় আর কি হতে পারে যে, সে (আল্লাহর ভয়ে) নিজের জীবন দিয়ে দিল।’ (মুয়াত্তা মালেক)

অনুরূপভাবে কেউ যদি দুনিয়াতে কোনো অপরাধ করার পর ইসলামি আদালতের মাধ্যমে শাস্তিপ্রাপ্ত হয় তাহলে তা পরকালে তার জন্য কাফফারা (গোনাহ মোচনের মাধ্যম) হয়ে যায়। ফলে সেখানে তাকে এই অপরাধের কারণে পুনরায় শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে না। হাদিসের অন্য বর্ণনায় এসেছে-

হজরত উবাদা ইবনু সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমরা নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ছিলাম, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি এসব শর্তে আমার কাছে বায়আত করবে যে, তোমরা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করবে না, জিনা করবে না এবং চুরি করবে না? এরপর তিনি নারীদের শর্ত সম্পর্কিত আয়াত পাঠ করলেন-

إذا جاءك المؤمنات يبايعنك

(হে নবী!) মুমিন নারীগণ যখন আপনার কাছে এ মর্মে বায়আত করতে আসে।’

তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন-

তোমাদের যে ব্যাক্তি এ সব শর্ত পূরণ করবে, আল্লাহ তার প্রতিদান দেবেন। আর যে ব্যাক্তি এ সবের কোনো একটি করে ফেলবে এবং তাকে (দুনিয়াতে) শাস্তিও দেয়া হবে। তবে এ শাস্তি তার জন্য কাফফারা হয়ে যাবে। আর যে ব্যাক্তি এ সবের কোনো একটি করে ফেলল এবং আল্লাহ তা গোপন রাখলেন, তাহলে এ বিষয়টি আল্লাহর কাছে রইল। তিনি চাইলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন অথবা তাকে ক্ষমাও করে দিতে পারেন।’ (বুখারি, )

সুতরাং উল্লেখিত হাদিসের আলোকে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, কোনো ব্যক্তির যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধের শাস্তি দুনিয়াতে যথাযথভাবে করা হয় তবে সে ওই অপরাধের বিষয়ে নিষ্পাপ হয়ে যাবে। পরকালে আল্লাহ তাআলা তাকে শাস্তি দেবেন না। আর আল্লাহ তাআলা অনেককে দুনিয়াতে সাধারণ গোনাহগুলো অনেককে বিপদ-মুসিবত, রোগ-ব্যধি ও কষ্টের মাধ্যমে মোচন করে দেন। আবার চাইলে তিনি যে কাউকে ক্ষমাও করে দিতে পারেন।

তাই কেউ যদি নিজের পাপাচার ও অন্যায় কাজের শাস্তি  দুনিয়াতে পেয়ে যায় তাহলে এটা তার জন্য কল্যাণকর। কেননা দুনিয়ার শাস্তি লাভের পর সে গোনাহমুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু যার শাস্তি পরকালের জন্য জমা রাখা হয়; নিঃসন্দেহে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।

আল্লাহ তাআলা মুমিন মুসলমানকে শাস্তিযোগ্য সব অপরাধ থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। দুনিয়ার সাধারন সব গোনাহসহ সব বড় গোনাহের শাস্তি দুনিয়াতে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ক্ষমা পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/জিকেএস

 

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।