জামেউল কুরআন হজরত ওসমান


প্রকাশিত: ০৮:৫০ এএম, ১৮ অক্টোবর ২০১৫

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর যাঁরা ইসলামকে আল্লাহর জমিনে সুন্দরভাবে উম্মাহর সামনে পেশ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে হজরত ওসমান অন্যতম। তিনি ছিলেন ইসলামে তৃতীয় খলিফা। যেমন ছিলেন দানশীল, তেমনি ছিলেন লজ্জাশীলতায় সর্বকালীন দৃষ্টান্তের মূর্তপ্রতীক। সর্বোপরি আল্লাহর বিধানের প্রতি ছিলেন সুগভীর অনুরক্ত। জাগো নিউজে তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো-

জন্ম ও পরিচয় : মক্কায় হস্তিবাহিনীর আক্রমণের ছয় বছর পর হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু ৫৭৩ মতান্তরে ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মক্কার ঐতিহ্যবাহী কুরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর উপনাম ছিল আবু আমর, আবু আবদিল্লাহ, আবু লায়লা। তাঁর বাবা ছিলেন আফফান এবং আরওয়া বিনতে কুরাইশ ছিলেন তা মা। তিনি কুরাইশ বংশের উমাইয়্যা শাখার সন্তান ছিলেন। তার উর্ধ্ব পুরুষ (৫ম স্তরে) আবদে মান্নাফে গিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

প্রাথমিক জীবন : অত্যন্ত সুদর্শন হজরত ওসমানের জীবনের প্রাথমিক ইতিহাস খুব সামান্যই সংরক্ষিত আছে। যতটুকু জানা গেছে, জাহিলি যুগে জন্ম হলেও জাহিলিয়্যাতের বীভৎসতা তাঁর চরিত্রকে বিন্দুমাত্র কলুষিত করতে পারেনি। ইসলাম গ্রহণের আগে হানিফ আঙ্গিনার লোকদের মধ্যে তিনি ছিলেন আরবের মুষ্টিমেয় শিক্ষিতদের একজন এবং কুরাইশ বংশের অন্যতম কুস্তিবিদ্যাবিশারদ। বংশীয় আভিজাত্যের ধারায় যার যৌবন কেটেছে ব্যবসায়। তাইতো তিনি সর্বোচ্চ সততা ও বিশ্বস্ততার দরুন পেয়েছিলেন অল্প সময়েই অসাধারণ সাফল্য।

ইসলাম গ্রহণ : হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর উৎসাহে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তাঁর বয়স ত্রিশের কোটায়। তিনি নিজেই বলেছেন, `আমি ইসলাম গ্রহণকারী চারজনের মধ্যে চতুর্থ।` হজরত আবু বকর, হজরত আলী ও জায়েদ বিন হারিসের পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। কুরাইশ বংশের অত্যন্ত সম্মানিত ও বিত্তবান হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কাফিরদের অমানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তাঁর চাচা ‘হাকাম ইবনে আবিল আস’ ইসলাম ত্যাগের জন্য তাঁকে রশি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করত আর বলত, যতক্ষণ ইসলাম ত্যাগ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাকে ছাড়া হবে না।`

বিবাহ : ইসলাম গ্রহণের পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কন্যা রুকাইয়্যার সঙ্গে তার বিয়ে দেন। দ্বিতীয় হিজরিতে তাবুক যুদ্ধের পরপর হজরত রুকাইয়্যা মারা গেলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয় কন্যা হজরত উম্মে কুলসুমকে তাঁর সঙ্গে বিয়ে দেন। এ কারণেই তাঁকে ‘যুন্‌নূরাইন’ও বলা হয়।

হিজরত : সীমাহীন নির্যাতনে জর্জরিত মুশরিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হজরত উসমান এবং রুকাইয়্যা ছিলেন প্রথম হিজরতকারী মুসলিম পরিবার। তারা প্রথম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। তারপর হাবশায় দুই বছর অবস্থানের পর তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে মদিনায় হিজরত করেন। সে কারণে তাঁকে `যুল্‌হিজরাতাইন’ও বলা হয়।

উপাধি ও বৈশিষ্ট্য : দুনিয়াতেই পেয়েছেন জান্নাতের সুসংবাদ। ব্যবসায়ী ওসমান বিপুল ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্যের কারণে `গনি` উপাধি লাভ করেন। এছাড়া তিনি যুন্‌নূরাইন এবং যুল্‌হিজরাতাইন উপাধিতেও ভূষিত ছিলেন। গভীর মমতা, সহনশীলতা, আত্মমর্যাদাবোধ, দান ও লজ্জা ছিল তাঁর মহৎ চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যার ফলে সেই ৬ জন সাহাবির মধ্যে অন্যতম তিনি, যাদের উপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমরণ সন্তুষ্ট ছিলেন।

যেভাবে খলিফা হলেন : ছুরিকাহত হয়ে হজরত ওমর মৃত্যুশয্যায় থাকাকালীন সময়ে মৃত্যুর পরবর্তী তিনেদিনের মধ্যে খলিফা নির্বাচনের জন্য হজরত আলী, হজরত ওসমান, হজরত আবদুর রহমান, হজরত সাদ, হজরত তালহা ও হজরত যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুম-এ ছয়জনের নাম ঘোষণা করে যান। তাঁরা ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবা। খলিফা নির্বাচনী সভায় এ ছয়জনের মধ্যে ছয়টি ভিন্ন ভাগের সৃষ্টি হয়। অবশেষে হজরত যুবাইর হজরত আলীকে সমর্থন করেন। হজরত তালহা হজরত ওসমানকে সমর্থন করেন। হজরত সাদ হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফকে সমর্থন করে প্রথম দিনের বৈঠক শেষ করেন।
ইতোমধ্যে হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফের পেরেশানি বেড়ে গেল। তিনি হজরত আলীর কাছে গিয়ে হজরত আলীকে খলিফা ঘোষণার প্রস্তাব করেন। পরবর্তী দিন সম্পদ ও সম্মানের প্রতি ভিত, বিনম্র ও শ্রদ্ধাশীল হজরত আলী ঘোষণা দিলেন- খিলাফতের গুরুদায়িত্ব আমার জন্য অনেক বড় বোঝা। গভীর পাণ্ডিত্য ও তাকওয়ার অধিকারী হজরত ওসমানই খিলাফতের যোগ্য উত্তরসূরি। তিনিই আমাদের খলিফা। তিনিই হজরত ওমরের উত্তরসূরি। পরে সবাই তার হাতে বাইআত গ্রহণ করেন।

শাসনামল : বিপুল ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্যের মালিক হজরত ওসমান মুসলিম জাহানের খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পরও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। হজরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তিনি মসজিদে নববিতে মাথার নিচে চাদর দিয়ে শুয়ে থাকতেন। মানুষের সঙ্গে সাধারণ মানুষের মতো কথা বলতেন।
তাঁর শাসনামলের প্রথমদিকে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য অর্জিত হয়। তাঁর জনহিতকর কার্যাবলী সমাজের আদল পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তিনি মদিনা শহর রক্ষায় `মাহরু` বাঁধ নির্মাণ করেন। কৃষিতে উন্নতির জন্য খাল খনন করেন। পয়ঃপ্রণালী ও রাস্তাঘাট নির্মাণসহ  মসজিদে নববির আধুনিকায়ন করেন তিনি। মদিনার ঘরে ঘরে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তাঁর সময়ে ইসলামী খিলাফত পূর্বে কাবুল ও বেলুচিস্তান এবং পশ্চিমে ত্রিপলী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। তিনি প্রথম নৌবাহিনী গঠন করে সাইপ্রাস ও রোডস দ্বীপপুঞ্জ মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আনেন। তাঁর সময়েই বাইজান্টাইন ও পারস্য শক্তির ঔদ্ধত্য নির্মূল করা হয়।

কুরআন সংকলন : বিশ্ব মুসলিমের জন্য সবচেয়ে বড় অবদান পবিত্র কুরআন সংকলন তিনিই করেছিলেন। হজরত হাফসার তত্ত্বাবধানে একটি উপযুক্ত কুরআন সংরক্ষণ কমিটি গঠন করে কুরআনের হিফাজতের দায়িত্ব দেন।
দানশীলতা : সমাজের দারিদ্র্য ও অসহায় মানুষের প্রতি হজরত ওসমান ছিলেন সর্বদা মুক্তহস্ত। মদিনায় বড় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে মদিনার ব্যবসায়ীরা হজরত ওসমানের বাড়িতে ভিড় জমান। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, `তোমরা আমাকে কী লাভ দেবে?` তাঁরা ১০ টাকা ক্রয় মূল্যের ওপর দুই টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিতে সম্মত হলেন। হজরত ওসমান বললেন, `আমি দশে দশ লাভ পেতে পারি।
অতঃপর তিনি ঘোষণা করলেন, ‘তোমরা সাক্ষী থাকো, আমি সব খাদ্যশস্য মদিনার অভাবি লোকদের সদকা করে দিলাম।` এভাবে সমাজের ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও অভাব দূর করতে তিনি তাঁর বিপুল ঐশ্বর্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন।
৬৩০ খ্রিস্টাব্দে হিরাক্লিয়াস মদিনার বিরুদ্ধে লক্ষাধিক সৈন্যের এক সুসজ্জিত বাহিনী প্রেরণ করলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধ প্রস্তুতিতে তহবিল সংগ্রহের ঘোষণা দেন, সে সময় হজরত ওসমান এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা, এক হাজার উট ও ৭০টি ঘোড়া সরবরাহ করেন।

বন্ধু ওসমান : আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে হজরত ওসমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মানবতার কল্যাণে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গকারী এ সাহাবি সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, `উসমান হলো তাঁদেরই একজন, যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে বন্ধু ভাবেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলও ওসমানকে বন্ধু ভাবেন।` তাইতো হজরত উম্মে কুলসুম মারা যাবার পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার যদি আরো একটি মেয়ে থাকত, তাহলে তাকেও আমি ওসমানের সঙ্গে বিয়ে দিতাম। একাধিকবার জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ওসমান সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, `প্রত্যেক নবীরই বন্ধু থাকে, জান্নাতে আমার বন্ধু হবে ওসমান।

ওফাত : খলিফার সরলতা, সহিষ্ণুতা ও উদারতার সুযোগে স্বার্থান্বেষী চক্র হজরত ওসমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে গেছেন, `আল্লাহ পাকের হিকমতানুসারে জুন্‌নুরাইনের ওপর মতানৈক্য দেখা দেবে এবং লোকেরা তাঁকে শহীদ করবে। অথচ তিনি তখন হকের ওপরই থাকবেন এবং তাঁর বিরোধীরা থাকবে বাতিলের ওপর।
রক্তপাতের সম্পূর্ণ বিরোধী হজরত ওসমানকে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন হিজরি ৩৫ সনের ১৮ জিলহজ্জ শুক্রবার আসরের নামাজের পর ৮২ বছর বয়সে বর্বরভাবে হত্যা করা হয় (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি ১২ দিন কম ১২ বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। হজরত জুবাইর ইবনে মুতইম তাঁর জানাজায় ইমামতি করেন। জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে দাফন করা হয়।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবির রূহানি ফায়েজ ও বরকত দান করুন। আমিন।

এমএমএস/আরআইপি


পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।