জিলহজের প্রথম দশ দিন যেসব আমল করা মোস্তাহাব
জিলহজ মাস ইবাদতের মাস। হজের মাস। তাকবিরের মাস। নফল আমলের মাস। রোজা রাখার মাস। তওবা ইসতেগফারের মাস। এ মাসের যে কোনো আমলই মর্যাদাপূর্ণ। এ মাসের প্রথম ১০ দিন কিছু গুরুত্বপূর্ণ মোস্তাহাব আমল আছে; যার ফজিলত অনেক বেশি। তা তুলে ধরা হলো-
১. তওবা
তওবা অর্থ ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। আল্লাহ তাআলার নাফরমানি থেকে ফিরে আসা, আল্লাহর হুকুমের পাবন্দি করার উপর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা এবং অতীতের কৃত কর্মের উপর অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তা ছেড়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে আর কখনও আল্লাহর নাফরমানি না করা ও তার হুকুমের অবাধ্য না হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হওয়া। এ দিন গুলোতে তওবা করে আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ تُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ تَوۡبَةٗ نَّصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمۡ سَئَِّاتِكُمۡ وَيُدۡخِلَكُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ يَوۡمَ لَا يُخۡزِي ٱللَّهُ ٱلنَّبِيَّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَعَهُۥۖ نُورُهُمۡ يَسۡعَىٰ بَيۡنَ أَيۡدِيهِمۡ وَبِأَيۡمَٰنِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَآ أَتۡمِمۡ لَنَا نُورَنَا وَٱغۡفِرۡ لَنَآۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ
‘হে মোমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর- বিশুদ্ধ তওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সে দিন আল্লাহ লজ্জা দেবেন না নবিকে এবং তার মুমিন সঙ্গীদেরকে, তাদের জ্যোতি তাদের সম্মুখে ও দক্ষিণ পার্শ্বে ধাবিত হবে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জ্যোতিকে পূর্ণতা দান করো এবং আমাদের ক্ষমা করো, নিশ্চয় তুমি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ (সুরা তাহরিম: আয়াত ৮)
২. ফরজের সঙ্গে নফল নামাজও গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করা
ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ সময় মতো সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, যেভাবে আদায় করেছেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সকল ইবাদতসমূহ তার সুন্নত, মুস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা। ফরজ নামাজগুলো সময় মতো সম্পাদন করা, বেশি বেশি করে নফল নামাজ আদায় করা। যেহেতু এগুলোই আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার সর্বোত্তম মাধ্যম।
হজরত সওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘তুমি বেশি বেশি সেজদা করো, কারণ তুমি এমন যে কোনো সেজদাই করো না কেন তার কারণে আল্লাহ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং তোমার গুনাহ ক্ষমা করবেন। (মুসলিম)
এটা সব সময়রে জন্য প্রযোজ্য। নিয়মিত ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ আদায়ে যত্নবান হওয়া- অর্থাৎ, ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ সময় মতো সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা। যেভাবে আদায় করেছেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সকল ইবাদতসমূহ তার সুন্নত, মোস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন-
من عادى لي وليا فقد آذنته بالحرب، وما تقرب إلي عبدي بشيء أحب إلي مما افترضته عليه، وما يزال عبدي يتقرب إلي بالنوافل حتى أحبه، فإذا أحببته كنت سمعه الذي يسمع به، وبصره الذي يبصر به، ويده التي يبطش بها، ورجله التي يمشي بها، وإن سألني لأعطينه، ولئن استعاذ بي لأعيذنه ، وما ترددت عن شيء أنا فاعله ترددي عن نفس المؤمن ، يكره الموت وأنا أكره مساءته
‘যে ব্যক্তি আমার কোনো বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা রাখে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার বান্দা ফরজ ইবাদতের চাইতে আমার কাছে অধিক প্রিয় কোনো ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারাই সর্বদা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই, আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। সে আমার কাছে কোনো কিছু চাইলে আমি অবশ্যই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায় আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দেই। আমি যে কোনো কাজ করতে চাইলে তাতে কোনো রকম দ্বিধা করি না, যতটা দ্বিধা করি মুমিন বান্দার প্রাণ হরণে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে থাকে অথচ আমি তার প্রতি কষ্টদায়ক বস্তু দিতে অপছন্দ করি।’ (বুখারি ৬৫০২)
৩. রোজা রাখা
জিলহজ মাসরে প্রথম দশ দিনের রোজা রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। যেহেতু অন্যান্য নেক আমলরে মধ্যে রোজাও অন্যতম। তাই এ দিনগুলোতে খুব যত্নসহকারে রোজা পালন করা। হজরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন-
أربع لم يكن يدعهن النبي- صلى الله عليه وسلم-: صيام عاشوراء، والعشر، وثلاثة أيام من كل شهر والركعتين قبل الغداة
‘নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো চারটি আমল পরিত্যাগ করেননি। সেগুলো হলো- আশুরার রোজা, জিলহজের দশ দিনের রোজা, প্রত্যেক মাসে তিন দিনের রোজা, ও ফজরের আগের দুই রাকাত নামাজ।’ (মুসনাদে আহমদ ৬/২৮৭, আবু দাউদ ২১০৬, নাসাঈ ২২৩৬)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন-
ما من عبد يصوم يوماً في سبيل الله إلا باعد الله بذلك اليوم وجهه عن النار سبعين خريفاً
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোজা রাখবে, একদিনের রোজার বিনিময় তার চেহারাকে জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর খারিফ দূরে রাখা হবে।’ (বুখাবি ২৮৪০, মুসলিম ১১৫৩)
৪. হজ ও ওমরা করা
জিলহজ মাস হজের নির্ধারিত মাস। এ মাস ছাড়া হজ হয় না। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দুটি মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের জন্য উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। এ দুটি ইবাদতে রয়েছে পাপের কুফল থেকে আত্মার পবিত্রতা, যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হতে পারে। তাই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
من حج فلم يرفث ولم يفسق رجع كيوم ولدته أمه
‘যে ব্যক্তি হজ করেছে, তাতে কোনো অশ্লীল আচরণ করেনি ও কোনো পাপে লিপ্ত হয়নি সে সে দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে গেল, যে দিন তার মা তাকে প্রসব করেছে।’ (বুখারি ১৪৪৯, মুসলিম ১৩৫০)
হজরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
العمرة إلى العمرة كفارة لما بينهما، والحج المبرور ليس له جزاء إلا الجـنة
‘এক ওমরাহ থেকে অন্য ওমরাহকে তার মধ্যবর্তী পাপসমূহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আর কলুষযুক্ত হজের পুরস্কার হল জান্নাত।’[6]
৫. আল্লাহর জিকির করা
এ দিনসমূহে অন্যান্য আমলের মাঝে জিকিরের এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
ما من أيام أعظم عند الله ولا أحب إليه من العمل فيهن من هذه العشر، فأكثروا فيهن من التهليل والتكبير والتحميد
‘এ দশ দিনে [নেক] আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে অধিক প্রিয় ও মহান আর কোনো আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবির (আল্লাহু আকবার) তাহমিদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি করে আদায় করো।’ (মুসনাদে আহমদ ১৩২)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-
لِّيَشۡهَدُواْ مَنَٰفِعَ لَهُمۡ وَيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡلُومَٰتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۖ
‘যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।’ (সুরা হজ: আয়াত ২৮)
অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারগণ বলেছেন, ‘এ আয়াতে নির্দিষ্ট দিন বলতে জিলহজের প্রথম দশ দিনকে নির্দেশ করা হয়েছে। এ সময়ে আল্লাহর বান্দাগণ বেশি বেশি করে আল্লাহর প্রশংসা করেন। তার পবিত্রতা বর্ণনা করেন। তার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেন। কোরবানির পশু জবাই করার সময় আল্লাহর নাম ও তাকবির উচ্চারণ করে থাকেন।
হাদিসে ৪টি বাক্যকে আল্লাহ তাআলার কাছে অধিক প্রিয় বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হজরত সামুরা বিনতে জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কথা হলো চারটি-
>> সুবহানাল্লাহ (سُبْحانَ الله)
>> আলহামদুলিল্লাহ (اَلْحَمْدُ لِله)
>> লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (لَا اِلَهَ اِلَّا الله) এবং
>> আল্লাহু আকবার (اَللهُ اَكْبَر)।
এর যে কোনো একটির দ্বারাই (জিকির) আরম্ভ করা যেতে পারে। (মুসলিম)
৬. তাকবিরে তাশরিক পড়া
এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহত্ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবিরে তাশরিক পড়া সুন্নত। এ তাকবির প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদ, বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, বাজার সহ সর্বত্র উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা হবে। তবে মেয়েরা নিম্ন-স্বরে তাকবির পাঠ করবে। তাকবির হলো-
اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ وَاَللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ
উচ্চারণ: ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর; লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু; ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর; ওয়ালিল্লাহিল হামদ্।’
অর্থ: ’আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; সব প্রশংসা মহান আল্লাহ জন্য।’
সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হজরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু জিলহজ মাসের প্রথম দশকে বাজারে যেতেন ও তাকবির পাঠ করতেন, লোকজনও তাদের অনুসরণ করে তাকবির পাঠ করতেন। অর্থাৎ আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই দুই প্রিয় সাহাবি লোকজনকে তাকবির পাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। (বুখারি)
ইমাম বুখারি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, হজরত ইবনে ওমর ও হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ দশ দিন তাকবির বলতে বলতে বাজারের জন্য বের হতেন, মানুষরাও তাদের দেখে দেখে তাকবির বলতো। তিনি আরও বলেছেন, ইবনে ওমর মিনায় তার তাবুতে তাকবির বলতেন, মসজিদের লোকেরা শুনতো, এরপর তারা তাকবির বলতো এবং বাজারের লোকেরাও তাদের সঙ্গে তাকবির বলতো। এক পর্যায়ে পুরো মিনা তাকবির ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত।
হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ দিনগুলোতে মিনায় তাকবির বলতেন, প্রত্যেক নামাজের পর, বিছানায়, তাঁবুতে মজলিসে ও চলার পথে সশব্দে তাকবির বলা মোস্তাহাব। যেহেতু ওমর, ইবনে ওমর ও আবু হুরায়রা সশব্দে তাকবির বলেছেন।
৭. আরাফার দিন রোজা রাখা
হজ পালনকারী ছাড়া অন্যদের জন্য আরাফার দিন রোজা রাখা। হজরত আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আরাফার দিনের রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন-
احتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله والسنة التي بعده
‘আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, ইহা পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারা হবে।’ (মুসলিম ১১৬৩)
এমএমএস/এএসএম