মক্কায় প্রথম প্রকাশ্যে কোরআন তিলাওয়াত করেছিলেন যে সাহাবি
ইসলামের আবির্ভাবের পরপর মক্কায় ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রম চলছিল অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে। আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যাদের আস্থাভাজন মনে করতেন, শুধু তাদেরই ইসলামের দাওয়াত দিতেন। প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন নবিজির (সা.) স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.)। তারপর নবিজির (সা.) পালক ছেলে জায়েদ, তার চাচাতো ভাই আলী (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। স্বাধীন পুরুষদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন নবিজির (রা.) প্রিয় বন্ধু হজরত আবু বকর (রা.)। আবু বকরের (রা.) দাওয়াতে তার বন্ধু ওসমানও (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে এক/ দুইজন করে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছিল।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ওই সাহাবিদের অন্যতম যারা ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী ষষ্ঠ ব্যক্তি। এ বিষয়ে তার বক্তব্যই পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, আমি ইসলামগ্রহণকারীদের মধ্যে ষষ্ঠ ব্যক্তি; তখন ওই ছয় জন ছাড়া দুনিয়ায় কোনো মুসলমান ছিল না। (সহিহ ইবনে হিব্বান)
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা প্রকাশ্যে কোরআন তিলাওয়াত করতে পারতেন না। আল্লাহর নির্দেশে নবিজি (সা.) যখন প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন কুরায়শের নেতৃস্থানীয়দের বড় একটা অংশ আল্লাহর রাসুল (সা.) ও ইসলামের তীব্র বিরোধিতা শুরু করে। তাই তখনও সাহাবিরা নিরাপত্তাহানির আশংকায় প্রকাশ্যে কোরআন তিলাওয়াত করতে পারতেন না। যদিও আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রকাশ্যে কোরআন তিলাওয়াত করতেন। মানুষ তার তিলাওয়াত শুনে প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে কি না এই আশংকায় কাফেররা মানুষকে তার কোরআন তিলাওয়াত শুনতে নিষেধ করতো এবং তার তিলাওয়াতে নানাভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করার চেষ্টা করতো বলে কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, কাফেররা বলে এ কোরআন শুনো না, আর তা তিলাওয়াতের সময় শোরগোল কর যাতে তোমরা বিজয়ী হতে পার। (সুরা ফুসসিলাত: ২৬)
রাসুলের (সা.) পর সাহাবিদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি ভয় ভেঙে প্রকাশ্যে কোরআন তিলাওয়াত করেন, তিনি হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)। ইয়াহয়া ইবনে উরওয়া ইবনে জুবায়র তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন, মক্কায় আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পর প্রথম প্রকাশ্যে কোরআন তিলাওয়াত করেছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)। একদিন সাহাবায়ে কেরাম একত্র হয়ে বলাবলি করছিলেন, কোরায়শের লোকজন এখনও প্রকাশ্যে কোরআন তিলাওয়াত হতে দেখেনি। আমাদের মধ্যে কে তাদেরকে কোরআন শোনাতে পারে? আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, আমি পারবো। তারা বললেন, এ কারণে তোমার বিপদ হতে পারে। আমরা এমন একজন ব্যক্তিকে চাই যার গোত্র শক্তিশালী এবং কোনো বিপদের মুখে তারা তাকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু তিনি বললেন, আল্লাহই আমাকে রক্ষা করবেন।
পরদিন দুপুরে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ মাকামে ইবরাহিমে গেলেন এবং উচ্চৈস্বরে তিলাওয়াত করলেন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আর-রাহমান, আল্লামাল কুরআন’ (সুরা আর-রাহমান: ১-২) কাফেররা তার আওয়াজ শুনে দৌড়ে এসে বলতে লাগলো সে কী পড়ছে! কেউ কেউ বললো সে তাই আবৃত্তি করছে যা মুহাম্মদ সম্প্রতি নিয়ে এসেছে!
তিনি কোরআন তিলাওয়াত করছেন বুঝতে পেরে কাফেররা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এরপরও তিনি সুরা আর-রাহমান বেশ কিছুদূর পড়লেন। তিনি যখন অন্য সাহাবিদের কাছে ফিরে গেলেন, তখন তার চেহারায় আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। তারা বললেন, এ আশংকাই তো আমরা করছিলাম! তিনি বললেন, তোমরা চাইলে আমি আগামিকালও একইভাবে কোরআন তিলাওয়াত করতে পারি। তারা বললেন, তার আর প্রয়োজন নেই। তুমি যথেষ্ট করেছ! (সিরাতে ইবনে হিশাম, তারিখে তাবারি, উসদুল গাবাহ)
ইসলাম গ্রহণ ও নবিজির (সা.) অনুসরণের কারণে মক্কায় আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বেশ কয়েকবার নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) হিজরতের নির্দেশ দিলে তিনি প্রথম হাবাশায় ও পরে মদিনায় হিজরত করেন। পরবর্তীতে তিনি কোরআনের একজন আলেম বা পণ্ডিত হয়ে উঠেছিলেন। কোরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত ও ব্যাখ্যায় সাহাবিদের মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন তিনি। আল্লাহর রাসুল (সা.) তার জ্ঞানের স্বীকৃতি দিয়ে তার প্রশংসা করে বলেছিলেন, কোরআন যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে সেভাবেই যে তিলাওয়াত করতে চায়, সে যেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের মতো কোরআন তিলাওয়াত করে। (মুসনাদে আহমদ)
ওএফএফ/এএসএম