তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

ইসলাম ডেস্ক
ইসলাম ডেস্ক ইসলাম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:২৬ পিএম, ১৩ মে ২০২৩

আ স ম আল আমিন

পৃথিবীতে আমরা যা কিছু দেখি, সবই আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। তৃতীয় লিঙ্গরাও আমাদের মতো মানুষ। মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রেষ্ঠতম-সুন্দর আকৃতিতে।’ ( সুরা ত্বীন: ৩) অন্য আয়াতে বলেন, ‘আসমান ও জমিনের রাজত্ব আল্লাহরই, যা চান তিনি সৃষ্টি করেন। যাকে চান কন্যাসন্তান দেন, যাকে চান পুত্রসন্তান দেন।’ (আশ শুরা: ৪৯)। তবে আল্লাহর সব ধরনের ইচ্ছা ও খেয়ালের পেছনে হেকমত ও তাৎপর্য আছে। তিনি এমনি এমনি সব ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেননি। তিনি একজনকে চোখ দেননি, এটি চক্ষুষ্মানের জন্য শিক্ষা। আল্লাহ বলছেন, ‘তোমাকে আমি চোখ দিয়েছি, তুমি আমার সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখতে পারছো; কিন্তু যে দেখতে পারে না তার কথা ভেবে দেখ, আমি তোমাকে কত করুণা করেছি।’

তেমনি আল্লাহ তাআলা একজনকে দেননি, আবার আরেকজনকে দিয়েছেন। যাকে দিয়েছেন, সে যেন তার লিঙ্গকে বৈধ পথে ব্যবহার করে, জেনা থেকে বেঁচে থাকে। আর ভাবে, আমাকেও তো আল্লাহ লিঙ্গহীন করে বানাতে পারতেন। তাই এ দুনিয়ার সামান্য থেকে সামান্য, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র, কিছুর সৃষ্টিই মহান আল্লাহর হেকমতের বাইরে নয়। ‘তিনিই মহান সত্তা, যিনি মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা আল ইমরান: ৬)

তৃতীয় লিঙ্গের মর্যাদা
আল্লাহ তাআলা কাউকে পুরুষ, কাউকে নারী, আবার কাউকে বানিয়েছেন একটু ভিন্ন করে। যেমন লিঙ্গপ্রতিবন্ধী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। কিন্তু তারাও সৃষ্টির সেরা জীব অর্থাৎ আশরাফুল মাখলুকাত। আর মহান আল্লাহর কাছে বান্দার শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া। তিনি ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে বেশি তাকওয়াসম্পন্ন।’ (সুরা হুজরাত: ১৩)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি এবং সহায়-সম্পত্তির প্রতি লক্ষ্য করেন না বরং তিনি লক্ষ্য করেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি।’ (মুসলিম: ৬৭০৮)

অতএব ইসলামি মূল্যবোধ এবং সুমহান আদর্শের আলোকে এটাই প্রমাণিত হয়, লিঙ্গপ্রতিবন্ধীদের এ পরিমাণ সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে, যে পরিমাণ সম্মাান ও মর্যাদা রয়েছে একজন সুস্থ-সবল সাধারণ মুসলিমের। এমনকি ইসলামি শরীয়তে একজন মুমিন-মুত্তাকি, পরহেজগার তৃতীয় লিঙ্গ; শত-সহস্র কাফের-ফাসেক ও মুত্তাকি নয় এমন নর-নারী থেকে উত্তম।

আরও পড়ুন: যেসব স্বভাব থাকলে সংসারে উন্নতি হয় না 

উপহাস করা যাবে না
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেনে, ‘হে মুমিনগণ! কেউ যেন অন্য কাউকে উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই জালিম।’ (সুরা হুজুরাত: ১১)

যে কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া যেমন অন্যায় এবং গুনাহ, তৃতীয় লিঙ্গকেও গালি দেওয়া বা মন্দ বলা এর চেয়ে বেশি গুনাহ। কোনো মুসলমানকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যেমন পাপ, তাদের তুচ্ছজ্ঞান করা এর চেয়ে কোনো অংশে কম নয় বরং আরও বেশি। কারণ তাদের এই দুর্বলতার কারণে তাদের প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রুপ করার অর্থই হলো, আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা। তার সৃষ্টিকে হাসি-তামাশার বিষয় বানানো। সর্বোপরি এটি আল্লাহ তাআলার প্রতি অভিযোগ এবং অনুযোগ আরোপ করার শামিল। তাই ইসলামি শরীয়ার দৃষ্টিতে এটি একটি খুবই গর্হিত এবং অন্যায় কাজ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যারা বিনা অপরাধে মুমিন নর-নারীকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ এবং প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহজাব: ৫৮)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা পরস্পর শত্রুতা করো না। একে অপরের দোষ তালাশ করো না। অন্যকে (তুচ্ছজ্ঞান করে) দূরে ঠেলে দিয়ো না। একজনের ওপর আরেকজন ক্রয়-বিক্রয় প্রস্তাব করো না। আল্লাহ তাআলার বান্দা হয়ে সবাই ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (বুখারি: ৬০৬৩)
আজ আমাদের সমাজে যারা লিঙ্গপ্রতিবন্ধী; তারা তো আমাদেরই কারো না কারো পরিবারের সদস্য। কারো ভাই-বোন, কারো সন্তান। তাই তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা এটি শুধু অনৈসলামিকই নয়; সম্পূর্ণ অমানবিকও বটে।

কোনো পরিবারে তৃতীয় লিঙ্গের শিশু জন্ম নিলে শুধু শিশুটিই নয়, গোটা পরিবারই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর বিদ্রুপের শিকার হয়। কেমন যেন শিশুটি পাপ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। জগতের প্রতিটি মানব শিশুই নিষ্পাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করে। কোনো শিশু পাপ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘প্রতিটি মানব শিশুই ইসলামের ওপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতাই তাকে ইহুদি বানায়, খ্রিষ্টান বানায় এবং অগ্নিউপাসক বানায়।’ (বুখারি: ১৩৮৫)

আরও পড়ুন: যেসব কাজে নেমে আসে মহামারি ও বিপদ 

সুতরাং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি শিশুই নিষ্পাপ। কাজেই তাদের তুচ্ছ জ্ঞান করা এবং বিরূপ মনোভাব পোষণ করাকে ইসলাম কিছুতেই সমর্থন করে না। এ ব্যাপারে হাদিসও বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কোনো মানুষ নিকৃষ্ট হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার অপর ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে।’ (মুসলিম: ২৫৬৪)

কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থায় দুর্বল ও অসহায় এই শ্রেণি নানা নিগ্রহের শিকার। অথচ সামাজিক সদস্য এবং মানব সন্তান হিসেবে প্রত্যেকেরই রয়েছে সুমহান অধিকার। ইসলাম তাদের সমাজের সদস্য গণ্য করে অধিকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যার দৃষ্টান্ত বিরল।

এজন্য ইসলামি মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা এবং সুমহান আদর্শের ভিত্তিতে এটাই প্রমাণিত যে, তাদের ততটুকু মান-মর্যাদা রয়েছে; যতটুকু সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে একজন সুস্থ মুসলমানের। অনুরূপভাবে একজন তৃতীয় লিঙ্গ ততখানি সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার পাবে; যতটুকু অধিকার রয়েছে একজন সুস্থ ও সবল মানুষের। ইসলামের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তাদের মর্যাদা ও অধিকার সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়।

সম্পদের অধিকার
ইসলাম তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে উত্তরাধিকার সম্পদ বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামি শরীয়ত অনুযায়ী তারা মা-বাবার সম্পত্তির ভাগ পাবেন। যার মধ্যে নারী বা পুরুষ কোনো একটি প্রকৃতি প্রবল, সে নারী বা পুরুষের হিসেবে উত্তরাধিকার সম্পদ পাবে। যার প্রকৃতি সহজে নির্ধারণ করা যায় না। তার ব্যাপারে চিকিৎসকদের মতামত নেওয়া হবে। (সুনানে বায়হাকি: ১২৯৪)

আরও পড়ুন: ইসলামে রোগীর সেবা করা সুন্নত 

ধর্মীয় অনুশাসন
ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিতে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও মুকাল্লাফ বা আল্লাহ তাআলার বিধান পালনে আদিষ্ট। সাধারণ মানুষের মতো তাদেরও নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত আদায় করতে হবে। এ জন্য পরকালে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। যার ভেতর নারীর স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য প্রবল, তিনি নারী হিসেবে এবং যার ভেতর পুরুষের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য প্রবল, তিনি পুরুষ হিসেবে ইসলামের বিধান মান্য করবেন। যার মধ্যে কোনো বৈশিষ্ট্যই প্রবল নয়, তিনি অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নারী বা পুরুষ হিসেবে ইসলামের বিধান মান্য করবেন।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ভেতর যেমন ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধের অভাব আছে। তাদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষার বিশেষ কোনো উদ্যোগ সমাজে চোখে পড়ে না। অথচ প্রয়োজনীয় ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা তাদের ওপরও ফরজ। তাদের এ ফরজ জ্ঞানার্জনের সুযোগ করে দেওয়া সমাজের অন্য শ্রেণির মানুষের দায়িত্ব। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকদের উচিত এ বিষয়ে মনোযোগী হওয়া।

আমাদের প্রিয়নবি (সা.) ওইসব পুরুষের ওপর অভিশাপ দিয়েছেন, যারা নারীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং ওইসব নারীর ওপরও অভিশাপ করেছেন, যারা পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করে। মহান আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করে। (বুখারি: ৩৮৮৫)

লেখক: কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক, বাংলাদেশ কওমী ছাত্রপরিষদ।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।