ইসলামের প্রথম পতাকা কোনটি?

ইসলাম ডেস্ক
ইসলাম ডেস্ক ইসলাম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৩৪ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২৩
ছবি: সংগৃহীত

হিজরতের সময় থেকে ইসলামে পতাকার প্রচলন ঘটে। যখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় যাচ্ছিলেন, তখন রাস্তায় বারিদা নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাত হয়। সে পুরস্কারের লোভে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধরতে এসেছিলো। কিন্তু সে নবিজিকে ধরতে এসে মুসলমান হয়ে তাঁর হিজরতের সঙ্গী হয়ে যান। এই বারিদাই প্রথম ইসলামের পতাকা তুলে ধরেন। এ সম্পর্কে হাদিসের একাধিক বর্ণনা রয়েছে। তাহলো-

১. হজরত বারিদা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, মদিনায় প্রবেশকালে আপনার একটি পতাকা থাকা দরকার। তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথা থেকে পাগড়ি খুলে, বর্শার মাথায় বেঁধে হজরত বারিদাকে দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় প্রবেশের সময় হজরত বারিদা রাদিয়াল্লাহু আনহু সেটিকে পতাকা হিসেবে ব্যবহার করেন। শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে ওই পতাকা ব্যবহার হয়েছিলো। এটাই ইসলামের প্রথম পতাকা। তবে বারিদা নিজের পাগড়িকেই পতাকা হিসেবে ব্যবহার করেছিলো বলে অনেক বর্ণনায় পাওয়া যায়। (যারকানি, শরহু মাওয়াহিবিল লাদুনিয়্যাহ)

২. হজরত ইবনুল আছির আল-জাজারি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল কামেল’ এ লেখেন, ‘হিজরতের প্রথম বছর সাত মাস অতিবাহিত হওয়ার পর, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় চাচা হজরত হামজার হাতে পতাকা ওঠিয়ে দেন। পতাকার রং ছিলো সাদা। বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিলো ত্রিশজন। তাদেরকে প্রেরণ করা হয়েছিলো কুরাইশদের একটি কাফেলাকে ধাওয়া করার জন্য। পথে আবু জাহেলের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। কিন্তু মাজদি ইবনে আমর আল-জুহানি নামক একজন নেতার মধ্যস্ততায় যুদ্ধ থেকে উভয় পক্ষ বিরত থাকে। মুসলমানদের পতাকাবাহী ছিলেন আবু মুরছাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু। ওই পতাকাই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বপ্রথম বেঁধেছিলেন।’ (আল কামেল ফীত তারিখ)

তবে দুই বর্ণনায় সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব এভাবে যে, যুদ্ধের পতাকা হিসেবে হামজা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর পতাকা ইসলামে সর্বপ্রথম। আর সাধারণ পতাকা হিসেবে হজরত বারিদা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর পতাকা প্রথম। আল্লাহ তাআলাই উত্তম জানেন।

নবিজির পতাকার রং কী ছিলো?

১. নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই ধরনের পতাকা ব্যবহার করতেন। ‘রায়া’ ওই পতাকা যা যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতির জন্য ব্যবহৃত হতো। এই পতাকার নিচে থেকেই বাহিনী যুদ্ধ করতো। যতক্ষণ পতাকা উড়তো ততক্ষণ যুদ্ধ চলতো। ময়দানে কখনো বিশৃঙ্খলা হলে নিজেদের সৈন্যদলকে চিহ্নিত করার মাধ্যম ছিলো এই পতাকা। বদর যুদ্ধে এই পতাকা ছিলো হজরত আলি ও সাদ ইবনে মুআজ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাতে। এই পতাকার রং ছিলো কালোর ভেতর সাদা দিয়ে ইসলামের কালেমা। (সুনানে আবু দাউদ)

২. দ্বিতীয় পতাকা ছিলো ‘লিওয়া’। এটা ছিলো রাষ্ট্রের প্রতীক। রাষ্ট্রপ্রধান বা ইমামুল মুসলিমিন এই পতাকা ব্যবহার করতেন। যুদ্ধের ময়দানে এই পতাকা বর্শার অগ্রভাগে বেঁধে রাখা হতো। বদর যুদ্ধে এই পতাকা ছিলো হজরত মুসআব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাতে। এই পতাকার রং ছিলো সাদার ভেতর কালো দিয়ে ইসলামের কালেমা।  হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘মক্কা বিজয়ের দিন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাতে সাদা পতাকা ছিলো।’ (আবু দাউদ)

দুই রঙের পতাকা ব্যবহারের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সাদা পতাকা ব্যবহার দ্বারা বুঝানো হয়েছে, ইসলাম সহজ-সরল জীবনব্যবস্থা। এর অনুসারীদের জীবন লৌকিকতা মুক্ত। এখানে ভীতিপ্রদর্শন, কঠোরতা ও বক্রতার কোনো স্থান নেই। এমন কি যারা ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিম হিসেবে বসবাস করবে, তাদের ওপরও কোনো চাপ প্রয়োগ করা যাবে না।

৩. নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুদ্ধের পতাকার রং ছিলো কালো। কালো হচ্ছে আতঙ্ক ও ভয়ের চিহ্ন। এর দ্বারা বিরোধীদেরকে বার্তা পৌঁছানো হতো যে, যারা সাম্য ও ন্যায়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের প্রতি ইসলাম কোনো রহম বা দয়া দেখাবে না। তারা শুধু ইসলামের কঠোরতাকে দেখতে পাবে।

৪. এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পতাকার বর্ণ হলুদ ছিলো। যেমন হজরত সেমাক ইবনে হারব নামক একজন সাহাবি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য হলুদ বর্ণের পতাকা দেখেছি।’ (আবু দাউদ)

৫. কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনু সুলাইম গোত্রকে লাল বর্ণের পতাকা দিয়েছিলেন।

সমাধান

আল্লামা আইনি বলেন, বর্ণনার এই বিরোধগুলোর সমাধান হচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন বর্ণের পতাকা ব্যবহার করতেন। তবে রাষ্ট্রীয় পতাকা হিসেবে সাদা এবং যুদ্ধের পতাকা হিসেবে কালো বর্ণের পতাকাই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন।

নবিজির পতাকার নাম কী ছিল?

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় পতাকার নাম রেখেছিলেন ‘উকাব’। উকাব আরবি শব্দ। বাংলা অর্থ হচ্ছে ঈগল। উর্দুতে বলা হয় শাহীন। এই শব্দ দ্বারা নামকরণের কারণ হচ্ছে, ‘উকাব’ পাখিদের সর্দার। কোনো পাখি এর সঙ্গে মোকাবিলা করার সাহস পায় না। ‘উকাব’ নির্ভীকতা, ক্ষীপ্রতা ও সৌখিনতার প্রতীক। নববি পতাকাবাহীদের মাঝেও এই গুণগুলোর সমাহার ঘটেছিলো। তাই এই শব্দে নামকরণ করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বেও বিভিন্ন দেশের পতাকায় ও বাহিনীর প্রতীকে ঈগলের ছবি ব্যবহার হয়। ঈগল নিয়ে বহু কবিতা ও সাহিত্য রচনা হয়েছে। প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবাল ঈগল নিয়ে বহু কবিতা রচনা করেছেন। মুসলিম যুবকদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘যখন মুসলমান নওজোওয়ানদের ভেতর ঈগলের আত্মা জাগবে বিশ্ব জয়ের নেশায় তারা মত্ত হয়ে যাবে।’

নবিজির পরবর্তী যুগে ইসলামের পতাকা

যুদ্ধের পতাকা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরবর্তী যুগেও কালো বর্ণের ছিলো। তবে রাষ্ট্রীয় পতাকায় সময়ে সময়ে পরিবর্তন এসেছে। প্রথম দুই যুগ অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর চার খলিফা এবং উম্মাইয়াদের সময়ে পতাকার রং আগের মতোই সাদা ছিলো। আব্বাসীয়াদের আমলে পতাকার রং ছিলো কালো। শীয়া মতাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত ফাতেমিদের পতাকার রং ছিলো সবুজ। উসমানীয়দের পতাকা ছিলো লালের মাঝে অর্ধচন্দ্র।

ইসলামে পতাকার মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরোধীদের সঙ্গে সরাসরি প্রায় সাতাশটি যুদ্ধ করেছেন। তাঁর প্রিয় সাহাবিদের দ্বারা চল্লিশেরও বেশি যুদ্ধ করিয়েছেন। সবকটি যুদ্ধে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে পতাকা বহনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সাতাশটি যুদ্ধের অন্যতম একটি ছিলো মুতার যুদ্ধ। বহু কারণে যুদ্ধটি ছিলো গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত : এতদিন মুসলমানদের যুদ্ধ ছিলো মক্কার মুশরিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। যারা যুদ্ধে কোনো প্রশিক্ষিত বাহিনী ছিলো না। অন্যদিকে মুতার যুদ্ধ ছিলো রোমানদের বিরুদ্ধে। যারা ছিলো তৎকালিন বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রশিক্ষিত যোদ্ধ।

দ্বিতীয়ত : এতদিন যত যুদ্ধ হয়েছে, তা ছিলো হেজাযের ভূমিতে। অর্থাৎ মদিনার আশপাশ এলাকায়। কিন্তু এবারের যুদ্ধ মদিনা থেকে বহু দূর সিরিয়ার অঞ্চলে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যায়ক্রমে চারজন সেনাপতি ঠিক করলেন। প্রথম সেনাপতি ছিলেন যায়েদ ইবনে হারেছা। তিনি পতাকা নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। তার শাহাদাতের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু সেনাপতি হলেন। তিনি প্রথমে ডান হাত হারান। তখন বাম হাতে পতাকা তুলে ধরেন। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর বাম হাতও কাটা পড়ে। তিনি তখন নিজের শরীরের সঙ্গে পতাকা চেপে ধরেন। তারপরও পতাকা ভুলুণ্ঠিত হতে দেননি। এভাবে তিনজন সেনাপতি শহিদ হয়েছেন, কিন্তু ইসলামের পতাকাকে ভুলুণ্ঠিত হতে দেননি। এটাই প্রমাণ করে পতাকার মর্যাদা রক্ষা করা গুরুত্ব কত বেশি।

পতাকা শুধু একটি কাপড়ই নয়...

কোনো জাতির পরিচয়ের জন্যও শুধু পতাকা নয়। বরং পতাকা হচ্ছে, জাতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, চিন্তা-চেতনার প্রতিনিধিত্বকারী। ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে সাম্য ও ভ্রাত্বের দাওয়াতকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া। আল্লাহর দ্বীনের গৌরব প্রতিষ্ঠা করা। জালেমকে প্রতিহত করা। মাজলুমকে সুরক্ষা দেয়া। তাই ইসলামের পতাকার পতন মানে মুসলমানদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথ বাধাগ্রস্ত হওয়া। অন্যদের সামনে মুসলমানদের নতজানু হওয়া। এই অন্তর্নিহিত কারণেই সাহাবায়ে কেরাম কখনো যুদ্ধের ময়দানে পতাকা ভুলুণ্ঠিত হতে দিতেন না। বাহ্যিক কারণও ছিলো। যে বাহিনীর পতাকার পতন ঘটে, ধরে নেওয়া হয় তারা পরাজিত হয়েছে। তখন সৈন্যবাহিনী যুদ্ধের হাল ছেড়ে দেয়।

উল্লেখ্য, ইসলামের ইতিহাসে পাওয়া যায় যে, সর্বপ্রথম পতাকা ব্যবহার করেছিলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। এরপর হজরত লুত আলাইহিস সালামকে সহযোগিতা করার জন্য কওমে লুতের বিপক্ষে তিনি যে বাহিনী প্রেরণ করেন তাদের হাতে তিনি একটি পতাকা তুলে দিয়েছিলেন।

এমএমএস/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।