ইতিকাফ: রমজানের শেষ দশকের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল

ইসলাম ডেস্ক
ইসলাম ডেস্ক ইসলাম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:০২ পিএম, ১৪ এপ্রিল ২০২৩

ফখরুল ইসলাম নোমানী

ইতেকাফ মাহে রমজানের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মাহে রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করা সুন্নত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই ইতেকাফ করতেন। সাহাবায়ে কেরামও ইতেকাফ করতেন। ইতেকাফের মাধ্যমে মুসলমানগণ আল্লাহর জিকির ও ইবাদতের মাধ্যমে শবেকদর তালাশ করেন। সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত মাগফেরাত ও নাজাত কামনা করে বিশেষ দোয়া করে থাকেন।

রমজানের শেষ দশকের একটি আমল হলো ইতেকাফ করা। ইতেকাফ হলো এই মোবারক দিনগুলোয় ইবাদত-বন্দেগীর উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান ও রাতযাপন করা। ইতেকাফ শরিয়তসম্মত একটি আমল হওয়ার ব্যাপারে আল কোরআনে ইঙ্গিত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا تُبَاشِرُوۡهُنَّ وَ اَنۡتُمۡ عٰکِفُوۡنَ ۙ فِی الۡمَسٰجِدِ

‘আর তোমরা মাসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না।’ (সুরা আল-বাকারা: ১৮৭)

ইতেকাফ বিষয়ে বুখারিতে বর্ণিত এক হাদিসের শেষাংশে রয়েছে, যে আমার সঙ্গে ইতেকাফ করতে চায় সে যেন শেষ দশকে ইতেকাফ করে কেননা এই রাত আমাকে দেখানো হয়েছিল পরে আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ (বুখারি)

তাই যার শক্তি সামর্থ্য আছে তার উচিত হবে ইতেকাফে বসে শেষ দশকের রাতগুলো যাপন করা। ইতেকাফকারী নিজেকে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর আনুগত্য দোয়া-মোনাজাত জিকির ইত্যাদির জন্য সে নিজেকে মসজিদে আঁটকে ফেলে। দুনিয়াবী সকল দৌড়ঝাঁপ থেকে মুক্ত হয়ে সে মসজিদের পবিত্র আবহে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলে। মন ও শরীর উভয়টাকেই সে নিরঙ্কুশভাবে রাব্বুল আলামীনের দরবারে সঁপে দেয়। যা কিছু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে শুধু তাতেই নিজকে সংশ্লিষ্ট করে নেয়। আর এভাবে সে শুধুই আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। যা করলে আল্লাহ রাজি হন শুধু তাতেই নিজকে নিয়োজিত করে।

ইতেকাফের মাধ্যমে রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ পেয়ে থাকেন। আর মাহে রমজানে ইতেকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক বেশি। ইতেকাফের মূল উদ্দেশ্য হলো দুনিয়ার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করার জন্য সুসম্পর্ক স্থাপন করা।

ইতেকাফ ৩ প্রকার

১. ওয়াজিব

২. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা

৩. নফল ইতেকাফ

১. ওয়াজিব ইতেকাফ

কোনো কারণবশত যদি কেউ ইতেকাফের নিয়ত বা মান্নত করে তা আদায় করা ওয়াজিব। রোজাসহ এইরূপ ইতেকাফ আদায় বা পালন করা আবশ্যক।

২. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা ইতেকাফ

যা মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন করা হয়। মসজিদ এলাকার কিছুসংখ্যক লোক ইতেকাফ করলে সবার পক্ষ থেকেই আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু কেউই যদি আদায় না করে তবে সবাই গুনাহগার হবে। হজরত আয়েশা রা. বলেন রাসুল সা. সবসময় রমজানের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করতেন।

৩. নফল ইতেকাফ

নফল ইতেকাফের জন্য কোনো মাস বা নির্ধারিত সময়ের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো মাসে যে কোনো সময়ে এই নফল ইতেকাফ করা যায়।

মাহে রমজানের শেষ ১০ দিনের ইতেকাফ আত্মিক উৎকর্ষ সাধন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুবর্ণ সুযোগ। লাইলাতুল কদরের পূর্ণ ফজিলত পাওয়ার উদ্দেশ্যে মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করা হয়। এ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করেছেন। যে ব্যক্তি যত বেশি গভীরভাবে আল্লাহকে ভালোবাসার জন্য আত্মনিয়োগ করবে সে তত বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম হবে।

