ই’তিকাফের ফজিলত ও উপকারিতা
রমজানের দ্বিতীয় দশক চলছে। আর মাত্র ৩-৪ দিন পরই শুরু হবে ই’তিকাফকারীদের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ই’তিকাফের ফজিলত ও উপকারিতা সম্পর্কে জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তুলে ধরছি। ই’তিকাফের সময়টাতে ইবাদতকারীগণ আল্লাহর দরবারে ইবাদতের প্রতিযোগিতায় উঠে পড়ে লেগে যায়। যেভাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমড়ে কাপড় বেঁধে ইবাদত-বন্দেগিতে লেগে যেতন। তাই আসুন আমরা আমাদের ই’তিকাফকে প্রাণবন্ত ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে হৃদয়ে ধারণ করে জেনে নেই তার আদি-অন্ত।
ইতিকাফ কখন থেকে কত দিন?
রমজানের বিশ তারিখের সূর্যাস্ত পূর্ব থেকে ঈদের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত ই’তিকাফ করাকে ই’তিকাফে মাসনুনা বলা হয়। হাদিস শরিফে এসেছে-
ইন্নান নাবিয়্যা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা কানা ইয়া’তাকিফু ফিল আশরিল আওয়াখিরি মিন রামাদান। (বুখারি, মুসলিম) অর্থাৎ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশদিন ই’তিকাফ করতেন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিহাদের সফরের কারণে তার মাদানি জীবনে মাত্র একটি রমজান ই’তিকাফ করতে পারেননি। তবে পরবর্তী বছর ২০ দিন ই’তিকাফ করে তা পূরণ করে নিয়েছেন। হাদিসে এসেছে-
কানান নাবিয়্যু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়া’তাকিফু ফি কুল্লি রামাদানা আশারাতা আইয়ামিন; ফালাম্মা কানাল আ’মুল্লাজি কুবিদা ফিহি ই’তিকাফা ইশরিনা ইয়াওমান। (বুখারি)
অর্থাৎ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক রমজানে দশদিন ই’তিকাফ করতেন। তবে ওফাতের বৎসর বিশ দিন ই’তিকাফ করেছেন।
সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈনগণও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ই’তিকাফে শরিক হতেন। তাই ই’তিকাফ একটি মর্যাদা ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাসনুন আমলা যা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে।
ই’তিকাফের ফজিলত
ই’তিকাফের ফজিলত অত্যাধিক। কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের পূর্ব থেকেই ই’তিকাফের প্রচলন ছিল। আল্লাহ তাআলাও বান্দার এই ই’তিকাফকে পছন্দ করেন। যার কারণেই আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন-
‘এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ই’তিকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।’ (সূরা বাক্বারা : আয়াত ১২৫)
তাইতো রমজানের ফজিলত, বরকত এবং বিশেষত লাইলাতুল কদরের ফজিলত ও বরকত লাভের জন্য ই’তিকাফের গুরত্ব অপরিসীম। তাইতো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বান্দার ই’তিকাফ পালনের জন্য মসজিদকে প্রস্তুত রাখার ব্যাপারে কুরআনুল কারীমের এই আয়াত নাযিল করেছেন।
হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী ই’তিকাফের ফজিলত-
মানি’তিকাফা ইয়াওমান ইবদিগাআ ওয়াঝহিল্লাহি তাআলা ঝাআ’লল্লাহু বাইনাতা ওয়া বাইনান্নারী ছালাছা খানাদিক্ব; আবআ’দা মিম্মা বাইনালখাফিক্বাইনি। (শুআ’বুল ঈমান)
অর্থ : ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এক দিন ই’তিকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। অর্থাৎ আসমান ও জমিনের মাঝে যত দূরত্ব আছে তার চেয়েও বেশি দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন।’ সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি। আর যদি কোনো বান্দা মাসনুন ই’তিকাফ দশদিন আদায় করে তবে আল্লাহ কি পরিমাণ ক্ষমা ও পুরস্কার দান করবেন তা এই হাদিসের ভাষ্য থেকে আমরা অনুমান করতে পারি।
ই’তিকাফের উপকারিতা কি?
১. শবে ক্বদর অন্বেষণের অন্যতম মাধ্যমই হচ্ছে ই’তিকাফ। হাদিসে এসেছে- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের মাঝের দশদিন ই’তিকাফ করতেন। একবছর এভাবে ই’তিকাফ শেষ করার পর যখন রমজানের ২১তম রাত আসল (অর্থাৎ যে রাত গিয়ে সকালে তিনি ই’তিকাফ থেকে বের হলেন) তিনি ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি আমার সাথে ই’তিকাফ করেছে সে যেন শেষ দশক ই’তিকাফ করে। কারণ, আমাকে লাইলাতুল ক্বদর সম্পর্কে অবগত করা হয়েছিল (যে তা শেষ দশকের ওমুক রাতে)। এরপর তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা লাইলাতুল ক্বদর শেষ দশকে খোঁজ কর।’ (বুখারি)
২. ই’তিকাফকারী অবসর সময়ে কোন আমল না করলেও তার দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ইবাদত হিসেবেই গণ্য হয়।
৩. ই’তিকাফের বদৌলতে অনেক পাপাচার ও গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা যায়। কেননা গুণাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর ঘর যেন একটি প্রকৃত দুর্গ।
৪. ই’তিকাফ দ্বারা দুনিয়ার সকল প্রকার ঝামেলা ও সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত করে পুরোপুরি আল্লাহ তাআলার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়া যায়। রোজার কারণে পুরো দিন ফেরেশতাদের সাথে (পানাহার ও যৌন কর্ম বর্জন দ্বারা) মানুষের সামঞ্জস্য হয় এবং ফেরেশতাসূলভ আচরণের উপর অবিচল থাকার চমৎকার প্রশিক্ষণ হাসিল হয়।
৫. রোজার যাবতীয় আদব ও হক যথাযথ আদায় করে পরিপূর্ণ রোজা আদায় করার জন্য ই’তিকাফ অত্যন্ত কার্যকর।
৬. আল্লাহ তাআলার মেহমান হয়ে তার সাথে মহব্বত ও ভালবাসা সৃষ্টি করার অন্যতম মাধ্যম মসজিদে ই’তিকাফ। এজন্যই সশ্রদ্ধভাবে একান্ত মনোবাসনা নিবেদনের জন্য ই’তিকাফের বিকল্প ইবাদত পৃথিবীতে বিরল।
৭. সর্বোপরী ই’তিকাফকারী ব্যক্তি মসজিদে অবস্থান করার ফলে যে সব আমল করতে অক্ষম যেমন- জানাজায় শরীক হওয়া, অসুস্থদের সেবা করা ইত্যাদি আমল না করেও তার ছাওয়াবের ভাগীদার হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে থাকে।
সুতরাং আসুন আমরা ই’তিকাফের প্রস্তুতি পুরোপুরি নিতে থাকি। পুরুষগণ আসছে বিশ রমজান সুর্যাস্তের পূর্বেই মসজিদে ই’তিকাফের নিয়তে অবস্থান করার জন্য চলে যাই এবং মহিলারা নিজেদের বাসা-বাড়িতে ঘরের একটি নির্ধারিত স্থানে পর্দা টাঙ্গিয়ে ই’তিকাফের জন্য নির্দিষ্ট করে একই তারিখে অবস্থান করি এবং ঈদের চাঁদ দেখার পূর্ব পর্যন্ত ইবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দিই। আল্লাহ আমাদের ই’তিকাফের ফজিলত ও উপকারিতা লাভের তাওফিক দান করুন। আমীন।
সতর্কবাণী-
এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ই’তিকাফ পালনে কোনো মহল্লার কোনো মসজিদ যদি ই’তিকাফ শূন্য থাকে তবে পুরো এলাকাবাসী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত বর্জনের কারণে গুণাহগার হবে। আল্লাহ আমাদের এই গুণাহ থেকে হেফাজত করুন।
তথ্যসূত্র : কুরআনুল কারিম, সহিহ বুখারি, মুসলিম, শুআবুল ঈমান
জাগো নিউজ ২৪ ডটকমের সঙ্গে থাকুন। রমজান সম্পর্কিত সুন্দর সুন্দর ইসলামি আলোচনা পড়ুন। কুরআন-হাদিস মোতাবেক আমলি জিন্দেগি যাপন করে রমজানের রহমত, বরকত ও মাগফেরাত অর্জন করুন। আমীন, ছুম্মা আমীন।
এসএইচএস/আরআই