সুখী জীবন পেতে যেসব আমল খুবই জরুরি
সুন্দর ও সফল জীবনের জন্য শিষ্টাচার তথা উত্তম গুণাবলীর বিকল্প নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে এমন অনেক উপদেশ দিয়েছেন। যেসব উপদেশ ও শিষ্টচার অনুযায়ী জীবন-যাপন করলে ব্যক্তি পরিবার সমাজ জীবনের সবক্ষেত্রে মানুষ ভোগ করবে উন্নত ও সুখী জীবন।
ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে যদি কেউ আধুনিক, নব্য, নবীন, জীবন্ত, বুদ্ধিমান, তীক্ষ্ন, সার্থক, সক্রিয়, কার্যকর এবং স্মার্ট হতে চায় তবে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষিত শিষ্টাচারগুলো অনুসরণ করা একান্ত আবশ্যক।
তাই ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনকে সুন্দর করতে, সুখী-সমৃদ্ধি পরিবার পেতে, উত্তম গুণাবলীর মাধ্যমে সমাজ ও দেশ গড়তে বিশ্বনবি নির্দেশিত উত্তম গুণগুলো মেনে চলি। তাহলো-
> হাসি খুশি থাকা
সব সময় চেহারায় উজ্জ্বলতার ভাব বজায় রাখতে মুখে মিষ্টি হাঁসি বজায় রাখা। হাদিসে এসেছে, ‘সব মুখে মিষ্টি হাঁসি বজায় রাখা। প্রাণোচ্ছল থাকা। কথা বলার সময় হাসিমুখে কথা বলা। চরম (বিপদের) মুহূর্ত ছাড়া চেহারায় গোমরা-দার্শনিক-মেজাজি ভাব আনা থেকে নিজেকে বিরত রাখা।’ (ইবনে মাজাহ)
> রাগ দমন করা
সব সময় রাগ-ক্রোধ দমন করা সর্বোত্তম গুণ। রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারাই সবচেয়ে বড় বীরত্বপূর্ণ কাজ। রাগের ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে-
- ‘রাগ দমন করা। রাগী চেহারা গোপন করা। চরম মুহূর্ত ছাড়া তা কাউকে রাগের বিষয়টি বুঝতে না দেয়া।’ (ইবনে মাজাহ)
- ‘রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাগের অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলে বসে যাওয়া। বসে থাকলে শুয়ে পড়া। তারপরও রাগ না কমলে দেরি না করে ওজু করে নেয়া। অর্থাৎ যেভাবেই হোক রাগকে দমন করা জরুরি।’ (আবু দাউদ)
> রাস্তার হক আদায় করা
রাস্তায় চলাচলের সময় যদি তাতে সমস্যা সৃষ্টিকারী কিংবা চলাচলে বাধাদানকারী কোনো কষ্টদায়ক জিনিস পড়ে থাকে তা সরিয়ে দেয়া। তা হতে পারে, কলার খোসা, ইট-পাথর, কাঁটা ও কাঁটা জাতীয় ময়লা বস্তু ইত্যাদি।’ (বুখারি)
> শত্রুতা পরিহার করা
কোনো কাজেই কারো সঙ্গে শত্রুতা বা দুশমনি না করা। এটি মানবতার জন্য মারাত্মক অপরাধ। বরং শত্রুতার পরিবর্তে হেদায়েত ও রহমতের দোয়া করা। কেউ গালি বা খারাপ কথা বললে কিংবা ক্ষতি –অপকার করলে প্রতিশোধের চিন্তা না করা। বরং ক্ষতিকারীর জন্য হেদায়েতের দোয়া করা। (সিরাতে বিশ্বনবি)
> সালামের ব্যাপক প্রচার করা
ইসলামের প্রধান ও অন্যতম অভিভাদন সালামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটানো। সালাম দেয়ার সময় শব্দগুলো পূর্ণ ও সুস্পষ্টভাবে বলা। কথা বলার আগে সালাম দেয়া। পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেয়া। সালামের উত্তম দেয়ার সময় এক শব্দ বাড়িয়ে বলা। (আবু দাউদ, মুসলিম)
