পবিত্র জিলহজ মাসের ফজিলত ও আমল
ফখরুল ইসলাম নোমানী
পবিত্র জিলহজ মাস মানে হজের মাস। হজের তিনটি মাস শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। এর মধ্যে প্রধান মাস হলো জিলহজ মাস। এই মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ-এই ছয় দিনেই হজের মূল কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হজ সম্পাদন সুবিদিত মাসসমূহে। অতঃপর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রীসম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নহে। তোমরা উত্তম কাজে যা কিছু করো আল্লাহ তা জানেন এবং তোমরা পাথেয়ের ব্যবস্থা করবে আত্মসংযমই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ তোমরা আমাকে ভয় করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৯৭)।
বছরের বারো মাসের চারটি মাস বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন। এই চার মাসের অন্যতম হলো জিলহজ মাস। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারোটি যা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী সেই দিন থেকে চালু আছে; যেদিন আল্লাহ তাআলা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। এই চার মাস হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। এসব মাসে যুদ্ধবিগ্রহ, কলহ-বিবাদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিশেষ কিছু দিন এবং রাত এমন আছে, যেসব দিন ও রাতের ইবাদত-বন্দেগিতে মহান আল্লাহ তাআলা অপরাধীর অপরাধ ক্ষমা করেন। তার মধ্যে কদরের রাত, বরাতের রাত, দুই ঈদের রাত, রমজানের আমল, আশুরার আমল, জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের আমল ইত্যাদি। এ দিনগুলোর আমল-ইবাদত ইখলাসের সঙ্গে করলে আল্লাহ তাআলা বান্দার গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। এসব দিন ও রাতে বান্দার তাওবায় আল্লাহর রহমতের দরজা খুলে যায়।
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের আছে বিশেষ আমল। পবিত্র জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত দিনে রোজা পালন করা, রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা উচিত। যথা: নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-দরুদ, তওবা-ইস্তিগফার ইত্যাদি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জিলহজের ১০ দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে অন্য দিনের ইবাদতের তুলনায় বেশি প্রিয় প্রতিটি দিনের রোজা এক বছরের রোজার মতো আর প্রতি রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের মতো। হিজরি সালের সর্বশেষ মাস জিলহজ। মহান আল্লাহ এ মাসকে সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহর ঘরে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মুসলিমরা এসে জড়ো হন। এ মাসের প্রথম ১০ দিন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ।
আরও পড়ুন: হজ পালনকারীরা মক্কায় এখন যেসব আমল করবেন?
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমার প্রতি আজহার দিন (১০ জিলহজ) ঈদ পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যা আল্লাহ এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনি বলুন যদি আমার কোরবানির পশু কেনার সামর্থ না থাকে কিন্তু আমার কাছে এমন উট বা বকরি থাকে, যার দুধ পান করা বা মাল বহন করার জন্য তা প্রতিপালন করি। আমি কি তা কোরবানি করতে পারি? তিনি বললেন, না। বরং তুমি তোমার মাথার চুল, নখ, গোঁফ কেটে ফেলো এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করো। এটি আল্লাহর কাছে তোমার কোরবানি।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এই দিনগুলোর (অর্থাৎ জিলহজের প্রথম ১০ দিনের) তুলনায় এমন কোনো দিন নেই যাতে কোনো সৎ কাজ আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। লোকেরা বলল, আল্লাহর পথে জিহাদও নয় কি? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে কোনো (মুজাহিদ) ব্যক্তি যদি তার জান-মালসহ বের হয়ে যায় এবং তার কোনো কিছুই নিয়ে আর ফিরে না আসে। (অর্থাৎ শাহাদতবরণ করে তাহলে হয়তো তার সমান হতে পারে)।
হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! এ কোরবানি কী? উত্তরে তিনি বললেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের (আ.) সুন্নত। তারা পুনরায় বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! তাতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন, কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি সওয়াব রয়েছে। তারা আবারও প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! ভেড়ার লোমের কী হুকুম? এটা তো গণনা করা সম্ভব নয়। তিনি বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি সওয়াব রয়েছে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না। সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর একবার তাকবির বলা ওয়াজিব। পুরুষেরা স্বাভাবিক স্বরে আর মহিলারা নিচু স্বরে এ তাকবির বলবেন। তাকবির হলো, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’
আরও পড়ুন: উত্তম আচরণ ও সুন্দর কথা বলতে নবিজির (সা.) উপদেশ
দুনিয়ার সেরা আত্মত্যাগের মাস জিলহজ। এ মাসেই হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তান হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে কোরবানির মাধ্যমে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তাঁর এ ধারা মুসলিম উম্মাহ কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রাখবেন। এ কারণেই আমল ও ফজিলতে মর্যাদাসম্পন্ন মাস জিলহজ। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জিলহজ মাসের প্রথম দশকের নেক আমল আল্লাহর কাছে যত বেশি প্রিয় আর কোনো দিনের আমল তাঁর কাছে তত প্রিয় নয়। সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন, জিহাদ কি এই দশকের আমল থেকে উত্তম নয়? তিনি বললেন, না। আল্লাহর পথে জিহাদও এই দশকের আমলের তুলনায় উত্তম নয়। তবে ওই ব্যক্তি (জিহাদের চেয়ে উত্তম) যে নিজের জান ও মাল নিয়ে বেরিয়ে গেল এবং শেষে কিছুই ফিরে এলো না (সে শহীদ হলো)।
জিলহজ মাসের আমল সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিস থেকে যা পাওয়া যায়, তা হলো- মহানবি (সা.) বলেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোরবানি করতে চায়, সে যেন জিলহজের চাঁদ দেখার পর চুল ও নখ না কাটে (ইবনে-মাজাহ)। তাই জিলহজ মাসে প্রবেশ করার আগেই আমাদের চুল ও নখ কেটে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে। জিলহজ মাসের প্রথম দশকের আমল আল্লাহর কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাশীল যে মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেককেই বেশি বেশি নেক আমল করা উচিত। আল্লাহর দেওয়া বিধানগুলো যথাযথ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে সুন্নাত, নফল, মোস্তাহাব ও নফল নামাজ আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, দান-অনুদান, সাহায্য-সহায়তা বেশি বেশি করা জরুরি। যাতে সে সময়গুলোতে বান্দা বেশি বেশি ইবাদত করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে; নিজেদের পাপ ও গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারে। এমনই এক বিশেষ সময় হলো জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন। দিনগুলোকে রাসুল (সা.) বছরের শ্রেষ্ঠ দিন বলে আখ্যা দিয়েছেন।
পবিত্র হজ ও কোরবানির মাস জিলহজ। এটি হিজরি বছরের শেষ মাস। এই হিজরি মাসের ৯ তারিখ সারাবিশ্ব থেকে আগত মুসলিম উম্মাহ আরাফায় একত্রিত হন। পরদিন বিশ্বব্যাপী সবাই কোরবানি করেন। ১৯ জুন সন্ধ্যায় জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা গেছে, সে হিসেবে ২৯ জুন যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদের নামাজের পর মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করে মুসলিম উম্মাহ।
আরও পড়ুন: কোরবানির পর আমল ও করণীয়
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের আছে বিশেষ আমল। আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবানি যে, তিনি আমাদের মতো পাপী-তাপী বান্দাদের জন্য স্বীয় অনুগ্রহে এমন সব নেক আমল করার সুযোগ দিয়েছেন। তাই এ সুযোগের সদ্বব্যহার করা অত্যন্ত জরুরি। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত মহানবি (সা.) বলেন, অতএব তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ),তাকবির (আল্লাহু আকবার) এবং তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) পড়বে।
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের জিলহজ মাসের বরকত থেকে কল্যাণমণ্ডিত হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন। আল্লাহ যেন আমাদের জীবনে অন্তত একবার হলেও তার ঘর জিয়ারত করার তৌফিক দান করেন। সবাইকে হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে যথাসময়ে হজ পালন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।
এসইউ/জেআইএম