ফজরের নামাজের উপকারিতা ও ফজিলত
ফখরুল ইসলাম নোমানী
ফজরের নামাজ দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে উত্তম। ফজর মানে এক রাশ স্নিগ্ধতা। ইসলাম যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে নামাজ তার অন্যতম। ঈমানের পর নামাজের গুরুত্ব সর্বাগ্রে। নামাজ জীবনে সফলতা বয়ে আনে। পবিত্র ও আলোকিত জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করে। কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার নামাজের হিসাব হবে। যদি নামাজ ঠিক হয় তবে তার সব আমল সঠিক বিবেচিত হবে। আর যদি নামাজ বিনষ্ট হয় তবে তার সব আমলই বিনষ্ট বিবেচিত হবে।
নামাজ এমন এক ইবাদত যা সারা বছর দৈনিক পাঁচবার আদায় করতে হয়। মৃত্যু ছাড়া আর কোনো অবস্থাতেই নামাজ মাফ হয় না। এমনকি মৃত্যুশয্যায় স্বাভাবিক জ্ঞান থাকা অবস্থায় নামাজ থেকে বিরত থাকার কোনো বিধান নেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে ফজরের নামাজের গুরুত্ব আরও বেশি। ফজরের নামাজে দাঁড়ানো সারা রাত দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার সমান।
হজরত উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,, যে ব্যক্তি জামাতের সঙ্গে এশার নামাজ আদায় করলো সে যেন অর্ধেক রাত জেগে নামাজ পড়লো। আর যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়লো সে যেন পুরো রাত জেগে নামাজ পড়লো। ওই দিনের পুরোটা আল্লাহর জিম্মায় থাকার সৌভাগ্য হয়।
ফজরের নামাজ পড়লেই শুধু এ ঈর্ষণীয় সৌভাগ্য লাভ করা সম্ভব। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করলো সে আল্লাহর জিম্মায় চলে গেল। অতএব আল্লাহ যেন তার জিম্মার বিষয়ে তোমাদেরকে কোনোরূপ অভিযুক্ত না করেন।’ (তিরমিজি ২১৮৪)
ফজরের নামাজ কেয়ামতের দিন নূর হয়ে দেখা দেবে। হজরত বুরাইদা আল আসলামি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যারা আঁধারে (ফজর নামাজে) মসজিদের দিকে হেঁটে যায় তাদের কেয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূর প্রাপ্তির সুসংবাদ দাও।’ (আবু দাউদ ৪৯৪)
ফজরের নামাজ পড়লেই জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত প্রাপ্তির সুসংবাদ। হজরত আবু জুহাইর উমারা ইবনে রুয়াইবা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে ব্যক্তি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের আগে (ফজর ও আসরের নামাজ) আদায় করবে সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম ৬৩৪)
মুনাফেকি থেকে মুক্তি পাবে। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুনাফেকদের ওপর ফজর ও এশার নামাজ অপেক্ষা অধিক ভারী নামাজ আর নেই। যদি তারা এর ফজিলত ও গুরুত্ব জানত তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে বা পাছার ভরে অবশ্যই (মসজিদে) উপস্থিত হতো (বুখারি-৬৫৭)।
ফজরের নামাজ পড়লেই সরাসরি আল্লাহর দরবারে নিজের নাম আলোচিত হবে। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কাছে পালাক্রমে দিনে ও রাতে ফেরেশতারা আসে। তারা আসর ও ফজরের সময় একত্র হয়। যারা রাতের কর্তব্যে ছিল তারা উপরে উঠে যায়। আল্লাহ তো সব জানেন তবুও ফেরেশতাদের প্রশ্ন করেন আমার বান্দাদেরকে কেমন রেখে এলে ? ফেরেশতারা বলে আমরা তাদেরকে নামাজরত রেখে এসেছি। যখন গিয়েছিলাম তখনো তারা নামাজরত ছিল।’ (বুখারি ৫৪০)
দুনিয়া ও আখিরাতের সেরা বস্তু অর্জিত হয়। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ফজরের দুই রাকাত দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। (মুসলিম ১২৪০)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ফজরের দুই রাকাত নামাজ দুনিয়া ও তার সব কিছুর চেয়ে উত্তম।
ফজরের নামাজ পড়লেই পরিপূর্ণ এক হজ ও ওমরাহর সওয়াব পাবে যদি সে সূর্য ওঠা পযর্ন্ত আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকে। হজরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি জামাতের সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায়ান্তে বসে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থেকে সূর্যোদয়ের পর দুই রাকাত নফল নামাজ (ইশরাক) আদায় করবে সে পরিপূর্ণ এক হজ ও ওমরাহর সওয়াব পাবে। ‘পরিপূর্ণ’ এ শব্দটি তিনি (নবিজি সা.) তিনবার বলেছেন।’ (তিরমিজি ৫৮৬)