> বড়দের সম্মান করা
বড়দের সঙ্গে আচরণের শিষ্টাচার বজায় রাখা খুবই জরুরি। বয়সে বড়দের সর্বদা সম্মান করা। সবক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া। রাস্তায় চলাচলে, যানবাহনে উঠতে-নামতে তাদের আগে সুযোগ দেয়া। কিছু পড়ে গেলে তা ওঠিয়ে দেয়া। তাদের সঙ্গে উঁচু স্বরে কথা না বলে আস্তে ও মার্জিত ভাষায় কথা বলা। তাদের সঙ্গে বিরক্তি প্রকাশ না করা। ভদ্রভাবে আদব রক্ষা করে চলা।’ (তিরমিজি)
> অনুষ্ঠানে ভদ্রতা বজায় রাখা
বাসা-বাড়ি, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা-মসজিদসহ গুরুত্বপূর্ণ সভা, সমিতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়া, ওয়াজ-মাহফিল ইত্যাদিতে একে অন্যের সঙ্গে শিষ্টাচার বজায় রাখা। কাউকে অতিক্রম করে কিংবা কারো ঘাড় টপকিয়ে না যাওয়া। যেখানে স্থান সংকুলান হয় সেখানেই অবস্থান করা।’ (ইবনে খুজায়মা)
> হাই-হিকাপে সতর্ক হওয়া
কারো সামনে যদি কোনো ব্যক্তির হাই-হিকাপ আসে তবে তা রোধ করা অথবা বাম হাতের পিঠ দিয়ে তা রোধ করা। উচ্চ বা বিরক্তিকর শব্দ করা থেকে বিরত থাকা।’ (বুখারি)
> হাঁচি আসলে সুন্নাতের অনুসরণ করা
কারো হাঁচি আসার পর যদি সে আল্লাহর প্রশংসা করে তবে তার জন্য দোয়া করা।
> দাঁড়ি ও গোঁফ রাখায় সতর্ক হওয়া
দাঁড়ি ছেড়ে দেয়া আর গোফ ছেঁটে ছোট রাখা। দাঁড়ি এক মুষ্টির চেয়ে বড় করা সুন্নাত। আর কমপক্ষে এক মুষ্টি দাড়ি রাখা প্রত্যেক পুরুষের জন্যই ওয়াজিব বা আবশ্যক। অন্যথায় গোনাহ হবে। এ সম্পর্কে মাজহাব ও সালাফি মানহাজের সব আলেমই একমত।
> জুতা-মোজা পরায় শিষ্টাচার
জুতা বা মোজা পড়ার ক্ষেত্রে শিষ্টাচার বজায় রাখা। এক পায়ে জুতা মোজা আর এক পা খালি রাখা থেকে বিরত থাকা।’ (মুসলিম) জুতা ও মোজা বসে পরা এবং খোলা। প্রয়োজনে অন্তত হাঁটু গেড়ে হলেও জুতা-মোজা পরা যেতে পারে।’ (আবু দাউদ)
> বাড়িতে প্রবেশে অনুমতি নেয়া
অন্যের ঘরে-বাড়িতে প্রবেশের সময় সালাম দেয়া। নিজের পূর্ণ পরিচয় দেয়া। প্রবেশের অনুমতি নেয়া। তার পর প্রবেশ করা। (বুখারি)
অন্য কারো ঘরে-বাড়িতে প্রবেশের আগে সালাম, দরজায় শব্দ বা যে কোনো পদ্ধতিতে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে প্রবেশ করাও আবশ্যক। অনুমতি ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করে ইসলামে নিষেধ। এমনকি তা যদি বাবা-মা, ভাই-বোনের ঘরও হয়। তাতেও অনুমতি নেয়া।
> উঁকি না দেয়া
কারো ঘরে উঁকি দেয়া থেকে বিরত থাকা জরুরি। কারো ঘরে থাকাবস্থায় অন্য যে কোনো রুমের দিকে তাকানো থেকে বিরত থাকা, গায়রে মাহরাম নারী/পুরুষ একসঙ্গে এক ঘরে একাকি অবস্থান করা থেকে বিরত থাকা।’ (মুসলিম)
> শিশুদের স্নেহ করা
