ক্ষতি থেকে বাঁচার চারটি উপায়
কত ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং জাতি সামান্য একটি ভুলের জন্য ধংস হয়ে গেছে, তার হিসাব কে বা কারা রেখেছে? এ ক্ষতির বস্তুটি হচ্ছে মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বা সময়। এ পার্থিব জীবনের পূঁজি ‘সময় বা মুহূর্ত’ বরফের ন্যায় গলে গলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আত্মীয়-স্বজনের বন্ধন, আপনজনদের ক্রন্দন, দুনিয়ার জাগতিক আয়োজন মানুষকে ধরে রাখতে পারবে না। এ সময়ে আখিরাতের সম্পদ আহরণের জন্য, মাটির নিচের ঈমানের সম্পদ ও আমল পাঠানোর তাগিদ দিয়েছেন। এ কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের জন্য নাজিল করেছেন কুরআনুল কারিমের শেষ দিকের (১০৩ নং) ছোট্ট একটি সূরা ‘সূরা আল আসর’। জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য সংক্ষিপ্তাকারে তা তুলে ধরা হলো-
আল্লাহ বলেন- وَالْعَصْرِ (1) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ (2) إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (3)
অর্থ : সময়ের কসম। মানুষ আসলে খুবই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তারা ছাড়া, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে এবং পরস্পরকে হক কথার উপদেশে দিয়েছে এবং সবর (ধৈর্য ধারণ) করার উপদেশ দিতে থেকেছে।
নামকরণ ও নাজিল- সূরার প্রথম আয়াত “আল আছর” শব্দটিকে এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সূরাটির আকার, ছন্দ ও বর্ণনা শৈলী প্রমাণ করে সূরাটি মাক্কি।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য- মানুষের সাফল্য ও কল্যাণের জন্য আহবান করা হয়েছে। মানুষ কল্যাণ পরিহার করে যেন ধংস ও লাঞ্ছনার পথে না যায়। সময়কে কাজে লাগায়। ইমাম শাফেয়ি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, মানুষ জাতি যদি এই সুরা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে তাহলে এটিই তাদের হেদায়েতের জন্য যথেষ্ট।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা- এ সুরায় বস্তুত পক্ষে মানুষকে চারটি গুণাবলীর অধিকারী হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যারা এ গুণাবলীগুলো নিজের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে পারবে তারা ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে- গুণাবলী চারটি হচ্ছে-
ক. ঈমান আনয়ন করা (আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি)
খ. সৎকাজ তথা নেক আমল করা
গ. পরস্পরকে হকের উপদেশ দেয়া
ঘ. পরস্পরকে সবর (ধৈর্য ধারণ) করার উপদেশ দেয়া
১. সময়ের কসম- হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর অর্থ করেছেন-সময়ের শপথ বা যুগের শপথ। তাফসিরকারকগণ বলেছেন, ‘সময়ের শপথ করার কারণ হলো, যুগ বা সময় মানুষের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়, কেননা যুগের আবর্তন-বিবর্তনে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়। আমির ফকির হয়, ফকির আমির হয়।
হজরত মোকাতিল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এর দ্বারা আসরের নামাজকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, কেননা এটি মধ্যবর্তী নামাজ, যার জন্যে কুরআনে কারিমে বিশেষভাবে তাগিদ করা হয়েছে।
বিক্রেতার কাছ থেকে আসরের শিক্ষা লাভ-
একজন তাফসিরকারক বলেছেন- একবার দামেশক শহরে একজন বরফ বিক্রেতা চিৎকার দিয়ে বলছিল, “তোমরা এমন এক ব্যবসায়ীর প্রতি দয়া করা, যার পুঁজি অহরহ গলে যায়”। বরফ বিক্রেতার এ উক্তিটি ‘ওয়ালআসর’ এর মর্মার্থ অনুধাবনে সহায়ক। অর্থাৎ বরফ যেমন প্রতি মুহূর্তে গলে যায়, সময়ও তেমনি প্রতি মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যায়।
মানুষের পূঁজি-
দুনিয়াতে মানুষের পূঁজি বা সম্পদ হলো তার জীবনকাল বা জীবনের সময়। যে এই পূঁজির সদ্ব্যবহার করে তথা আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান আনে ও নেক আমল করে, তার জীবন-সাধনা সার্থক হয়, কেননা সচেতন ব্যক্তিগণ ঈমান ও নেক আমলের মাধ্যমে আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের সম্বল সংগ্রহ করে। সুতরাং মানুষের শ্রেষ্ঠ পূঁজির কসম করে আল্লাহ মানুষকে ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকার তাগিদ দিয়েছেন। যারা এ পূজিকে কাজে লাগায় না, সময়ের কাজ সময়ে না করে জীবনের মূল্যবান সম্পদ সময়ের পূঁজিকে বিনষ্ট করে।নেক আমল ও ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করে না, তারা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত তেমনি বিপদগ্রস্ত।
সতর্কবানী-
২. নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত।
বরফ বিক্রেতা যদি বরফের গলে যাওয়ার অবস্থা সম্পর্কে সতর্ক না থাকে এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে উদাসীন থাকে, তার ক্ষতি হওয়া যেমন অবধারিত ঠিক তেমনি এ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সম্পর্কে মানুষ যদি উদাসীন থাকে, প্রতিটি মুহূর্তের বিনিময়ে আখিরাতের সম্বল সংগ্রহ না করে, তবে তার ধংসও অনিবার্য।
যারা মুক্ত-
৩. যারা ঈমান আনে, নেক আমল করে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় এবং ধৈর্য ধারনের উপদেশ দেয়। অর্থাৎ তার ক্ষতিগ্রস্ত নয়, যারা সময়ের মূল্য বুঝে জীবনের মর্যাদা দেয়, একটি মুহূর্ত নষ্ট না করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সদ্ব্যবহার করে। সর্বোপরি জীবনের মালিক আল্লাহ তাআলার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখে এবং তার আনুগত্য প্রকাশ করে। ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিপূর্ণ আনুসরণ ও তাঁর মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনকে গড়ে তোলে।
এ সূরায় মানুষের জন্য রয়েছে চারটি রক্ষাকবচ-
১. আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান এবং তাদের কর্মনীতির সঠিক বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।
২. আমলে সালেহ তথা নেক আমল অর্থা- আল্লাহ ও রাসূলের বিশ্বাস মনের গভীর প্রকোষ্ঠে সংরক্ষণই যথেষ্ট নয় বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নেক আমলের মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশের কথা বলা হয়েছৈ।
৩. শুধু মাত্র নিজের জীবনে সত্যের ওপর অবিচল থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং সমাজ ও জাতির জন্য সঠিক পথ প্রদর্শনেও আত্মনিয়োগ করা। মানুষকে সততার উপর থাকার সদুপদেশ দেয়া সত্যের ওপর অবিচল থাকার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
৪. মহান আল্লাহর এ হুকুম পালনে দুঃখ-কষ্ট, যাতনা, জুলুম-নির্যাতন আসতে পারে। জুলুম-নির্যাতন, দুঃখ-কষ্টের কুপ্রভাবে নিজেকে অটল, অবিচল রাখা তথা সবরের উপদেশ দেয়ো হয়েছে।
এ সূরার আমল-
অর্থ-সম্পদ সংরক্ষণের সময় এ সূরা পাঠ করা হলে সম্পদের হেফাজত হয়।
স্বপ্নের তাবির-
যে ব্যক্তি স্বপ্নে এ সূরা পাঠ করছে দেখবে, সে আশা এবং ভয়ের মাঝে দোদুল্যমান থাকবে। অনেক তত্ত্বজ্ঞানী বলেছেন, তার অনেক উপকারও হবে এবং ক্ষতিও হবে।
উপরোল্লিখিত আলোচনায় এ কথা প্রমাণিত হচ্ছে যে, মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে ঈমান ও নেক আমল অর্জনের পর অন্যের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করা একান্ত করণীয় কাজ। মানুষকে সত্যের নির্দেশ দেয়া এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা আবশ্যক কর্তব্য। তাইতো সাহাবায়ে কিরামগণ একত্রিত হয়ে বিদায়লগ্নে একে অন্যকে এ সূরা পাঠ করে শোনাতেন, যাতে করে এ সূরার প্রতি আমল করা হয়। আল্লাহ আমাদেরকে উক্ত সূরার আমল করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামত লাভ করতে পারি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।
জাগো নিউজ ২৪ ডটকমের সঙ্গে থাকুন। সুন্দর সুন্দর ইসলামী আলোচনা পড়ুন। কুরআন-হাদিস মোতাবেক আমলি জিন্দেগি যাপন করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।
এমএমএস/এমআরআই