পরকীয়া ঠেকাতে ১০ নির্দেশনা
বর্তমান সময়ে এক মহামারির নাম পরকীয়া। বিবাহবহির্ভূত এমন অবৈধ সম্পর্কের কারণে সংসারে অশান্তি-ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি জঘন্য হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হচ্ছে। পুরুষ-নারী উভয়কেই পরকীয়ায় জড়িত থাকতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেক মানুষ স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের জন্য পরিবার থেকে দূরে থাকে। ফলে অনেক সময় তাদের স্ত্রী পরকীয়া, অবৈধ সম্পর্ক ও যেনা-ব্যভিচারে জড়িত হয়ে পড়ে।
স্ত্রী থেকে দূরে থাকা স্বামীর বিরুদ্ধেও একইরকম অভিযোগ আছে। এমনকি স্বামী-স্ত্রী দু’জনে কাছাকাছি থেকেও তাদের ‘মনের দূরত্ব’ এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। মানুষ কীভাবে যেনা-ব্যভিচার ও পাপাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করবে? এ থেকে বেঁচে থাকতে পুরুষ-নারীদের করণীয়ই বা কী?
ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ সবার জন্য পরকীয়া ও যেনা-ব্যভিচার অত্যন্ত জঘন্য গোনাহের কাজ। এটি কবিরা গোনাহ, মারাত্মক দণ্ডনীয় অপরাধ এবং ঘৃণিত কাজ। ইসলামে দণ্ডনীয় যত শাস্তি আছে, এরমধ্যে যেনা-ব্যভিচার তথা পরকীয়ার শাস্তিই সবচেয়ে কঠিন ও মারাত্মক।
সাক্ষ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে এ অপরাধের দুটি শাস্তি। একটি হলো- অবিবাহিত অপরাধীর জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগে ১০০ বেত্রাঘাত ও এক বছরের জন্য নির্বাসন তথা জেল। আর বিবাহিত অপরাধীর জন্য পাথর নিক্ষেপে মৃত্যু নিশ্চিত করা।
সুতরাং পুরুষ-নারী যেই পরকীয়ায় লিপ্ত হবে সে গোনাহগার হওয়ার পাশাপাশি শাস্তিযোগ্য অপরাধে অপরাধী বলে গণ্য হবে।
পরকীয়া থেকে বিরত রাখতে ১০ দিকনির্দেশনা
শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামিক স্কলারদের মতামতের ভিত্তিতে মারাত্মক অপরাধ পরকীয়া, যেনা-ব্যভিচার থেকে নিজেদের রক্ষা করতে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা।
>>স্বামীর সঙ্গে থাকা
স্ত্রী যদি প্রবল আশঙ্কা করে যে, স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে না বা যেনা-ব্যভিচার ও পাপাচারে জড়িয়ে পড়বে; তাহলে শরিয়তের দৃষ্টিতে স্বামীর কাছে তার এ দাবি করার অধিকার আছে যে-
-হয় সে (স্বামী) তাকে (স্ত্রীকে) সঙ্গে করে বিদেশে নিয়ে যাবে। অথবা
-স্বামী তাকে রেখে একাকী বিদেশ বা দূরের সফর থেকে বিরত থাকবে।
কারণ বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো নিজের ইজ্জত-সম্ভ্রম হেফাজত করা এবং গোনাহের কাজ থেকে নিজেকে রক্ষা করা।
>>খোলা তালাক নেয়া
স্বামী যদি স্ত্রীর দাবি, একসঙ্গে থাকার পরামর্শ বা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে দূরে কোথাও গমন করে তাহলে স্ত্রীর জন্য ‘খোলা তালাক’ নেয়া জায়েজ আছে। এতে স্বামীর দূরে অবস্থানের কারণে বিয়ের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় এবং নারীর ঈমান ও চরিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনার আশঙ্কাই বেশি।
-খোলা তালাক : কোনো কিছুর বিনিময়ে স্ত্রী নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়াই হলো খোলা তালাক। এক্ষেত্রে স্বামী সে বিনিময়টি গ্রহণ করে স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন করে (তালাক) দেবে। এ বিনিময় হতে পারে স্বামীর দেয়া মোহরানার টাকা কিংবা এর চেয়ে বেশি সম্পদ কিংবা কম।
>>আমল করা
যাদের স্বামী দূরে থাকে তাদের জন্য যদি উল্লিখিত কোনোটিই সম্ভব না হয় তবে-
- ধৈর্যধারণ করবে,
- নিয়মিত নফল রোজা রাখবে; বিশেষ করে সোম ও বৃহস্পতিবার এবং আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের আইয়্যামে বিজের রোজা রাখা। এবং
- কুরআন তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন, ইসলামিক জ্ঞানার্জন, সাংসারিক ও অন্যান্য উপকারী কাজকর্মসহ নিজেকে ইবাদত বন্দেগি ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করা।