ছোট শিশুদের ভালোবাসা, স্নেহ করা। শিশুদের পছন্দ করা। তাদের সঙ্গে খেলাধূলা করা। শিশুদের সঙ্গে কখনো রাগ না করা। তাদের যখন-তখন বকা না দেয়া। খেলার ছলে ভুল সংশোধন করে দেয়া এবং উত্তম আদব শেখানো।’ (বুখারি)
> পশু-প্রাণীর যত্ন নেয়া
সাধ্যমত পশু-পাখি ও পোষা কিংবা অন্য যে কোনো প্রাণীর যত্ন নেয়া। এদের খাবার দেয়া। সম্ভব হলে থাকার ব্যবস্থা করা। নাসাঈ) নিজেদের খাবারের উচ্ছিষ্ট, হাড়-কটা কুকুর বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণীর জন্য রেখে দেয়া।
> অন্যকে সাহায্য করা
অপরের প্রয়োজনে একে অন্যকে সাহায্য করা। প্রতিবেশীর যে কোনো প্রয়োজন পূরণ করা। হোক না সেটা সামান্য লবন-মরিচ কিংবা তেল-চিনি। সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাইন অন্যের প্রয়োজন পুরণে সব সময় সুযোগ গ্রহণ করতেন। আর আমরা এর থেকে পালাতে চাই।’ (তিরমিজি)
> দান ও ঋণ প্রদানে উৎসাহিত করা
কাউকে দান কিংবা উত্তম ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে একে অপরকে উৎসাহিত করা। দান ও উত্তম ঋণ দেয়ার মাধ্যমে দানের ফজিলত সঞ্চয় করা। নিজের সামর্থ না থাকলেও অন্যকে যথাসম্ভব ঋণ দেয়া। পরিমাণ সামান্য হলেও দান করা।’ (মুসনাদে আহমাদ)
> উত্তম কথা বলা
কারো সঙ্গে কথা বলার সময় অন্যের দিকে খেয়াল রাখা। কারো কথা বলার মাঝখানে কথা না বলা। একজনের কথা শেষ হলে শিষ্টাচার মেনে কথা বলা। কারো কথা শেষ না হলে কথা থেকে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন না করা। (ফোনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) কথা শোনার ক্ষেত্রেও তা-ই।’ (আবু দাউদ)
> দোয়া করা
দোয়া করার ক্ষেত্রে শিষ্টাচার বজায় রাখা জরুরি। দোয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই আল্লাহর প্রশংসা করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরূদ পড়া। তারপর নিজের বাবা-মা, পরিবার-পরিজন আত্মীয়-স্বজন, সব মুমিন নারী-পুরুষের জন্য দোয়া করা। দোয়া শেষ করার সময়ও আল্লাহর প্রশংসা করা এবং দরূদ পড়া।
> পথ চলায় সতর্ক হওয়া
রাস্তায় চলার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়িয়ে নিরাপদ স্থানে দাঁড়ানো। চলাচলের সময় অন্যকে পথ চলতে সহায়তা করা। কারো গতিপথ রোধ না করা। কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে তার গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা না দিয়ে ভদ্রভাবে পথ দেয়ার কথা বলা। কোনোভাবেই রাস্তাজুড়ে চলাচলের পথ বন্ধ না করা। অন্যকে পথ চলতে সাহায্য করা।’ (মুসনাদে আহমাদ)
মুমিন মুসলমানের উচিত, উল্লেখিত গুণাবলী নিজেদের মধ্যে তৈরি করা। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে উত্তম পরিবেশ তৈরি করা।
আল্লাহ তাআলা সবাইকে উল্লেখিত উত্তমগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজেদের সুখী জীবন লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমকেএইচ