জাকাতুল ফিতরাহ


প্রকাশিত: ০১:৩৬ পিএম, ০৭ জুলাই ২০১৫

ফিতরা একটি পরিচিত পরিভাষা। রমজান ও ঈদ যেমন আমাদের ইবাদত এবং আনন্দ। তেমনি ফিতরাও আমাদের ইবাদত ও আনন্দের উপকরণ। সুতরাং আমরা ফিতরা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি জেনে নিই।

ফিতরা কী?
সাদাকাতুল ফিতরকে জাকাতুল ফিতর বলা হয়। ‘ফিতর’ মানে হলো ‘রোজা ছাড়া’। সুতরাং জাকাতুল ফিতর-এর মানে হলো- সেই যাকাত; যা রমজানের রোজা ছাড়ার কারণে ফরজ হয়। আর ফিতরাহ মানে হলো প্রকৃতি। যেহেতু এ জাকাত আত্মশুদ্ধি ও আত্মার আমলকে নির্মল করার জন্য দেয়া আবশ্যক, তাই এর নাম জাকাতুল ফিতরাহ। (ফিকহুজ জাকাত, ইউসুফ কারজাভি)

ফিতরার হিক্বমত
১. সাদাকাতুল ফিতর দ্বিতীয় হিজরির শা’বান মাসে বিধিবদ্ধ হয়। রোজাদারকে সকল অবাঞ্ছনীয় অসারতা ও যৌনাচার তথা ফাহেশা কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য; যা সে রোজাকালীন অবস্থায় করে ফেলেছে। এই সাদাকাহ হবে রোজার মধ্যে ঘাটতির ক্ষতিপূরণ। কেননা নেকির কাজ পাপকে ধ্বংস করে দেয়।

২. এ সাদাকাহকে ফরজ করার আরেকটি কারণ হচ্ছে- ঈদের দিন গরিব ও মিসকিনদের আনন্দ-বিনোদন, উত্তম খাবারের সহজলভ্যতার জন্য। যাতে তারাও ধনীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে। যারা দিন আনে দিনে খায়; ভিক্ষাবৃত্তি করে খাবার যোগাড় করতে হয়; খাবারের জন্য অন্য লোকের দারস্থ হতে হয়; তাদেরকে অন্তত ঈদের দিনটাতে যাতে লাঞ্ছিত হতে না হয় এবং ঘরের খাবার দেখে মনের ভেতর যেন খুশির ঢেউ আসে, এ জন্যই সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানী, জনম দরদী নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সুব্যবস্থা করে গেছেন। হাদীসে এসেছে, ‘আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজাদারের অসারতা ও যৌনাচারের পাংকিলতা থেকে পবিত্র এবং মিসকীনদেও আহার স্বরূপ ফরজ করেছেন...।’ (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)

৩. এই সাদাকাহ আদায় করতে হয় আল্লাহর কৃতজ্ঞ তাজ্ঞাপনের জন্য। কেননা আল্লাহ মেহেরবানী করে আমাদেরকে দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার তাওফিক দান করেছেন।

৪. আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দীর্ঘ একটি বছর আমাদেরকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখার পর মুবারক মাস রমজানে দান করেছেন। তাই এ সুস্থ দেহের জাকাত হল ফিতরা।

৫. সর্বোপরি এই নিয়ামতের মাস, আনুগত্যের মাসের শেষে যাতে আত্মশুদ্ধিও প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ হয়। সকল হ্যাঁ-সূচক ও না-সূচক আনুগত্যের পর আত্মাকে বিশুদ্ধ ও পবিত্র করার লক্ষ্যে আল্লাহর পথে মাল (অর্থ) খরচের মাধ্যমে নিজেদেরকে পবিত্রতা করার জন্যই ফিতরার ব্যবস্থা করেছেন।

যারা এই ফিতরা দেবেন-
ফিতরা তারাই দিবেন যারা ঈদের রাত ও দিনে নিজের এবং পরিবারের সবার একান্ত প্রয়োজনীয় আহারের চেয়ে অতিরিক্ত খাদ্য বা সম্পদ মজুদ থাকে। ফিতরা দেয়ার জন্য যাকাত ফরজ হওয়ার বিষয়াবলীর কোনো বিধান নেই। এ কথা বলা যাবে না যে, আমার উপর তো জাকাত ফরজ নয়; বা আমি তো নিসাব পরিমাণ মালের মালিক নই। সুতরাং যারা রমজানের শেষ রোজায়, ঈদের যাবতীয় খরচ মিটিয়ে অতিরিক্ত অর্থ থাকবে তার উপর পরিবারের পক্ষ থেকে সবার জন্য ফিত্বরাহ আদায় করবে।

