মহররম মাসে যাদের ক্ষমা লাভ মুসলিম উম্মাহর অনুপ্রেরণা
মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ মাস হলো মহররম। আরবি হিজরি সালের প্রথম মাসও এটি। কুরআনুল কারিমে এ মাসকে হারামের অন্তর্ভূক্ত করে এর মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর ১০ মহররম তথা আশুরার ঐতিহাসিক বিয়োগান্তক ঘটনা বিশ্ববাসীর আবেগ ও অনুভূতিতে ইসলামের পূনর্জীবনী শক্তি ও সাহস হিসেবে স্থায়িত্ব লাভ করেছে।
এ মাসে সব ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহসহ খুন-খারাবি তথা রক্তপাতকে হারাম করে তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ মাসের ফজিলত অনেক বেশি। কারণ কুরআনের অনেক ঘটনার সমাপ্তি এবং ক্ষমা এ মাসেই সংঘটিত হয়েছিল। যার কিছু বিবরণ তুলে ধরা হলো
হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালামের মুক্তি
আল্লাহ তাআলা সুরা আম্বিয়ায় ঘোষণা করেন-
‘এবং মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, অতপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাঁকে ধৃত করতে পারব না। অতপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহবান করলেন- তুমি ব্যতিত কোনো উপাস্য নেই; তুমি নির্দোষ আমি গোনাহগার।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৭)
আল্লাহ তায়ালা হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালামকে মুসিল অঞ্চলের নিনওয়া নামক স্থানের নবি করে পাঠান। তিনি সেখানে মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করেন। মানুষ তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেনি।
এ কারণে হজরত ইউনুস আলাইহিস সালাম সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য সমুদ্র পাড়ে গিয়ে নৌকায় আরোহন করলেন। নৌকা সমুদ্রে কিছুদূর যাওয়ার পর ঝড়ের কবলে পড়ে গেল। সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো নৌকা থেকে একজনকে ফেলে দেয়া হবে।
সেখানে একে একে তিনবার লটারি করা হলো কাকে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হবে। তিন বারই লটারিতে হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালামের নাম ওঠে। কিন্তু লোকজন তাঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে অসম্মতি জানায়। হজরত ইউনসু আলাইহিস সালাম সবার হেফাজতের কথা ভেবে নিজেই দাঁড়িয়ে গেলেন এবং নদীতে লাফিয়ে পড়লেন।
আল্লাহ তাআলা হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালামকে হেফাজত করার জন্য ‘বাহরে আখদার’ তথা সবুজ সাগর থেকে একটি বিরাটাকার মাছ পাঠিয়ে দিলেন। মাছটি পানি ফেড়ে এসে হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালামকে পেটে ধারণ করে।
আল্লাহর নির্দেশে মাছ তাঁর মাংস খেল না। তার হাঁড় ভাঙাসহ কোনো ক্ষতি করল না। এ মাছের পেট ছিল তাঁর জন্য কয়েদখানা। মাছের পেটে তিনি আল্লাহর তাসবিহ শুনে তাঁর সিজদায় লুটিয়ে পড়েন।
সিজদায় পড়ে হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালাম বলেন- ‘হে আল্লাহ আমি এমন একস্থানে আপনার সিজদা করছি। যে স্থানে কেউ কোনো দিন আপনাকে সিজদা করেনি।’
হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করলে আল্লাহ তাআলা তাকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘অতপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। আমি এমনি ভাবে বিশ্ববাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৮) আর হজরত ইউনুছের মুক্তির এ দিনটি ছিল মহররম মাসের ১০ তারিখ।
হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের মুক্তি
আল্লাহ তাআলা তাঁর নবি হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের কথাও কুরআনে তুলে ধরেছেন। হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামকে আল্লাহ আর্থিক, দৈহিক ও সন্তানের দুঃখ-কষ্টে পতিত করেন। তার ধন-সম্পদ জীব-জন্তু, ক্ষেত-খামার, বাগ-বাগিচা সবই ছিল। তাঁর ওপর আল্লাহর পরীক্ষা আসে, এবং তার সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যায়। তার সম্পূর্ণ দেহ কুষ্ঠরোগে ভরে যায়।
আল্লাহর নিকট তিনি দোয়া করেন; তাঁর দোয়া আল্লাহ কুরআনে তুলে ধরে বলেন-
‘এবং স্মরণ করুন আইয়ুবের কথা, যখন তিনি তাঁর পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেন; আমি দুঃখকষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চাইতেও সর্বশ্রেষ্ট দয়াবান। (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৩)
অতপর আল্লাহ তাআলা হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামকে ক্ষমা করে তার সমুদয় সম্পদ, স্ত্রী-সন্তানদের পুনরায় দান করেন। তাও কুরআনে উল্লেখ করে বলেন-
‘অতপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁর দুঃখকষ্ট দূর করে দিলাম এবং তাঁর পরিবরাবর্গ ফিরিয়ে দিলাম, আর তাদের সঙ্গে তাদের সমপরিমাণ আরও দিলাম আমার পক্ষ থেকে কৃপাবশত আর এটা এবাদত কারীদের জন্যে উপদেশ স্বরূপ। (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৪) তাও ঘটেছিল এ মহররম মাসে।
পৃথিবীর আদি হতে শুরু হয়ে কারবালার ঘটনা পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা অগণিত অসংখ্য ত্যাগ ও ক্ষমার নজির মুসলিম উম্মাহর জন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করেছেন।
এ পবিত্র মাসেই কারবালার প্রান্তরে হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত সংঘটিত হয়েছিল। এ মাস মুসলিম উম্মাহর ত্যাগ, ক্ষমা, শিক্ষা গ্রহণের মাস। এ মাসের পবিত্রতা রক্ষা করা প্রত্যেক ঈমানদার মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
পরিশেষে...
আল্লাহর কুরআন ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত যে, মুহররম মাগফিরাতের মাস। এ মাসেই আল্লাহ তাআলা অনেক নবি-রাসুলকে অনেক বিপদ থেকে হেফাজত করেছেন। আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেছেন অনেককেই।
যেহেতু মুহররম মাসেই আল্লাহ তাআলা নবিদের ক্ষমা করেছেন। অসংখ্য কল্যাণের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এ মাসে যদি মুসলিম উম্মাহ যথাযথ পবিত্রতা ও মর্যাদার সঙ্গে ইবাদত-বন্দেগিতে আত্মনিয়োগ করে; তবে আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মাদিকেও ক্ষমা করে তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য কবুল করতে পারেন।
মুহররম মাসে আল্লাহর ক্ষমা ও মাগফেরাত লাভ করার সুবর্ণ সুযোগ আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাই এ পবিত্র মাসটি শেষ হওয়ার আগেই আল্লাহর দরবারের কঠিন কঠিন বিপদ-মুসিবত থেকে ক্ষমা প্রার্থণা করি সবার জন্য একান্ত আবশ্যক।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে এ পবিত্র মাসে মাগফেরাত ও ক্ষমা লাভ করার তাওফিক দান করুন। কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস