প্রতিবেশীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম
আ স ম আল আমিন
আরবি ‘জার’ শব্দটির শাব্দিক অর্থ প্রতিবেশী, পাড়াপড়শি।পরিভাষায় বলতে পারি, আমাদের বাসা-বাড়ির চার পাশে যেসব লোকজন বসবাস করেন তারা আমাদের প্রতিবেশী। প্রতিবেশী বলতে মুসলিম, অমুসলিম, নেককার বান্দা, ফাসেক, বন্ধু, শত্রু, পরদেশি, স্বদেশি, উপকারী, ক্ষতিসাধনকারী, আত্মীয়, অনাত্মীয়, কাছের কিংবা দূরের প্রতিবেশী সবাই এ জারের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিবেশীর অধিকারে ইসলামের দিকনির্দেশনা কী?
প্রতিবেশীর প্রকারভেদ
হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, হক বা অধিকারের আলোকে প্রতিবেশী তিন শ্রেণির হয়ে থাকে। যেমন- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোনো কোনো প্রতিবেশী রয়েছে, যাদের হক মাত্র একটি। এমন কোনো কোনো প্রতিবেশী রয়েছে যাদের হক দুটি এবং এমন কিছু প্রতিবেশী রয়েছে যাদের হক তিনটি। নিচে তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো-
১. এক হকবিশিষ্ট প্রতিবেশী: তারা শুধু প্রতিবেশী কিন্তু আত্মীয় নয় এবং অমুসলিম।
২. দুই হকবিশিষ্ট প্রতিবেশী: তারা প্রতিবেশী হওয়ার পাশাপাশি মুসলমান কিন্তু আত্মীয় নয়।
৩. তিন হকবিশিষ্ট প্রতিবেশী: তারা প্রতিবেশী হওয়ার পাশাপাশি মুসলমান এবং আত্মীয়ও বটে।
সমাজবদ্ধ পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাত্রায় প্রতিবেশীর গুরুত্ব অপরিসীম। দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনায় এ প্রতিবেশীই মানুষের নিত্যসঙ্গী। গ্রামীণ জীবনে প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের ভালোবাসা সহমর্মিতা তুলনামূলক বজায় থাকলেও ইট-পাথরের শহরে তা অনেকটাই হতাশাজনক। ইসলাম এক প্রতিবেশীর প্রতি অপর প্রতিবেশীর কিছু দায়িত্ব আরোপ করেছে। তাহলো-
১. প্রতিবেশীর প্রতি রহম করা
কোরআনুল কারিমে বাবা-মায়ের সঙ্গে যেভাবে উত্তম আচরণ করার নির্দেশ এসেছে ঠিক তেমনি প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করার নির্দেশও এসেছে। এক কথায় ,প্রতিবেশীর অন্যতম প্রধান অধিকার হচ্ছে, তার সঙ্গে উত্তম আচরণ ও ভালো ব্যবহার করা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ اعۡبُدُوا اللّٰهَ وَ لَا تُشۡرِکُوۡا بِهٖ شَیۡئًا وَّ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا وَّ بِذِی الۡقُرۡبٰی وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰکِیۡنِ وَ الۡجَارِ ذِی الۡقُرۡبٰی وَ الۡجَارِ الۡجُنُبِ وَ الصَّاحِبِ بِالۡجَنۡۢبِ وَ ابۡنِ السَّبِیۡلِ ۙ وَ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ مَنۡ کَانَ مُخۡتَالًا فَخُوۡرَا
‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর বাবা-মায়ের সঙ্গে, নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে, এতিম, মিসকিন, নিকট আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সঙ্গী-সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’ (সুরা নিসা: আয়াত ৩৬)
এ আয়াত থেকে প্রতিবেশীর অধিকারের বিষয়টি সুস্পষ্ট। সুতরাং কোনো প্রতিবেশীর বিপদে সাহায্য-সহায়তা করতে না পারলেও তার প্রতি উত্তম আচরণ, সুন্দর ব্যবহার করা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক এটি তার নির্ধারিত অধিকার। হাদিসে পাকে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে।’ (আদাবুল মুফরাদ ১০২)
২. প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেওয়া
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলার কসম! সে ব্যক্তি মুমিন হতে পারে না। আল্লাহ তাআলার কসম! সে ব্যক্তি মুমিন হতে পারে না। আল্লাহ তাআলার কসম! সে ব্যক্তি মুমিন হতে পারে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো- হে আল্লাহর রাসুল! কে সেই ব্যক্তি? তিনি বললেন, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।’ (বুখারি ৬০১৬)
আর যে ব্যক্তি প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা। হাদিসের অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অনিষ্টতা থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।’ (মুসলিম ৪৬)
৩. প্রতিবেশীকে হাদিয়া দেওয়া
পরস্পরের হাদিয়া দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘পরস্পরকে উপহার দাও। এতে তোমাদের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি হবে।’ হাদিসের অন্য বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, ‘হে আবু যর! তুমি ঝোল (তরকারি) রান্না করলে তার ঝোল বাড়িয়ে দিয়ো এবং তোমার প্রতিবেশীকে তাতে শরিক করো।’ (মুসলিম ২৬২৫)
৪. প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ না করা
যেহেতু সকাল হলে সবার আগে প্রতিবেশীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় এবং কোনো সমস্যা হলে সবার আগে প্রতিবেশী দৌড়ে আসে। তাই প্রতিবেশীর সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে বাক-বিতন্ডা ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। কেননা এতে উভয়ের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তাছাড়া এর জন্য কেয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। হাদিসে পাকে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম ঝগড়াটে দুই প্রতিবেশীর মোকদ্দমা পেশ করা হবে।’ (মেশকাত ৫০০০)
৫. প্রতিবেশীর দুঃখে সান্ত্বনা দেওয়া
যে কোনো সময় যে কেউ বিপদে পড়তে পারে। বিপদ আসা-না আসার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিপদে সবার যে বা যারা দৌড়ে আসে, তারা হলো প্রতিবেশী। এ জন্য নিকটাত্মীয়দের থেকেও কাছের মানুষ ভাবা হয় প্রতিবেশীকে। এ কারণেই কোরআন-সুন্নায় প্রতিবেশীকে সর্বাধিক মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই প্রতিবেশীর যে কোনো দুঃখ কিংবা শোকে তার পাশে দাঁড়ানো, তার প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা এবং তাকে সান্ত্বনা প্রদান করা নেকির কাজ। হাদিসে পাকে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে বিপদে সান্ত্বনা প্রদান করবে, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তাকে সম্মানের পোশাক পরাবেন।’ (ইবনে মাজাহ ১৬০২)
৬. প্রতিবেশীদের মাঝে ন্যায়বিচার করা
প্রতিবেশীদের মাঝে কোনো বিষয়ে সমস্যা দেখা দিলে ন্যায়সঙ্গতভাবে এর সমাধান করা ইসলামের নির্দেশ। এতে সদকার সওয়াব পাওয়া যায়। বিবাদ মীমাংসার জন্য আল্লাহর নির্দেশ হলো-
اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ اِخۡوَۃٌ فَاَصۡلِحُوۡا بَیۡنَ اَخَوَیۡکُمۡ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ
‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আশা করা যায় তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হবে।’ (সুরা হুজুরাত: আয়াত ১০)
মীমাংসার জন্য প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ اِنۡ طَآئِفَتٰنِ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اقۡتَتَلُوۡا فَاَصۡلِحُوۡا بَیۡنَهُمَا ۚ فَاِنۡۢ بَغَتۡ اِحۡدٰىهُمَا عَلَی الۡاُخۡرٰی فَقَاتِلُوا الَّتِیۡ تَبۡغِیۡ حَتّٰی تَفِیۡٓءَ اِلٰۤی اَمۡرِ اللّٰهِ ۚ فَاِنۡ فَآءَتۡ فَاَصۡلِحُوۡا بَیۡنَهُمَا بِالۡعَدۡلِ وَ اَقۡسِطُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ الۡمُقۡسِطِیۡنَ
‘মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে; আর তাদের একদল অপর দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে, তাহলে তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মীমাংসা করে দেবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা হুজুরাত: আয়াত ৯)
মুসলিম ভাইদের মাঝে বিবাদ মীমাংসা করে দিলে সাদাকা করার সওয়াব পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমার দুই ব্যক্তির মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার-ফয়সালা করা একটি সাদকা।’
৭. প্রতিবেশীর দাওয়াত কবুল করা
সমাজের মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক ও আন্তরিকতা সামাজিক বন্ধনকে সুদূঢ় করে। আর পরস্পরকে দাওয়াত দিলে হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়। দাওয়াত কবুল করা রাসুলের নির্দেশও বটে। তিনি বলেন, ‘যখন তোমাদের কাউকে খাবারের জন্য দাওয়াত দেওয়া হয়, তখন সে যেন তাতে সাড়া দেয় বা দাওয়াত কবুল করে। এরপর ইচ্ছা হলে সে খাবে আর না হলে সে ছেড়ে দেবে।’ (মুসলিম: ১৪৩০)
এছাড়া এক মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দাওয়াত কবুল করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘একজন মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের ছয়টা হক আছে। বলা হলো সেগুলো কী হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বললেন, তার সাথে সাক্ষাৎ হলে সালাম দেবে; তোমাকে দাওয়াত দিলে কবুল করবে; পরামর্শ চাইলে সুপরামর্শ দেবে; হাঁচি দিয়ে আল-হামদুলিল্লাহ বললে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলবে; অসুস্থ হলে দেখতে যাবে এবং মারা গেলে জানাজায় শরিক হবে।’ (মুসলিম ২১৬২)
লেখক: কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক, বাংলাদেশ কওমী ছাত্রপরিষদ।
এমএমএস/জিকেএস