মহামারী করোনা থেকে আত্মরক্ষায় ইসলামের নির্দেশনা ও আমাদের করণীয়
মাহমুদ আহমদ : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ২৬ হাজার ৩শ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং ৪ হাজার ৬৩৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বিশ্বের ১২৪টি দেশ ও অঞ্চলে করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র চীনের মূল ভূখণ্ডেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ হাজার ৭৯৬ এবং মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ১৬৯ জনের।
চীনের পর করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ইতালিতে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১২ হাজার ৪৬২ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে ৮২৭ জনের। এছাড়া এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ৬৮ হাজার ২৮৫ জন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তাই এ বিষয়ে ভয় না পেয়ে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা আবশ্যক।
আমরা কেউ আজ এ কথা বলতে পারি না যে, আমরা বা আমাদের দেশ ঐশী কোনো আজাব থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ। অন্যায় কৃতকর্মের মাত্রা আজ এতটাই ছাড়িয়েছে যে, পুরো শরীর যেন পাপে ভরপুর। আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি যাই করছি না কেন সব কিছুতেই যেন অসৎকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। এমনকি মুখে যা বলছি তাও মিথ্যা বলছি, আল্লাহর ভয়ে দুই রাকাআত যে নামাজ আদায় করছি সেখানেও দুনিয়ার চিন্তায় মগ্ন, কখন নামাজ শেষ করব আর বাহ্যিকতায় মত্ত হব।
তাই এই যে একের পর এক রোগব্যাধি ও ঐশী আজাবের সম্মুখীন হচ্ছি এর মূল কারণ হচ্ছে- আমার কৃতকর্মই এসবকে আহ্বান জানাচ্ছে। যেভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-
‘মানুষের কৃতকর্মের জন্যই স্থলে ও জলে বিশৃঙ্খলা ছেয়ে গেছে। এর পরিণামে তিনি তাদের কোন কোন কর্মের শাস্তির স্বাদ তাদের ভোগ করাবেন, যাতে তারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।’ (সুরা রূম : আয়াত ৪১)
যেহেতু আমাদের পাপ সর্বত্র ছেয়ে গেছে, তাই বিভিন্ন প্রাকৃতিক আজাব তা- করোনা ভাইরাসের আক্রমণ বলুন বা ঘূর্ণিঝড় সিডর, বুলবুল বা ভূমিকম্প তা সবই মূলত আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সতর্ক সংকেত। আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করছেন যে, তোমরা সহজ সরল পথ অবলম্বন কর। তাই আমরা ব্যক্তি জীবনে যে কাজই করিনা কেন তা যেন হয় সৎ।
বিষয়টিকে এভাবেও বলা যায়- সমাজ ও দেশের বেশির ভাগ মানুষ যখন পাপ, ব্যাভিচার, অন্যায় এবং নিজ প্রভুকে ভুলতে বসে তখনই আল্লাহ তাআলা তার পক্ষ থেকে কোপগ্রস্থ হয়ে শাস্তির যোগ্য হয়ে যায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন-
‘আর তোমাদের কৃতকর্মের কারণই তোমাদের ওপর বিপদ নেমে আসে। অথচ তিনি অনেক কিছুই উপেক্ষা করে থাকেন।’ (সুরা শুরা : আয়াত ৩০)
আজাবের এমন একটি দিক নেই, যেদিক দিয়ে আজ পৃথিবী আক্রান্ত হয়নি। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ বা এমন কোনো জাতি নেই যার ওপর আজাব না এসেছে; সে যত বড় শক্তিধর রাষ্ট্রই হোক না কেন। সব প্রকার আজাবের প্রবল আক্রমণ মরণাহত মানবের ওপর বারবার এসে আঘাত হানছে।
মানব প্রকৃতি বিকৃত হয়েছে। তার কারণে আল্লাহর রুদ্র রূপও প্রকাশিত হচ্ছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তিস্বরূপ যখন কোনো আজাব আসে তখন তা থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো রাস্তা থাকে না। যেভাবে কুরআনে উল্লেখ রয়েছে-
- ‘তুমি বল, আল্লাহর হাত থেকে কে তোমাদের রক্ষা করতে পারে, যদি তিনি তোমাদের কোনো শাস্তি দিতে চান? অথবা তিনি যদি তোমাদের প্রতি কৃপা করতে চান তবে কে এ থেকে তোমাদের বঞ্চিত করতে পারে? আর তারা নিজেদের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন অভিভাবক বা কোন সাহায্যকারীও খুঁজে পাবে না’ (সুরা আহজাব : আয়াত ১৭)