>>স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা
নিয়মিত স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে একে অপরের প্রতি সুসম্পর্ক ও ভালোবাসা অটুট রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখা।
>>অশ্লীল বিনোদন পরিহার করা
নাটক, সিনেমা, গান-বাজনা, অশ্লীলতা ও অসৎসঙ্গ তথা যৌন উত্তেজক সব মাধ্যম থেকে নিজেকে দূরে রাখা। কারণ যৌন উত্তেজক এসব বিষয়গুলো মানুষের মনে কু-প্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনার আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং তা থেকে বিরত থাকা খুবই জরুরি।
>>গায়রে মাহরাম থেকে দূরে থাকা
মাহরাম নয়, এমন পরপুরুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ না রাখা। কেননা চারিত্রিক নির্মলতা ও মানসিক পবিত্রতা রক্ষায় এটি খুবই জরুরি।
বিশেষ করে স্বামীর অনুপস্থিতিতে-
স্বামীর বা নিজের নিকটাত্মীয় তথা- দেবর, ভাসুর, চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, মামাতো ভাই, খালাতো ভাই, ভগ্নিপতি (দুলাভাই) বেয়াই ইত্যাদি ব্যক্তিকে নিজ ঘরে প্রবেশের সুযোগ না দেয়া। প্রয়োজন না থাকলে যোগাযোগ তথা দেখা-সাক্ষাৎ না করাই উত্তম।
একান্তই প্রয়োজন হলে, পরিপূর্ণ পর্দার সঙ্গে সামনে না এসে পেছন থেকে কথা বলা। কথা বলার ক্ষেত্রে হাসাহাসি, আবেগ ও কোমল কণ্ঠ পরিহার করাও আবশ্যক।
>>ফেতনা থেকে দূরে থাকা
গায়রে মাহরাম তথা যাদের সঙ্গে দেখা করা হারাম, সেসব পুরুষের সঙ্গে হাসি, দুষ্টুমি, হাতাহাতি, সামনা-সামনি খেলাধুলা, স্পর্শ এবং বিনা প্রয়োজনে দৃষ্টিপাত, কথাবার্তা, ফোনালাপ, মেসেজিং, ভিডিও চ্যাটিংসহ কোনো জিনিস-পত্র আদান প্রদান থেকে দূরে থাকা আবশ্যক।
কেননা এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ফেতনা সংঘটিত হয়। আর এর মাধ্যমেই পরকীয়া, যেনা-ব্যভিচার ও পাপাচারের মতো মারাত্মক অপরাধের বীজ অঙ্কুরিত হয়।
>>বিশ্বস্ত নারীর সঙ্গে থাকা
শয়তানের কুমন্ত্রণা ও কু-প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বাঁচতে যেসব স্ত্রীর স্বামীরা পরিবার হতে দূরে অবস্থান করে তাদের একাকী কোথাও বসবাস না করাই ভালো। যাদের সন্তান আছে, তারা সন্তানদের সঙ্গে রাখবে। সন্তান না থাকলে সম্ভব হলে মা, বোন, বোনের মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ে, ননদ, শাশুড়ি, মা, বাবা কিংবা আপনসহ নিকটাত্মীয় নারীদের সঙ্গে থাকা উত্তম।
>>অযথা বাইরে না যাওয়া
ঘর কিংবা বাসার বাইরে না যাওয়া। একান্ত প্রয়োজনে কাছাকাছি বাইরে যাওয়ার দরকার হলে, পূর্ণাঙ্গ পর্দার সঙ্গে বের হওয়া এবং যথাযথ দায়িত্ব পালন করা। বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো বেশি খেয়াল রাখা জরুরি। তা হলো-
-কোনোভাবেই সুগন্ধি ব্যবহার না করা। যা মানুষকে আকর্ষণ করে।
-এমন সাজসজ্জা গ্রহণ না করা যাতে পরপুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়।
-হাত, মুখমণ্ডল ও পা ঢেকে রাখা।
-বোরকা ও হিজাব চাকচিক্যপূর্ণ না হওয়া।
>>আল্লাহকে ভয় করা
সর্বোপরি মহান আল্লাহকে বেশি বেশি ভয় করা। যেনা-ব্যভিচার, পাপাচার ও পরকীয়ার জন্য দুনিয়ার শাস্তির পাশাপাশি পরকালের জাহান্নামের শাস্তির কথা অন্তরে জাগ্রত রাখা। স্ত্রী অথবা স্বামীর আবেগ ও ভালোবাসাপূর্ণ কথাগুলো বেশি বেশি স্মরণ করা এবং প্রিয় মানুষটি ও নিজের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।
বিবাহিত ও অবিবাহিত সব মুমিন-মুমিনা পুরুষ-নারীদের উচিত কুরআন সুন্নাহ নির্দেশিত শৃঙ্খলিত জীবন যাপন করা। আল্লাহর সাহায্য কামনা করা।
আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মাহর সব বিবাহিত ও অবিবাহিত পুরুষ-নারীর পরকীয়া, যেনা-ব্যভিচার ও পাপাচার থেকে হেফাজত থাকতে ইসলামি দিকনির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণে নিজেদের ইসলামি জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম