মৃত ব্যক্তির পক্ষে রোজা রাখা
আর মাত্র ৪ বা ৫ দিন বাদেই ঈদুল ফিতর। ঈদ উৎসবে অংশ নিতে সমগ্র জাতি এখন উন্মুখ। বাকি কটি সিয়াম পালনে সর্বাত্মকভাবে প্রত্যেকে শামিল। সিয়াম একটি ফরজ এবাদত। এ থেকে কারো বঞ্চিত থাকা উচিত নয়। আজকের কলামে আমরা একটু ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়ে দৃকপাত করব। আর সেটি হচ্ছে, গত হয়ে যাওয়া অভিভাবকের সিয়াম সম্পর্কে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসূল (সা.) বলেছেন, যে মারা গেল, অথচ তার সিয়াম রয়েছে, তার অভিভাবক তার পক্ষ থেকে সওম রাখবে।
ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (সা.) এর কাছে এলো, অতঃপর সে বলল, হে রসূল (সা.), আমার মা মারা গেছে, তার জিম্মায় এক মাসের রোজা রয়েছে, আমি কি তার পক্ষ থেকে কাজা করব? রসূল (সা.) বললেন, যদি তোমার মায়ের ওপর ঋণ থাকে, তার পক্ষ থেকে তুমি কি তা আদায় করবে? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, অতএব খোদার ঋণ বেশি হকদার, যা কাযা করা উচিত (বুখারি ও মুসলিম)।
বুখারি ও মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে, জনৈক নারী নবী করীম(সা.) এর কাছে এসে বলল, হে রসূল, আমার মা মারা গেছে, তার ওপর মান্নতের সওম রয়েছে, আমি কি তার পক্ষ থেকে সওম রাখব? তিনি বললেন, তুমি কি মনে কর তোমার মার ওপর যদি ঋণ থাকে আর তুমি তা আদায় কর, তাহলে তা যথেষ্ট হবে? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তোমার মায়ের পক্ষ থেকে তুমি সওম রাখ।
বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রসূল(সা.) এর কাছে বসেছিলাম, ইত্যবসরে তার কাছে এক নারী এসে বলল, আমি আমার মাকে এক ‘দাসী’ সদকা করেছি, কিন্তু সে মারা গেছে।
বর্ণনাকারী বলেন, রসূল(সা.) বলেছেন, তোমার সওয়াব হয়ে গেছে, তুমি তা মিরাস হিসেবে ফিরিয়ে নাও। সে বলল, হে রসূল, তার জিম্মায় এক মাসের সওম ছিল, আমি কি তার পক্ষ থেকে সওম রাখব? তিনি বললেন, তার পক্ষ থেকে সওম রাখ। সে বলল, তিনি কখনও হজ করেননি, আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ করব? তিনি বললেন, তার পক্ষ থেকে হজ কর (মুসলিম)।
শিক্ষা ও মাসায়েল :
এক. শারীরিক এবাদতে প্রতিনিধিত্ব হয় না এটাই মূলনীতি, তবে সিয়াম এ নীতির অন্তর্ভুক্ত নয়, যেমন নয় হজ। হাফেজ ইবন আব্দুল বার (রহ.) বলেছেন, সালাতের ব্যাপারে সবাই একমত যে, কেউ কারো পক্ষ থেকে সালাত আদায় করবে না, না ফরজ, না সুন্নত, না নফল, না জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে, না মৃত ব্যক্তির। অনুরূপ জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে সিয়াম, জীবিতাবস্থায় একের সওম অপরের পক্ষ থেকে আদায় হবে না। এতে ইজমা রয়েছে, কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু যে মারা যায়, তার জিম্মায় যদি সিয়াম থাকে, তার ব্যাপারে পূর্বাপর আলেমদের ইখতিলাফ রয়েছে।
দুই. মৃত ব্যক্তির জিম্মায় যদি সিয়াম থাকে, তার দুই অবস্থা (১). কাযার সুযোগ না পেয়ে মারা যাওয়া, সময়ের সঙ্কীর্ণতা অথবা অসুস্থতা অথবা সফর দরুণ কাযার সুযোগ পায়নি, অধিকাংশ আলেমদের মতে তার উপর কিছু নেই। (২) কাযার সুযোগ পেয়ে মারা যাওয়া। এক্ষেত্রে সুন্নত হচ্ছে তার অভিভাবক তার পক্ষ থেকে সওম রাখবে।
তিন. মৃত ব্যক্তিকে আত্মীয়স্বজন বা অন্য কারও পক্ষ থেকে দায়মুক্ত করা বৈধ। হাদিসে বর্ণিত, সওয়ামা আনহু ওয়া আদ্দাহু অর্থ হচ্ছে ওয়ারিশ ও উত্তরসূরি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন হয়, অন্যথায় তার পক্ষ থেকে তার নিকটাত্মীয় অথবা দূরের কারো সিয়াম পালন করা বৈধ, ঋণ আদায়ের ন্যায়। শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ (রহ.) বলেছেন, নবী করীম(সা.) তা ঋণের সাথে তুলনা করেছেন, ঋণ যে কেউ কাযা করতে পারে, অতএব প্রমাণিত হয় যে, এটা যে কারো পক্ষ থেকে করা বৈধ, শুধু সন্তানের সাথে খাস নয়।
চার. মৃত ব্যক্তির মানত কাযা করা ওয়াজিব নয়, যেমন নয় অভিভাবকদের উপর তার ঋণ পরিশোধ করা। তবে এটা মৃত ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করার জন্য তাদের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ।
পাঁচ. মৃতের জিম্মায় যদি অনেক সিয়াম থাকে, সে সংখ্যানুসারে তার পক্ষ থেকে কতক লোক যদি এক দিন সিয়াম পালন করে, তাহলে শুদ্ধ হবে। তবে যে সওমে ধারাবাহিকতা জরুরি তা ব্যতীত যেমন- যিহার ও হত্যার কাফফারা, এক্ষেত্রে একজন ধারাবাহিকভাবে সিয়াম পালন করবে।
ছয়. যদি তার পক্ষ থেকে কেউ সিয়াম পালন না করে, তবে তার অভিভাবকগণ তার পক্ষ থেকে প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দেবে, তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে দেওয়া বৈধ।
সাত. ওয়ারিশগণ যদি কাউকে সওমের জন্য ভাড়া করে, তাহলে শুদ্ধ হবে না। কারণ নেকির বিষয়ে ভাড়া করা বৈধ নয়।
আট. যদি মানত করে মুহাররম মাসে সিয়াম পালন করবে, অতঃপর সে জিলহজ মাসে মারা যায়, তার পক্ষ থেকে কাযা করা হবে না, কারণ সে ওয়াজিব হওয়ার সময় পায়নি, যেমন কেউ মারা গেল রমজানের পূর্বে।
নয়. যার ওপর রমজানের কতক দিনের সিয়াম ওয়াজিব, সে যদি তার নিকটাত্মীয়ের কাযা অথবা কাফফারা অথবা মান্নতের সওম পালন করতে চায়, তার ওপর ওয়াজিব আগে নিজের সওম পালন করা, অতঃপর তার নিকটাত্মীয়ের সওম পালন করা।
দশ. বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী কাযা সওমে ধারাবাহিকতা শর্ত নয়, তবে ধারাবাহিকভাবে কাযা করা উত্তম। কারণ তার সাথে আদায়ের মিল থাকে।
এগারো. কাফফারার দুই মাস সিয়ামের ধারাবাহিকতা ঈদের দিনের কারণে ভঙ্গ হবে না।
বিস্তারিত জানতে পড়া যেতে পারে ইবরাহিম ইবন মুহাম্মাদ আল-হাকিলের বাংলা অনুদিত কিতাব রমযানের বিষয়ভিত্তিক হাদিস : শিক্ষা ও মাসায়েল।
লেখক: এ.কে.এম মহিউদ্দীন