- ‘এসব জনপদের অধিবাসীরা কি এ ব্যাপারে নিরাপদ হয়ে গেছে যে, রাতের বেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় তাদের ওপর আমাদের শাস্তি নেমে আসবে না? আর এসব জনপদের অধিবাসীরা কি এ বিষয়ে নিরাপদ হয়ে গেছে যে, দুপুর বেলায় খেলাধুলায় মত্ত থাকা অবস্থায় তাদের ওপর আমাদের শাস্তি নেমে আসবে না?’ (সুরা আরাফ : আয়াত ৯৯-১০০)
মহান আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে কেন আজাব-গজব পাঠান সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করে আমাদেরকে সতর্ক করেছেন কিন্তু আমরা এ বিষয়ে উদাসীন। দিনের পর দিন আমরা পবিত্র কুরআনের শিক্ষার অমান্য করেই যাচ্ছি। আমাদের সবার একটি বিষয় অনুধাবন করা উচিৎ যে, পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক কেন বার বার আজাবের কথা উল্লেখ করলেন? আমরা যেন সব ধরনের আজাব বা ব্যাধি থেকে রক্ষা পাই সেজন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে দোয়াও শিখিয়েছেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে অধিকহারে এই দোয়া পড়া উচিত যে-
اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَ الْجُنُوْنِ وَ الْجُذَامِ وَمِنْ سَىِّءِ الْاَسْقَامِ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাছি ওয়াল জুনুনি ওয়াল ঝুজামি ওয়া মিন সায়্যিয়িল আসক্বাম।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনার কাছে আমি শ্বেত রোগ থেকে আশ্রয় চাই। মাতাল হয়ে যাওয়া থেকে আশ্রয় চাই। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে আশ্রয় চাই। আর দুরারোগ্য ব্যাধি (যেগুলোর নাম জানিনা) থেকে আপনার আশ্রয় চাই।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأَخْلاَقِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ وَ الْاَدْوَاءِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আমালি ওয়াল আহওয়ায়ি, ওয়াল আদওয়ায়ি।’
অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার কাছে খারাপ (নষ্ট-বাজে) চরিত্র, অন্যায় কাজ ও কুপ্রবৃত্তির অনিষ্টতা এবং বাজে অসুস্থতা ও নতুন সৃষ্ট রোগ-ব্যাধি থেকে আশ্রয় চাই।’ (তিরমিজি)
কোনো এলাকায় বা দেশে যদি কোনো মহামারি ছড়িয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ হল যে, সেখানকার অধিবাসী সে যেন অন্যত্র না যায়, এর ফলে অন্যত্রেও তা ছড়িয়ে যাওয়া সম্ভাবনা থাকে। যেমন হাদিসে এসেছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
‘যখন কোনো এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়ে তখন যদি তোমরা সেখানে থাকো তাহলে সেখান থেকে বের হবে না। আর যদি তোমরা বাইরে থাকো তাহলে তোমরা সেই আক্রান্ত এলাকায় যাবে না।’ (বুখারি, মুসলিম)
তাই আমাদেরকে এ বিষয়ে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
মহান আল্লাহ তাআলা যেহেতু রহমানুর রাহিম। তিনি চান না যে, তার বান্দারা যেন কোনভাবেই কষ্টে নিপতিত হন। তাই তিনি বারবার সতর্ক করছেন, তার বান্দারা যেন সঠিক পথে পরিচালিত হয়।
কিন্তু যখন কোনো জাতি তার নির্দেশাবলীর অমান্য করতে করতে সীমা ছাড়িয়ে যায় তখনই তার পক্ষ থেকে কোনো না কোনো শাস্তি নিপতিত হয় আর তা কখনো কখনো করোনা ভাইরাসের মতো মহামারি দিয়ে আবার কখনো ভূমিকম্প বা ঝড়ো বাতাস দিয়ে শাস্তির কবলে পড়ে।
এই যে সারা পৃথিবীতে একের পর এক ঘটনা ঘটছে আর শত শত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, এর একটাই কারণ, আর তা হলো, দয়াময় আল্লাহর বান্দারা আজকে সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে যেতে বসেছে। সব ধরণের ঐশী আজাব থেকে রক্ষার এখন একটিই মাত্র রাস্তা খোলা আছে আর তাহলো-
‘মহান আল্লাহ তাআলার প্রকৃত বান্দায় পরিণত হওয়া, আল্লাহর অধিকার এবং বান্দার অধিকার যথাযথ প্রদান করা, নিজকে সংশোধন করা এবং নিজ আত্মাকে পবিত্র করা।’
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বার বার সতর্ক করছেন এরপরও যদি আমরা সতর্ক না হই তবে আমরাও কি আদ ও সামুদ জাতিসহ অন্যান্য জাতিদেরকে যেভাবে তাদের অপকর্মের জন্য আল্লাহপাক ধ্বংস করেছেন, তারই আহ্বান করছি না তো?
তাই সময় থাকতে আমাদের দোষত্রুটির জন্য পরিপূর্ণভাবে আল্লাহপাকের কাছে তওবা করতে হবে। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তার আজাবের শাস্তি থেকে নিরাপদ রাখুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম