মিসওয়াক: প্রিয়নবির প্রিয় সুন্নাত
ফখরুল ইসলাম নোমানী
মিসওয়াক করা সুন্নত। উলামায়ে কেরামের মতে, মেসওয়াকের অভ্যাস করার মধ্যে যেসব উপকার আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘মৃত্যুর সময় কালেমা শাহাদাত নসীব হয়’। মিসওয়াক একটি সুন্নাহ। রাসুলে পাকের (সা.) আমলগুলোর মধ্য থেকে একটি আমল হলো মিসওয়াক। রাসুলে পাক (সা.) এর অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। ইন্তেকালের আগেও রাসুল (সা.) মিসওয়াক করেছেন। মিসওয়াক করা ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্যই সুন্নাত। শরীয়তের পরিভাষায়, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে ঘুম থেকে ওঠার পর এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে, ভাত খাওয়ার পর যে কোনো কাঁচাগাছের ডাল দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করাকে মিসওয়াক করা বলে। ইসলামি পরিচ্ছন্নতার অন্যতম একটি বিষয় হলো মিসওয়াক। যা মানুষের আত্মিক ও শারীরিক উভয় দিকের উপকার সাধন করে।
মিসওয়াক রাসুলের (সা.) অতি প্রিয় সুন্নাত। বিভিন্ন হাদিসে মিসওয়াক করার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল মুহাম্মদকে (সা.) বেশি বেশি মিসওয়াক করার নির্দেশ দিয়েছেন। আবু উমামা বাহেলি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যখনই জিবরাঈল (আ.) আমার কাছে আসতেন; তখনই আমাকে মিসওয়াক করার জন্য বলতেন। যাতে আমার ভয় হতে লাগল যে, মিসওয়াক করতে করতে আমি আমার মুখের সম্মুখ দিক ক্ষয় করে দেব।
রাসুলুল্লাহ (সা.) মিসওয়াকের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, আমার উম্মতের জন্য কষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না করতাম, তাহলে আমি মিসওয়াক করা ফরজ করে দিতাম। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার উম্মাতের ওপর যদি কষ্টকর মনে না করতাম। তাহলে তাদের প্রত্যেক সালাতের সময় দাঁতন (মিসওয়াক) করার নির্দেশ করতাম। হযরত আবু দারদা (রা.) বলেন, তোমরা নিজেদের জন্য মেসওয়াক করা অপরিহার্য করে নাও এবং এ ব্যাপারে উদাসীন হবে না। কেননা এতে চব্বিশটি উপকারিতা আছে।
আপনি যদি টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করেন। তাহলে শুধু মুখ পরিষ্কার করার সুন্নাত আদায় হবে কিন্তু টুথপেস্ট দ্বারা দাঁত ব্রাশ করার আগে বা পরে আপনি যে কোনো কাঁচা গাছের ডাল দ্বারা মিসওয়াক করলে মুখ পরিষ্কার করা ও মিসওয়াক করা উভয়রেই সুন্নাত আদায় হবে। পিলু বা আরক গাছ, জয়তুন গাছের কাঁচা ডাল দ্বারা মিসওয়াক করা সুন্নাত। উপমহাদেশে সাধারণত নিমগাছের ডাল দিয়ে মিসওয়াক করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে পাকিস্তান ও সৌদি আরব থেকে আমদানিকৃত জয়তুন বা পিলু গাছের মিসওয়াক পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্যাকেটবিহীন যে জয়তুন গাছের মিসওয়াক বিক্রি করা হয়, তার দাম ২০ টাকা। আপনারা এটি দ্বারা মিসওয়াক করবেন। এটি খুব ভালো।
আরও পড়ুন: নামাজে টুপি পরার বিধান কী?
মেসওয়াক করার সবচেয়ে বড় ১০টি উপকার হলো:
১. মেসওয়াক করলে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হন
২. নামাজের সওয়াব সাতাত্তর গুণ বৃদ্ধি পায়
৩. স্বচ্ছলতা আসে
৪. মুখ সুঘ্রাণ হয়
৫. দাঁতের মাড়ি শক্ত হয়
৬. মাথাব্যথা সেরে যায়
৭. চোয়ালের ব্যথা দূর হয়
৮. ফেরেশতাগণ মোসাফাহ করেন
৯. চেহারা উজ্জ্বল হয়
১০. দাঁত উজ্জ্বল হয়।
মেসওয়াক করার দশটি বিশেষ উপকারিতা:
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মেসওয়াকের মধ্যে দশটি গুণ আছে-
১. দাঁতের সবুজ রং দূর করে
২. দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে
৩. দাঁতের মাড়ি শক্ত করে
৪. মুখ পরিষ্কার করে
৫. কফ দূর করে
৬. ফেরেশতারা খুশি হন
৭. আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ হয়
৮. সুন্নাতের অনুসরণ করা হয়
৯. নামাজে সাওয়াব বৃদ্ধি পায়
১০. শরীর সুস্থ থাকে।
এসব কিছু মেসওয়াক দ্বারা লাভ হয়। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তোমরা মেসওয়াককে আঁকড়ে ধরো। কেননা এটি খুব ভালো জিনিস। দাঁতের হলুদ রং দূর করে, কফ শুকিয়ে ফেলে, চক্ষু পরিষ্কার করে, মাড়ি শক্ত রাখে, ময়লা দূর করে, পাকস্থলি সংশোধন করে, বেহেশতে মর্যাদা বাড়ায়, ফেরেশতাগণ তার প্রশংসা করে, আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট এবং শয়তানকে অসন্তুষ্ট করে।
ওলামায়ে কেরাম মেসওয়াকের বহু উপকারিতা বর্ণনা করেছেন:
আল্লামা ইবনে হাজার (রহ.) ‘মোনাব্বেহাত’ নামক গ্রন্থে মেসওয়াকের বিশটি উপকারিতা উল্লেখ করেছেন। নাহরুল ফায়েক কিতাবের লেখক ত্রিশটির কিছু বেশি উপকারিতা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে সর্বনিম্ন উপকারিতা হলো ময়লা দূর করা এবং সর্বোচ্চ উপকারিতা হলো মৃত্যুর সময় কালেমা স্মরণ হওয়া। আল্লামা হাসকাকী (রহ.) ‘দুররে মোখতার’ কিতাবে লিখেছেন, মেসওয়াক মৃত্যুর সময় কালেমায়ে শাহাদাত স্মরণ করিয়ে দেয় এবং মৃত্যু ছাড়া সব রোগের আরোগ্য দানকারী। নেহায়াতুল আমল কিতাবে আছে, মেসওয়াকের বাহাত্তরটি উপকারিতা আছে। তার মধ্যে একটি হলো মৃত্যুর সময় কালেমায়ে শাহাদাত স্মরণ হয়। অন্যদিকে ভাঙ (মাদকদ্রব্য) খাওয়ার দ্বারা সত্তরটি ক্ষতি আছে। তার মধ্যে একটি হলো মৃত্যুর সময় কালেমা স্মরণ হয় না।
আরও পড়ুন: দুনিয়ায় শান্তিময় জীবন পেতে কী করবেন?
আল্লামা তাহতাবী (রহ.) ‘মারাকিউল ফালাহ’র টিকার মধ্যে মেসওয়াকের উপকারিতা বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ইমামগণ মেসওয়াকের যে সমস্ত ফজিলত হজরত আলী (রা.), হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) ও হজরত আতা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তাহলো এই- তোমরা অবশ্যই মেসওয়াক করবে। এর ব্যাপারে কখনো উদাসীন হবে না এবং নিয়মিত মেসওয়াক করবে। কেননা মেসওয়াক করলে-
১. আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির ওয়াদা আছে
২. নামাজের সাওয়াব নিরানব্বই অথবা চারশ গুণ বেড়ে যায়
৩. নিয়মিত মেসওয়াক করার ফলে সচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়
৪. জীবিকা নির্বাহ সহজ হয়ে যায়
৫. মুখ পরিষ্কার হয়
৬. মাড়ি ব্যথা ও মাথার সর্বপ্রকার রোগ সেরে যায়
৭. মাথা ব্যথা ও মাথার সর্বপ্রকার রোগ সেরে যায়
৮. কোনো নিশ্চল রগ নড়াচড়া করে না এবং নড়াচড়াকারী কোনো রগ নিশ্চল হয় না
৯. কফ দূর হয়
১০. দাঁত শক্ত হয়
১১. দৃষ্টিশক্তি পরিষ্কার হয়
১২. পাকস্থলী ঠিক হয়
১৩. শরীর শক্তিশালী হয়
১৪. মানুষের বাকপটুতা, মুখস্থ শক্তি ও জ্ঞান বাড়ে
১৫. অন্তর পবিত্র হয়
১৬. পুণ্য বেড়ে যায়
১৭. ফেরেশতারা খুশি হন
১৮. চেহারার জ্যোতির কারণে ফেরেশতারা মোসাফাহ করেন
১৯. যখন সে মসজিদ থেকে বের হয়; তখন ফেরেশতারা পেছনে পেছনে চলে
২০. নবি ও রাসুলগণ তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন
২১. মেসওয়াক শয়তানকে অসন্তুষ্ট করে এবং তাড়িয়ে দেয়
২২. খাদ্য হজম করে
২৩. বেশি সন্তান জন্মায়
২৪. চুলের ন্যায় সরু পুলসেরাত বিজলির ন্যায় পার করে দেবে
২৫. বার্ধক্য পিছিয়ে দেয়
২৬. আমলনামা ডানহাতে দেবে
২৭. আল্লাহর ইবাদত করার জন্য শরীরে শক্তি দান করে
২৮. শরীর থেকে উষ্ণতা দূর করে
২৯. পিঠ মজবুত করে
৩০. মৃত্যুর সময় কালেমায়ে শাহাদাত স্মরণ করিয়ে দেয়
৩১. মৃত্যুকষ্ট অতি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়
৩২. দাঁত সাদা করে
৩৩. মুখে সুঘ্রাণ আনে
৩৪. কণ্ঠ পরিষ্কার করে
৩৫. জিহ্বা পরিষ্কার করে
৩৬. বুদ্ধি তীক্ষ্ণ করে
৩৭. আর্দ্রতা বন্ধ করে
৩৮. প্রয়োজন পুরা হতে সাহায্য করে
৩৯. কবর প্রশস্ত করে দেয় এবং মৃত্যুর জন্য সমবেদনাশীল হয়ে যায়
৪০. বেহেশতের দরজা খুলে দেওয়া হয়
৪১. ফেরেশতাগণ তার জন্য প্রতিদিন বলতে থাকে, এ ব্যক্তি নবীদের অনুসারী।
৪২. দোজখের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়
৪৩. মেসওয়াককারী দুনিয়া থেকে পবিত্র হয়ে যান
৪৪. মৃত্যুর ফেরেশতা তার কাছে এমন ছুরতে হাজির হন, যেভাবে কোনো ওলি বা নবির কাছে হাজির হন। ৪৫. মেসওয়াককারী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাউজ হতে পানি পান করার আগে মৃত্যুবরণ করবেন না।
আরও পড়ুন: সুসম্পর্ক নষ্ট করা কি অপরাধ?
মেসওয়াকের আরও উপকারিতা হাদিস ও ফেকাহের কিতাবে উল্লেখ আছে। আল্লামা তাহতাবী একটি নতুন কথা লিখেছেন, মেসওয়াক করলে বেশি পরিমাণ বীর্য সৃষ্টি হয়। ইমাম তিরমিজি ও ইমাম হাকেম বলেছেন, মেসওয়াক করার সময় একেবারে প্রথমবারের লালা গিলে ফেলবে। কেননা এতে কুষ্ঠরোগ থেকে বাঁচা যায়। মৃত্যু ছাড়া সব রোগ থেকেও বাঁচা যায়। তবে প্রথমবারের পর আর গিলবে না। কেননা এতে স্মৃতিশক্তি কমে যায়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের নিয়মিত মিসওয়াক করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।
এসইউ/জেআইএম