অপবাদের ঘটনায় হজরত আবু বকরের উদারতা
উদারতা দেখানো ও ক্ষমার অনন্য দৃষ্টান্ত ইসলাম। কুরআনের বর্ণনায় উদারতা দেখানো এবং ক্ষমা অনন্য সব ঘটনা উঠে এসেছে। যা যুগ যুগ ধরে বিশ্বমানবতার জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে। মানুষের প্রতি উদারতা বা দয়া দেখানো অনেক বড় কল্যাণকর কাজ। এ কাজে মহান আল্লাহ বান্দার গোনাহ ক্ষমা করে দেন। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
وَلَا يَأْتَلِ أُوْلُوا الْفَضْلِ مِنكُمْ وَالسَّعَةِ أَن يُؤْتُوا أُوْلِي الْقُرْبَى وَالْمَسَاكِينَ وَالْمُهَاجِرِينَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلْيَعْفُوا وَلْيَصْفَحُوا أَلَا تُحِبُّونَ أَن يَغْفِرَ اللَّهُ لَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
‘তোমাদের মধ্যে যারা উচ্চমর্যাদা ও আর্থিক প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন কসম না খায় যে, তারা আত্নীয়-স্ব জনকে, অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর পথে হিজরতকারীদেরকে কিছুই দেবে না। তাদের ক্ষমা করা উচিত এবং দোষক্রটি উপেক্ষা করা উচিত। তোমরা কি কামনা কর না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়।' (সুরা নুর : আয়াত ২২)
আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে ক্ষমা করে দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করার আগে মানুষের প্রতি উদার হতে, দয়া দেখাতে নসিহত পেশ করেছেন। সম্পদশালী ব্যক্তিদের প্রতি এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন যে, তারা যেন তাদের অধীনস্ত, গরিব কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যারা অভাবগ্রস্ত তাদের কোনো কিছু না দেয়ার ব্যাপারে কসম না করে। যে নসিহত করেছেন হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে। আল্লাহ বলেন-
‘আর তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদাবান, প্রাচুর্যের (অর্থবিত্তের) মালিক, তারা যেন এমন শপথ না করে বসে যে, তারা নিকটাত্মীয়, মিসকিন ও আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের কিছুই দেবে না। তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ ত্রুটি উপেক্ষা করে।’
অর্থাৎ এসব গরিব, মিসকিন, হিজরতকারী কিংবা নিকটাত্মীয়রা যদি কোনো অন্যায় বা দোষ করে বসে; তবে তাদের অন্যায় বা দোষকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার নসিহত করা হয়েছে এ আয়াতে। ফলে তাদের জন্য থাকবে মহান রবের পক্ষ থেকে বিশেষ ক্ষমা। কেননা আল্লাহ তাআলা বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন-
‘তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেন? আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।’
অর্থাৎ আয়াতের এ অংশে মহান আল্লাহ সমাজে মর্যাদাশীল ও স্বচ্ছল ব্যক্তিদের এ মর্মে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন যে, উল্লেখিত ব্যক্তিদের ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে, তাদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করা কিংবা দয়া দেখানোর মাধ্যমে তোমরা কি মহান রবের ক্ষমা লাভ করতে চাও না?
মানুষের প্রতি উদারতা দেখাতে আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার প্রতি অপবাদ দেয়ার পর যখন সবার তাওবাহ কবুল করা হয়; তখন এ আয়াতটি নাজিল করা হয়। ঘটনাটি ছিল এমন-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার প্রতি অপবাদের ঘটনায় জড়িত ছিলেন বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দুই সাহাবি হজরত মিসতাহ ও হাসসান রাদিয়াল্লাহু আনহুমা। অনিচ্ছাকৃতভাবে তাদের দ্বারা এ ভুলটি হয়ে যায়।
অপবাদের বিষয়ে আয়াত নাজিল হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ওপর অপবাদের শাস্তি প্রয়োগ করেন। তাঁরা খাঁটি মনে তাওবাহ করেন।
আল্লাহ তাআলা হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে নির্দোষ ঘোষণা ও দুই সাহাবির তাওবাহ কবুল করে তাদের ক্ষমা করারও ঘোষণা দেন।
প্রসঙ্গত অপবাদ দেয়া সাহাবি হজরত মিসতাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর আত্মীয় এবং আর্থিকভাবে নিঃস্ব। তিনি তাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতেন।
নিজ মেয়ে হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার প্রতি অপবাদ দেয়ার ঘটনায় বাবা হিসেবে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সাহাবি ও আত্মীয় মিসতাহ’র প্রতি ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিলেন।
হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু কসম করে বসলেন- ‘ভবিষ্যতে তাকে কোনোরূপ আর্থিক সাহায্য করবেন না।’ যদিও কোনো বিশেষ অভাবি ব্যক্তিকে আর্থিক সাহায্য করা নির্দিষ্টভাবে কোনো মুসলিমের জন্য আবশ্যক নয়।
কেউ যদি কোনো অভাবি ব্যক্তিকে আর্থিক সাহায্য দেয়ার পর তা কোনো সময় বন্ধ করে দেয়, তাতে গোনাহও হবে না।
কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবাগণ আল্লাহর কাছে যেমন বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত আবার তারা বিশ্বমানবতার জন্য আদর্শবাদী দল হিসেবেই তাদের প্রেরণ করেছেন।
তাই একদিকে অপবাদকারীদের খাঁটি তাওবাহ এবং ভবিষ্যতে সংশোধনের নিয়ামত দান আর অপরদিকে যারা মিথ্যা অপবাদের ঘটনায় মনে কষ্ট পেয়ে গরিব আত্মীয়-স্বজনকে সাহায্য না করতে কসম করেছিলেন; তাদের উভয়কেই আদর্শ চরিত্রবান ও বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয় শিক্ষা ও আদর্শ হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াসে আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাজিল করেন।
আয়াতের শিক্ষা
যারা দান না করার ব্যাপারে কসম করেছেন, তারা তাদের কসমের কাফফারা দিয়ে পুনরায় দান সহযোগিতা করবেন। কেননা দান-সহযোগিতা থেতে হাত গুটিয়ে নেয়া তাদের উচ্চ মর্যাদার পরিচয় বহন করে না; আর তা তাদের জন্য সমীচীনও নয়।
আল্লাহ যেহেতু তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন, তাই মনে কষ্ট পাওয়া ব্যক্তিদেরও উচিত, তাদের ক্ষমা করে দেয়া। আর এর বিনিময়ে মহান আল্লাহ তাদেরও ক্ষমা করবেন মর্মে আয়াতের শেষাংশে এভাবে জানতে চান-
‘তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তাআলা তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করবেন?’
এ আয়াতটি শুনে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু অনেক বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন। নিজের মর্যাদা নিয়ে গেছেন অনেক উচ্চতায়। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেছেন-
‘হ্যাঁ’, আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই চাই আমার রব আমাকে ক্ষমা করুন।’ তার তিনি মিসতাহ’র প্রতি আর্থিক সাহায্য পুনরায় বহাল করে নেন এবং বলেন- ‘এ সাহায্য কোনোদিন বন্ধ হবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম, তাফসিরে কুরতুবি)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহসব বিশ্বমানবতার সবাইকে নিকটাত্মীয়, গরিব-অসহায়দের প্রতি উদারতা কিংবা দয়া দেখানোর তাওফিক দান করুন। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার তাওফিক দান করুন। আল্লাহর ক্ষমা লাভে নিজেদের তৈরি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমকেএইচ