নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম
আ স ম আল আমিন
ইসলাম নারী ও পুরুষসহ কোনো সৃষ্টির অধিকার হরণ করেনি। বরং ইসলামই একমাত্র জীবন ব্যবস্থা; যা নারীসহ সব সৃষ্টিকে দিয়েছে যথাযথ মর্যাদা, সম্মান, গুরুত্ব, স্বাধীনতা ও কাঙ্ক্ষিত অধিকার। ইসলাম নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছে। ফিরিয়ে দিয়েছে সব অধিকার। সেসব কী?
১. ইসলাম পূর্ব যুগে নারীর অধিকার
ইসলামের পূর্বে নারীরা ছিল সবচেয়ে অবহেলিত। সে সময় কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। নারীদের দাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যেন তারা বাজারের ক্রয় বিক্রয়ের পণ্য। সে যুগে নারীরা নিজের বাবা-মা ও স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পদ থেকেও বঞ্চিত হতো। কোরআনে কিছু আয়াত থেকে তা সুস্পষ্ট বোঝা যায়। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ اِذَا الۡمَوۡءٗدَۃُ سُئِلَتۡ بِاَیِّ ذَنۡۢبٍ قُتِلَتۡ
‘আর যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?’ ( সুরা তাকভীর: আয়াত ৮-৯)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন-
وَ لَا تُکۡرِهُوۡا فَتَیٰتِکُمۡ عَلَی الۡبِغَآءِ اِنۡ اَرَدۡنَ تَحَصُّنًا لِّتَبۡتَغُوۡا عَرَضَ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا
‘আর তোমরা দুনিয়ার ধন-সম্পদ পাওয়ার উদ্দেশ্যে তোমাদের যুবতী দাসীদের ব্যভিচারে লিপ্ত হতে বাধ্য করবে না। যখন তারা পাপমুক্ত থাকতে চায়।’ ( সুরা আন-নুর: আয়াত ৩৩)
২. কন্যা হিসেবে নারী
আমাদের সমাজে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে আমরা অনেকে মন খারাপ করি। অনেকে এটাকে ঘৃনার চোখে দেখে। তবে কন্যা সন্তান আল্লাহর রহমত ও বরকত এবং জান্নাতের বার্তা নিয়ে আসে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কন্যা সন্তান বরকত (প্রাচুর্য) ও কল্যাণের প্রতীক।’ হাদিসে পাকে আরও এসেছে, ‘যার তিনটি, দুটি বা একটি কন্যা সন্তান থাকবে; আর সে ব্যক্তি যদি তার কন্যা সন্তানকে সুশিক্ষিত ও সুপাত্রস্থ করে, তার জান্নাত নিশ্চিত হয়ে যায়।’
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তিকে কন্যাসন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সে ধৈর্যের সঙ্গে তা সম্পাদন করেছে, সেই কন্যাসন্তান তার জন্য জাহান্নাম থেকে আড় (প্রতিবন্ধক) হবে।’ (তিরমিজি ১৯১৩)
৩. স্ত্রী হিসেবে নারী
ইসলাম পারিবারিক জীবনে নারীকে দিয়েছে তার ন্যায্য অধিকার। সংসার জীবনে নারী-পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক। কোন একজনের একক প্রচেষ্টায় সংসার জীবন পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। আল্লাহ বলেন, তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক। (সুরা বাকারা: আয়াত ১৮৭)
অন্য আয়াতে বলেন, ‘নারীদের অধিকার রয়েছে যেমন পুরুষদের উপর তেমনি পুরুষদের অধিকার রয়েছে নারীদের উপর।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২২৮)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন করো ।( সুরা নিসা: আয়াত ১৯)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। একজন শাসক সে তার অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন পুরুষ তার পরিবারের রক্ষক, সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন স্ত্রী তার স্বামীর গৃহের রক্ষক, সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন গোলাম তার মনিবের সম্পদের রক্ষক, সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব সাবধান, তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি ৫১৮৮)
৪. মা হিসেবে নারী
ইসলাম নারীকে মা হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছেন । রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘একবার এক লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার কাছে সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি অধিকারী কে? নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমার মা। ওই লোক জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কে? তিনি উত্তর দিলেন ‘তোমার মা। ওই লোক আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কে? এবারও তিনি উত্তর দিলেন ‘তোমার মা।’ সে বলল, এরপর কে? তিনি বলেন, এরপর তোমার পিতা।’ (মুসলিম ৬৩৯৪)
৫. উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীর অধিকার
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন, একজন পুরুষের অংশ দুজন নারীর অংশের সমান। এরপর যদি শুধু নারীই হয় দুই-এর অধিক, তবে তাদের জন্য ওই মালের তিন ভাগের দুই ভাগ যা ত্যাগ করে মরে এবং যদি একজনই হয়, তবে তার জন্য অর্ধেক। মৃতের বাবা-মায়ের মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্য রেখে যাওয়া সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের ছেলে থাকে। যদি ছেলে না থাকে এবং বাবা-মায়ের ওয়ারিস হয়, তবে মা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। এরপর যদি মৃতের কয়েকজন ভাই থাকে, তবে তার মাতা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ। ওসিয়ত পূরণ করার পর; যা (ওসিয়ত) করে মরেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের বাবা ও ছেলের মধ্যে কে তোমাদের জন্যে অধিক উপকারী তোমরা জান না। এটা আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত অংশ। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা নিসা: আয়াত ১১)
৬. নারীর অর্থনৈতিক অধিকার
কোনো নারীর যদি ব্যক্তিগত অর্থায়নে কোন সম্পদ গড়ে ওঠে বা ব্যবসা বানিজ্য করে অর্থবিত্ত উপার্জন করে তাহলে এর সম্পূর্ণটুকু তাদের নিজেদের থাকবে। পুরুষদের তাতে ভাগ বসানোর কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষ যা উপার্জন করবে তা তারই প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা উপার্জন করবে তা তারই প্রাপ্য অংশ।’ (সুরা নিসা: আয়াত ৩২)
৭. মোহরের অধিকার
মোহরানা নারীর বিশেষ অধিকার, স্বামীর মৃত্যুকালে যদি তা অপরিশোধিত থাকে তাহলে তা স্বামীর ঋণ হিসেবে থাকবে। আল্লহ তাআলা বলেন, ‘হে নবি! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদের আপনি মোহরানা প্রদান করেন।’ (সুরা আহজাব: আয়াত ৫০)
অন্য আয়াতে বলেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশীমনে। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করো। (সুরা নিসা: আয়াত ৪)
৮. আমলের ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা
আল্লাহ তাআলার কাছে সম্মানিত এবং মর্যাদাবান ব্যক্তি হলো যারা তাকওয়াবান। সওয়াবের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ পার্থক্য না করে সমান সওয়াবের ঘোষণা দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার পুরুষ হোক কিংবা নারী হোক; আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেব; যা তারা করতো।’ (সুরা নাহল: আয়াত ৯৭)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘এরপর তাদের পালনকর্তা তাদের দোয়া (এই বলে) কবুল করে নিলেন যে, আমি তোমাদের কোনো পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, তা সে পুরুষ হোক কিংবা নারী। তোমরা পরস্পর এক ‘ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ১৯৫)
৯. ইসলামে নারীর সামাজিক নিরাপত্তা
ইসলাম সামাজিকভাবে নারীর সার্বিক নিরাপত্তার বিধান করেছে । রাস্তায়, কর্মস্থলে ও যত্রতত্র নারীদের হয়রানি করা তো দূরের কথা বরং ইসলাম নারীদের সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টি দিতেও কঠোর নির্দেশ দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে রাসুল! আপনি) মুমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। (সুরা নুর: আয়াত ৩০)
আর কেউ যেন নারীকে হয়রানি না করে সে জন্য নারীকে বোনের দৃষ্টিতে দেখার ঘোষণা দেন নবিজি সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি বলেছেন, ‘নারীরা পুরুষদের সহোদরা (বোন)।’ (আবু দাউদ) কোনো নারীর ইজ্জত-সম্মান রক্ষায় কোনো নারীর উপর যদি কেউ ব্যভিচারের অপবাদ দেয়, তার অপরাধের শাস্তি স্বরূপ ৮০ দোররা আঘাত রায় রাষ্ট্রীয় দন্ড বিধির বিধান করেছে ইসলাম।
১০. নারীর ধর্মীয় অধিকার
ইসলামের কল্যাণে পুরুষদের থেকে নারীরা ধর্মীয় অনেক সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অধিকার পেয়েছেন। উদাহারণস্বরূপ- নারীদের জানাজা, ঈদ ও জুমার নামাজ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। আর হায়েজ-নেফাসের সময় ফরজ নামাজ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সাথে রোজা থেকে মুলতবি এবং তারাবি মওকুফ করেছেন।
লেখক: কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক, বাংলাদেশ কওমী ছাত্রপরিষদ।
এমএমএস/জেআইএম