উচ্চারণসহ সুরা ফাতিহার আমল ও বৈশিষ্ট্য
সুরা ফাতিহা। একসঙ্গে নাজিল হওয়া পূর্ণাঙ্গ সুরা। এ সুরাটি মানুষের অন্যতম দোয়া ও শেফা। সুরা ফাতিহার আমলে রয়েছে চমৎকার ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য। সুরাটি বিশুদ্ধভাবে শেখার সুবিধার্থে উচ্চারণসহ এর আমল ও ফজিলতগুলো তুলে ধরা হলো।
সুরা ফাতিহার বিশেষত্ব
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত পাপ্তির শুরুর দিকেই সুরা ফাতিহা একসঙ্গে নাজিল। নামাজের জন্য এ সুরাটি পড়া বাধ্যতামূলক। এ সুরাটি পড়া ছাড়া নামাজ হয় না।
সুরাটি মুমিন মুসমানের জন্য সব ধরনের দোয়া। এ কারণেই কুরআন পড়া শুরু করলেই সবাইকে এ সুরাটি দিয়েই শুরু করতে হয়। এটি এক দিকে যেমন উম্মুল কুরআন। আবার এটি কুরআনের ভূমিকাও বটে।
সুরা ফাতিহার আমলের বৈশিষ্ট্য
সুরা আল-ফাতিহা সব রোগের মহৌষধ। এ সুরার আমলের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সুরা ফাতিহার আমলের অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলো হলো-
> হজরত জাফর সাদেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, সুরা ফাতিহা ৪০ বার পাঠ করে পানির ওপর দম করে কোনো জ্বরে আক্রন্ত লোকের মুখমণ্ডলে ছিঁটিয়ে দিলে, এ সুরার বরকতে আল্লাহ তাআলা জ্বর দূর করে দেন।
> ফজরের সুন্নত ও ফরজ নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে ৪১ বার সুরা ফাতেহা পড়ে চোখে ফুঁ দিলে চোখের ব্যাথা দূর হয়।
> শেষ রাতে সুরা ফাতিহা ৪১ বার পড়লে আল্লাহ তাআলা বান্দার রিজিক বাড়িয়ে দেন।
> ৪০ দিন নিয়মিত সুরা ফাতিহা পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে অসুস্থ ব্যক্তিকে পান করালে আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তির অসুস্থতা দূর করে দেন। কেউ কেউ সুরাটি গোলাপ, জাফরান এবং কস্তুরি দিয়ে চিনির রেকাবিতে লিখে তা পানি দ্বারা ধুয়ে ৪০ দিন পান করালেও রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
> দাঁতের ব্যথা, পেটের ব্যথা, মাথা ব্যথার জন্যে ৭ বার এ সুরা পাঠ করে দম করলেই আল্লাহ তাআলা এসব ব্যথা দূর করে দেন।
সুরা ফাতিহার প্রমাণিত আমল
সুরা ফাতিহার আমল প্রমাণিত। যে কোনো রোগে এ সুরার আমল কার্যকরী। হাদিসের বর্ণনায় এসেছে-
> হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, (একবার) সাহাবাদের একটি দল (পানির জন্য) এক পানির কুপওয়ালার কাছে গেলেন। তাদের (সে সময় কুপওয়ালাদের) একজনকে বিচ্ছু অথবা সাপে দংশন করেছিল।
কুপওয়ালাদের এক ব্যক্তি এসে বলল, আপনাদের মধ্যে কোনো মন্ত্র জানা লোক আছে কি? এ পানির ধারে বিচ্ছু বা সাপে দংশন করা একজন লোক আছে।
সাহাবাদের মধ্য থেকে একজন (হজরত আবু সাঈদ খুদরি) গেলেন এবং কয়েকটি ভেড়ার বিনিময়ে তার উপর সুরা ফাতিহা পড়ে ফুঁ (দম করলেন) দেন। এতে সে (সাপ কিংবা বিচ্ছুর দংশনে আক্রান্ত ব্যক্তি) ভাল হয়ে গেল এবং তিনি ভেড়াগুলো নিয়ে সঙ্গীদের কাছে আসলেন।
তারা (সাহাবারা) এটা অপছন্দ করল এবং বলতে লাগল, আপনি কি আল্লাহর কিতাবের বিনিময় গ্রহণ করলেন?
অবশেষে তারা মদিনায় পৌঁছে বিশ্বনবিকে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনি আল্লাহর কিতাবের বিনিময় গ্রহণ করেছেন।
তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা যেসব জিনিসের বিনিময় গ্রহণ করে থাক, তার মধ্যে আল্লাহর কিতাব অধিকতর উপযোগী।’ (বুখারি)
> অন্য বর্ণনায় আছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমরা ঠিক করেছ। ছাগলের একটি ভাগ আমার জন্য রাখ।' (বুখারি ও মুসলিম)
সুরা ফাতিহার উচ্চারণ ও অনুবাদ
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।
الْحَمْدُ للّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য। যিনি সব সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।
الرَّحْمـنِ الرَّحِيمِ
যিনি নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু।
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ
যিনি বিচার দিনের মালিক।
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য চাই।
اهدِنَــــا الصِّرَاطَ المُستَقِيمَ
আমাদেরকে সরল পথ দেখাও,
صِرَاطَ الَّذِينَ أَنعَمتَ عَلَيهِمْ غَيرِ المَغضُوبِ عَلَيهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ
সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।
সুরা ফাতিহর গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য
মুমিন মুসলমানের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ কুরআনি দোয়া ও আমল হচ্ছে সুরা ফাতিহা। আল্লাহ তাআলা এ সুরায় নিজের ও বান্দার মধ্যে সব করণীয় ভাগ করে নিয়েছেন। তাই সুরা ফাতিহা ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করাও সম্ভব নয়। এ সুরার গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিসের একাধিক বর্ণনা রয়েছে-
> হজরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ উম্মুল কুরআনের মতো তাওরাত ও ইঞ্জিলে কিছু্ নাজিল করেননি। এটিকেই বলা হয়, ‘আস-সাবউল মাছানি’ (যা বারবার পঠিত সাতটি আয়াত), যাকে আমার ও আমার বান্দার মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। আর আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, সে যা চাইবে’। (নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ)
> হজরত সাঈদ ইবনে মুআল্লা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, তিনি মসজিদে নামাজ আদায় করছিলেন, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ডাকলেন। কিন্তু তিনি তাঁর ডাকে সাড়া দেননি। অতপর নামাজ শেষ হলে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমি নামাজ পড়ছিলাম।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ কি বলেননি? ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ডাকে সাড়া দাও, যখন তোমাদের ডাকা হয়।’ (সুরা আনফাল : আয়াত ২৪)
অতঃপর আমাকে বললেন, মসজিদ থেকে তোমার বের হওয়ার আগেই আমি তোমাকে অবশ্যই কুরআনের সবচেয়ে মহান সুরাটি শিখিয়ে দেব। তারপর তিনি আমার হাত ধরলেন। যখন তিনি মসজিদ থেকে বের হতে চাইলেন, তখন আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, আপনি কি আমাকে বলেননি যে, তোমাকে আমি কুরআনের সবচেয়ে মহান সুরাটি শিখিয়ে দেব?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সুরাটি হচ্ছে- الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ । এটিই সাবউল মাছানি এবং কুরআনুল আজিম। যা আমাকে দেয়া হয়েছে।' (নাসাঈ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)
- হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিবরিল আলাইহিস সালাম উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ জিবরিল আলাইহিস সালাম ওপর দিকে একটি শব্দ শুনতে পেলেন এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ হচ্ছে আকাশের একটি দরজা যা আগে কখনো খোলা হয়নি।
সে দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হলেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, ‘আপনি দুটি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন। যা আপনাকে প্রদান করা হয়েছে। তা আপনার আগে আর কোনো নবিকে দেয়া হয়নি। তাহলো-
- সুরা ফাতেহা এবং
- সুরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত।
আপনি সে দু’টি থেকে কোনো অক্ষর পড়লেই তার প্রতিদান আপনাকে প্রদান করা হবে।’ (মুসলিম, ইবনে হিব্বান)
সুতরাং আমল-ইবাদত ও রোগ-মুক্তিতে মুমিন মুসলমানের উচিত, সুরা ফাতিহার আমলে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা। বিশুদ্ধভাবে সুরা ফাতিহা শিখে নেয়া। কেননা সুরা ফাতিহা ছাড়া নামাজ হয় না। আর তা নামাজের প্রতিটি রাকাআতে পড়তে হয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুরা ফাতিহার তেলাওয়াত ও আমলের মাধ্যমে অসুস্থতা ও সমস্যা থেকে মুক্তির পাশাপাশি সুরাটি যাবতীয় ফজিলত ও বরকত লাভ করার তাওফিক দান করুন। সুরার হক অনুযায়ী ইবাদত ও সাহায্য প্রার্থনার করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমকেএইচ