জুমার প্রথম খুতবা: বাবা মায়ের প্রতি সদাচরণ

ইসলাম ডেস্ক
ইসলাম ডেস্ক ইসলাম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:৫৪ এএম, ১৪ জুলাই ২০২৩

আজ শুক্রবার। হিজরি বছরের শেষ মাস জিলহজের শেষ জুমা আজ। ১৪ জুলাই ২০২৩ ইংরেজি, ৩০ আষাঢ় ১৪৩০ বাংলা, ২৫ জিলহজ ১৪৪৪ হিজরি। আজকের জুমার আলোচ্য বিষয়- বাবা মায়ের প্রতি সদাচরণ।

প্রিয় মুসল্লিগণ!

বাবা-মা সন্তানের জন্য পৃথিবীতে আসার ওসিলা। তাই তাদের সম্মান করা, তাদের খেদমত বা সেবা-যত্ন করা সন্তানের একান্ত করণীয়। মানবতার ধর্ম ইসলাম সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচরণ করাকে ফরজ করেছেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ কোরআনে পাকে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। কী সেই নির্দেশ?

আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের করণীয় সম্পর্কে ঘোষণা করেন-

وَ قَضٰی رَبُّکَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا ؕ اِمَّا یَبۡلُغَنَّ عِنۡدَکَ الۡکِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوۡ کِلٰهُمَا فَلَا تَقُلۡ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّ لَا تَنۡهَرۡهُمَا وَ قُلۡ لَّهُمَا قَوۡلًا کَرِیۡمًا

‘আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত করবে না এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো।’ (সুরা ইসরা: আয়াত ২৩)

পরের আয়াতে মহান আল্লাহ বান্দাকে বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করার পদ্ধতি শিখিয়ে বলেন-

وَ اخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحۡمَۃِ وَ قُلۡ رَّبِّ ارۡحَمۡهُمَا کَمَا رَبَّیٰنِیۡ صَغِیۡرًا

‘আর তাদের উভয়ের জন্য দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, ‘হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা ইসরা: আয়াত ২৪)

আলোচ্য দুটি আয়াতে মহান আল্লাহ নিজের ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মায়ের প্রতি সদাচরণের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে তারা যখন বার্ধক্যে পৌঁছে তখন তাঁরা বেশি করুণার পাত্র হন। এমতাবস্থায় তাঁদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করা যাবে না যাতে তারা কষ্ট পায়। কষ্ট পেয়ে ‘উফ’ বলে। আর তাদের ধমক দেওয়া যাবে না। বরং নরম স্বরে কথা বলতে হবে। ভদ্র আচরণ করতে হবে। তাদের ইন্তেকালের পর তাদের জন্য দোয়া করতে হবে। বাবা-মায়ের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সুন্দর ও উত্তম আচরণ করতে হবে। 

বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য

বাবা মা জীবিত থাকলে তাদের সঙ্গে সুন্দর ও উত্তম আচরণ করতে হবে। তাদের মনে কষ্ট আসে এমন কোনো কাজ করা যাবে না। তাদের প্রতি সন্তানের একান্ত কিছু করণীয় রয়েছে। তাহলো-

জীবিত থাকা অবস্থায়

১. তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা।

২. তাদের সম্মান করা।

৩. তাদের কথা মেনে চলা।

৪. তাদের সঙ্গে নরম ভাষায় কথা বলা।

৫. বাবা-মাকে ধমক না দেওয়া।

৬. তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা।

৭. বাবা-মায়ের সঙ্গে এমন আচরণ না করা যাতে তারা কষ্ট পায়। কিংবা উহ্‌ বা উফ বলে।

ইন্তেকালের পর

বাবা-মা যদি জীবিত না থাকে। মৃত্যুবরণ করে তাদের প্রতিও রয়েছে কিছু করণীয়। তাহলো-
১. বাবা-মায়ের জন্য নিয়মিত আল্লাহর কাছে এভাবে প্রার্থনা করা-

رَّبِّ ارۡحَمۡهُمَا کَمَا رَبَّیٰنِیۡ صَغِیۡرًا

উচ্চারণ: ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।’

অর্থ: ‘হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া করুন; যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা ইসরা: আয়াত ২৪)

২. তাদের ঋণ পরিশোধ করা ও অসিয়ত পূর্ণ করা।

৩. তাদের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সুন্দর ও উত্তম আচরণ করা।

৪. তাদের কবর জিয়ারত করা।

৫. তাদের মধ্যস্থতামূলক আত্মীয়তা রক্ষা করা।

বাবা-মায়ের সঙ্গে সৎ ব্যবহারের ফজিলত ও গুরুত্ব

বাবা-মায়ের সঙ্গে সৎ ব্যবহার করা সন্তানের জন্য ফরজ বা আবশ্যক। তাদের কষ্ট দেওয়া হারাম বা নিষিদ্ধ। হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে-

اَلْجَنَّةُ تَحْتَ أقْدَامِ الأُمَّهَات

মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। অন্য হাদিসে হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনায় এসেছে-

رِضَا الرَّبِّ فِي رِضَا الْوَالِدِ، وَسَخَطُ الرَّبِّ فِي سَخَطِ الْوَالِدِ‏

বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর বাবার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।’ (আদাবুল মুফরাদ ২)

তাই বাবা-মায়ের খেদমত করতে হবে। কারণ তাদের খেদমতই জান্নাত পাওয়ার সহজ উপায়। ইবনে মাজাহর এক হাদিসে হজরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন-

هُمَا جَنَّتُكَ وَنَارُكَ

তারা (বাবা-মা) দুজন তোমাদের বেহেশত, তারাই তোমার জাহান্নাম। এ জন্য ইসলামি শরিয়তের খেলাফ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কথা মেনে চলতে হবে। এমনকি বাবা-মা অমুসলিম হলেও তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ اِنۡ جَاهَدٰکَ عَلٰۤی اَنۡ تُشۡرِکَ بِیۡ مَا لَیۡسَ لَکَ بِهٖ عِلۡمٌ ۙ فَلَا تُطِعۡهُمَا وَ صَاحِبۡهُمَا فِی الدُّنۡیَا مَعۡرُوۡفًا ۫ وَّ اتَّبِعۡ سَبِیۡلَ مَنۡ اَنَابَ اِلَیَّ ۚ ثُمَّ اِلَیَّ مَرۡجِعُکُمۡ فَاُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ

‘আর যদি তারা তোমাকে আমার সঙ্গে শিরক করতে জোর চেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়ায় তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে বসবাস করবে। আর অনুসরণ কর তার পথ, যে আমার অভিমুখী হয়। তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন আমি তোমাদের জানিয়ে দেব, যা তোমরা করতে।’ (সুরা লোকমান: আয়াত ১৫)

এ আয়াতে আল্লাহ অমুসলিম বাবা-মায়ের সঙ্গে দুনিয়ায় আচার-ব্যবহারের মূলনীতি ঘোষণা করেছেন-

وَ صَاحِبۡهُمَا فِی الدُّنۡیَا مَعۡرُوۡفًا

‘এবং দুনিয়ায় তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে বসবাস করবে।’

বাবা-মাকে কষ্ট দেওয়া কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘গুনাহ সমূহের শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহ যেগুলো ইচ্ছা করেন কেয়ামত পর্যন্ত পিছিয়ে যান কিন্তু বাবা-মায়ের হক নষ্ট করলে এবং তাদের প্রতি অবাধ্য আচরণ করলে তার শাস্তি পেছানো হবে না, বরং এ অপরাধের শাস্তি পরকালের আগে দুনিয়াতেই দেওয়া হয়।’ (তাফসিরে মাজহারি)

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে সেবাযত্নকারী সন্তান তার বাবা-মায়ের দিকে দয়া ও ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকায়, তার প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে সে একটি কবুল হজের সওয়াব পায়। লোকেরা আরজ করলো, সে যদি দিনে একশ বার এভাবে দৃষ্টিপাত করেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, একশতবার দৃষ্টিপাত করলে প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে এই সওয়াব পেতে থাকবে।’ (বায়হাকি)

বায়হাকির অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে বাবা-মায়ের আনুগত্য করে তার জন্য জান্নাতের দুটি দরজা খোলা থাকবে এবং যে ব্যক্তি তাদের অবাধ্য হবে তার জন্য জাহান্নামে দুটি দরজা খোলা থাকবে। এ কথা শুনে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো- জাহান্নামের শাস্তি কি তখনও প্রযোজ্য; যখন বাবা-মা ওই ব্যক্তির ওপর জুলুম করে? তিনি তিনবার বললেন, যদি বাবা-মা সন্তানের প্রতি জুলুমও করে, তবুও বাবা-মায়ের অবাধ্যতার কারণে সন্তান জাহান্নামে যাবে।’ (বায়হাকি)

প্রিয় মুসল্লিগণ!

এ কারণেই বাবা-মায়ের সব বৈধ আদেশ পালন করা সন্তানের জন্য ফরজ। তাদের সঙেগ খারাপ আচরণ করা যাবে না। তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে। তাদের খেদমত, যত্ন করতে হবে। অবৈধ ও গুনাহে কাজে তাদের কথা শোনা বৈধ নয়। এক হাদিসে এসেছে-

لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِىْ مَعْصِيَةِ الْخَالِق

‘সৃষ্টিকর্তার নাফরমানির কাজে কোনো সৃষ্ট জীবের আনুগত্য জায়েজ নেই।’

মনে রাখতে হবে

১. আল্লাহ তাআলা ছাড়া কারও ইবাদত করা যাবে না।

২. আল্লাহর অধিকার পরেই বাবা-মায়ের অধিকার।

৩. মা-বাবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা ফরজ।

৪. তাদের সঙ্গে কোনোভাবে খারাপ আচরণ করা যাবে না।

৫. তাদের ধমক দেওয়া যাবে না।

৬. তাদের সঙ্গে নরম ভাষায় কথা বলতে হবে।

৭. তাদের সেবা-যত্ন করতে হবে। এবং

৮. তাদের জন্য বেশি বেশি দোয়া করতে হবে।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বাবা-মায়ের অধিকারের ব্যাপারে কোরআন-সুন্নাহ নসিহত মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।