ফজরের নামাজ পড়লেই কেয়ামতের দিন সরাসরি আল্লাহকে দেখার সৌভাগ্য পাওয়া যাবে। আর এটি হচ্ছে সর্বোত্তম পুরস্কার। হজরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ আল বাজলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, এক রাতে আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ছিলাম। হঠাৎ তিনি পূর্ণিমার রাতের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোনো! নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে তেমনি স্পষ্ট দেখতে পাবে যেমন স্পষ্ট ওই চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ। তাকে দেখতে তোমরা কোনো ভিড়ের সম্মুখীন হবে না। কাজেই তোমরা যদি সূর্য ওঠার আগের নামাজ ও সূর্য ডোবার আগের নামাজ আদায়ে সমর্থ হও তাহলে তাই করো। তারপর তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের আগে আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসার তাসবিহ পাঠ করুন। (বুখারি ৫৭৩)
হাশরের মাঠে মানুষ অন্যরকম এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। সবাই অস্থির ও পেরেশান থাকবে। বিশেষ করে পুলসিরাত পার হওয়ার সময় অন্ধকার দূর করার জন্য আলোর দরকার হবে। সেদিন যার যার আমল হবে নূর ও আলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ভোরে হেঁটে ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে প্রবেশ করবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাকে পরিপূর্ণ আলো দান করবেন।’ (আবু দাউদ ৪৯৪)
ফজরের সুন্নতের ফজিলত
প্রত্যেক ফরজ নামাজের আগে-পরে যেসব সুন্নত নামাজ রয়েছে এর সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ সুন্নত হলো ফজরের দুই রাকাত সুন্নত। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ফজরের দুই রাকাত সুন্নত দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম।’ (মুসলিম ৭২৫)
তা ছাড়া ফজরের সুন্নতের ব্যাপারে ইসলামের বিশেষ নির্দেশনাও আছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা এই দুই রাকাত নামাজ কখনও ত্যাগ করো না; এমনকি শত্রুবাহিনী তোমাদের তাড়া করলেও ‘ (আবু দাউদ ১২৫৮)
তবে কখনও যদি ফজরের জামাত দাঁড়িয়ে যায় আর দ্বিতীয় রাকাত পাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে তাহলে সুন্নত মসজিদের বাইরে পড়ে নেওয়া উত্তম। তবে কেউ যদি মসজিদের ভেতরে নামাজের কাতার থেকে দূরে এক কোণে বা খুঁটির আড়ালে পড়ে সেটাও জায়েজ। কিন্তু জামাতের কাতারে বা তার কাছে পড়া মাকরুহে তাহরিমি।
ফজর নামাজ আদায়ের জাগতিক উপকারের কথা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে বলেছেন যে, তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পশ্চাদংশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে এ বলে চাপড়ায় তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত অতএব তুমি শুয়ে থাকো। এরপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে একটি গিঁট খুলে যায়; অজু করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়; এরপর নামাজ আদায় করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। তখন তার প্রভাত হয় উত্ফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। অন্যথায় সে সকালে ওঠে কলুষ কালিমা ও আলস্য নিয়ে।’ (বুখারি ১১৪২)
ফজর মানে এক রাশ স্নিগ্ধতা। ফজর মানে হৃদয়জুড়ে ভালো লাগার অনির্বচনীয় অনুভূতি। ফজরের নামাজ আদায় করা মানে দিনের শুরুতে আমাদের চিরশত্রু শয়তানের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করা। ফলে সারাদিন জয়ের অনুভূতি নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে কাজ করা সহজ হয়ে যায়। কাজে মনোযোগিতা বাড়ে। এভাবে ফজরের নামাজ জীবন জুড়ে সফলতার ফল্গুধারা বয়ে আনে।
তাই আসুন গুরুত্বসহকারে স্নিগ্ধ ফজরে জেগে উঠি। নিয়মিত ফজরের নামাজ ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মনোযোগী হয়ে পবিত্র আলোকিত ও সুরভিত জীবন গড়ে তুলি।
আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতায়ালা আমাদের ফজরের নামাজ আদায়ের মাধ্যমে উপরোক্ত সব নিয়ামতের ভাগীদার করুন। আমিন।
লেখক: ইসলামি চিন্তক ও গবেষক।
এমএমএস/জিকেএস