১. ফিতরা দেয়ার জন্য জায়গা-জমি, বাড়ি-গাড়ি, ধন-সম্পদ নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া জরুরি নয়। এ সাদাকাহ কাফফারার মতো যা ধনী-গরিব সকলেই আদায় করতে বাধ্য। যেমন- প্রত্যেক স্বাধীন ও ক্রীতদাস বান্দার জন্য...। (বুখারি)

২. ফিতরার জন্য পরিবারের সবার উপর নির্ধারিত হারেই ফিতরা দিতে হবে। পরিবারের কর্তা ব্যক্তির একার ফিতরা নয়, বরং তার অধীনস্থ ছোট-বড়, চাকর-বাকর, ছেলে-মেয়ে এমনকি সদ্যভ‚ মিষ্ট বাচ্চার জন্যও সাদাকাতুল ফিতরা দিতে হবে।

হাদিসে এসেছে-
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, প্রত্যেক স্বাধীন ও ক্রীতদাস, পুরুষ ও নারী, ছোট ও বড়, গরিব ও ধনীর উপর। (মুসনাদে আহমাদ, বাইহাকি)

৩. এমনকি যে ব্যক্তি ফিতরাহ আদায় করার মতো কিছু আছে; কিন্তু তার ওই পরিমাণ দেনা বা ঋণ আছে, তবুও তাকে ফিতরাহ আদায় করতে হবে। তবে যদি ঋণদাতা তার ঋণ পরিশোধ করার তাগাদা দেয় তাহলে সেক্ষেত্রে আগে ঋণ পরিশোধ করাই আবশ্যক। আর তার জন্য জাকাত ফরজ নয়। (ফিকহুজ জাকাত)।

ফিতরার পরিমাণ
ফিতরার সাদাকা হচ্ছে এক সা’ পরিমাণ। এখানে সা’ বলতে মদিনায় প্রচলিত নববী সা’ উদ্দেশ্য। পৃথিবীর অন্য কোথাও যদি সা’ প্রচলিত থাকে এবং মদীনার সা’ এর বিপরীত হয় তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সা’-এর মাপ অনুযায়ী বর্তমান যুগের ভালো ধরনের গমের ওজন হয় দুই কেজি ৪০ গ্রাম। অবশ্য চাল ইত্যাদি সলিট খাদ্য-দ্রব্যেও ওজন তার থেকে বেশি হবে। অতএব এক সা’ পরিমাণ খাদ্যেও ওজন হবে প্রায় আড়াই কেজির মতো। সে হিসেবে এ বৎসর আমাদের দেশে ফিতরার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ টাকা (প্রতিজন)। আর যারা সাবলম্বী তারা এই নির্ধারিত ফিতরার দিকে না তাকিয়ে যত বেশি পরিমাণ সম্ভব গরিব দুঃখীর মাঝে দান করবে মুক্ত হস্তে।

কী দিয়ে ফিতরা আদায় করবো-
যে দেশে যে খাদ্য শষ্য হয় তার মূল্য নির্ধারণ করেই আমাদের ফিতরা আদায় করতে হবে। যে দেশে গম হয় না খেজুর হয় তারা খেজুর দিয়ে ফিতরা আদায় করবে।

যাদের দেশে কোনো ফল-ফসল হয় না গোশত হয়; তারা গোশত দিয়ে ফিতরা আদায় করবে। যেমন উত্তর মেরুতে কোনো ফল ও ফসল হয় না শুধু গোশত উৎপন্ন হয়। তারা তা দিয়ে ফিতরা আদায় করবে।

মূল কথা হচ্ছে প্রত্যেক দেশের প্রধান খাদ্য শষ্য, ফল বা গোশত যাই হোক না কেন, ফিতরায় তা দান করলে ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। তাতে সে খাদ্যেও কথা হাদিসে উল্লেখ থাক আর না থাক।

উক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, ফিতরার টাকা-পয়সা, জামা-কাপড়, কাঁথা-বালিশ, লেবাস পোশাক, পশুখাদ্য অথবা অন্য কোনো আসবাবপত্র দান করলে তা যথেষ্ট নয়। কারণ তা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ বিরোধী। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করে, যাতে আমাদের কোনো নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।’ (বুখারি তা’লিক, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)

আল্লাহ আমাদেরকে ফিতরা আদায় করে আমাদের রোজার ছোটছোট অপরাধ ও ভুলগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

তথ্যসূত্র : বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, মুসনাদে আহমদ।

জাগো নিেজের সঙ্গে থাকুন। রমজান সম্পর্কিত সুন্দর সুন্দর ইসলামী আলোচনা পড়ুন। কোরআন-হাদিস মোতাবেক আমলি জিন্দেগি যাপন করে রমজানের রহমত, বরকত ও মাগফেরাত অর্জন করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।

এমএমএস/বিএ/এমআরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।