মানুষ একান্তভাবে আল্লাহর ধ্যানে নিয়োজিত থাকার প্রধান মাধ্যম হলো ইতেকাফ। ইতেকাফ মানুষের ওপর এমন আধ্যাত্মিক প্রভাব সৃষ্টি করে যার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন হয়। ইতেকাফের মাধ্যমে মানুষ অধিক নেকি অর্জন করে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়ক হয়। আর এই ইতেকাফ মুমিন মুত্তাকিদের জীবনের মুক্তির বিশেষ পাথেয়।

ইতেকাফের তাৎপর্য হলো সৃষ্টজীব থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সুনির্দিষ্ট বলয়ের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে নেওয়া। আর আল্লাহ সম্পর্কে বান্দার জ্ঞান যত বাড়বে আল্লাহর মহব্বত হৃদয়ে যত পোক্ত হবে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে যতটুকু অগ্রসর হবে দুনিয়ার প্রতি প্রেম ভালোবাসা ততই অর্ন্তনিহিত হবে।

ইতেকাফ হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে পালিত জিবরিল আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত। জিবরিল আলাইহিস সালাম প্রতি রমজানেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোরআন শোনাতেন এবং নিজেও তাঁর থেকে শোনতেন। আর যে বছর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয় সে বছর তিনি দুবার কোরআন শোনান এবং শোনেন।

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনায় বুখারিতে আরও এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিক দানকারী ছিলেন তবে তিনি সবচেয়ে বেশি দান করতেন যখন জিবরিল আলাইহিস সালাম তাঁকে কোরআন শোনাতেন। আর জিবরিল আলাইহিস সালাম রমজানের প্রতি রাতেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁকে কোরআন শেখাতেন। যখন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি বেগবান বাতাস থেকেও অর্থকড়ি ব্যয়ের ক্ষেত্রে অধিক দানশীল হতেন।

ইতেকাফের ফজিলত রমজানের শেষ দশকের রাতগুলোর যেকোনো একটিতে শবে কদর রয়েছে। আর শবে কদরের ইবাদত তিরাশি বছর চার মাস ইবাদত করার চেয়েও উত্তম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শবে কদর প্রাপ্তির আশা নিয়েই ইতেকাফ করতেন। তিনি প্রথম দশকেও ইতেকাফ করেছেন মধ্য দশকেও করেছেন এরপর শেষ দশকে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি প্রথম দশকে ইতেকাফ করেছি এরপর মধ্য দশকে এরপর আমাকে দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে তা শেষ দশকে। অতএব তোমাদের মধ্যে যার ইতেকাফ করা পছন্দ হয় সে যেন ইতেকাফ করে (মুসলিম)

রাসুলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতেকাফ করা কখনো বাদ দেননি। তিনি প্রতি বছর দশ দিন ইতেকাফ করতেন। আর যে বছর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওফাত ফরমান সে বছর তিনি বিশ দিন ইতেকাফ করেন। উপরন্তু যখন তাঁর স্ত্রীগণ ইতেকাফ করতে প্রতিযোগিতা শুরু করলেন তিনি ইতেকাফ করা ছেড়ে দিলেন এবং তা শাওয়ালের প্রথম দশকে কাজা করে নিলেন। ইতেকাফ অবস্থায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন বিষয় থেকে নিজকে দূরে রেখেছেন যা তার জন্য বৈধ ছিল। যেমন স্ত্রীসঙ্গ ও নিদ্রাগমন।

রমজানের শেষ দশকে কঠোর মেহনতি হওয়া এবং লুঙ্গি বেঁধে নেয়ার ব্যাপারে হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার অর্থ এটাই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণও ইতেকাফ করতেন। এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পরও তাঁরা ইতেকাফ করেছেন।

আসুন এবার আমরা ইতেকাফের কিছু আহকাম ও মাসাইল নিয়ে আলোচনা করি-

১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের অনুসরণ করে ইতেকাফের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করা।

২. নিয়ত করে ইতেকাফ শুরু করে দেওয়ার পর ইতেকাফ পূর্ণ করা জরুরি।

৩. কমপক্ষে কত দিন ইতেকাফ করলে ইতেকাফ হিসেবে ধরা হব বিষয়টি অনির্দিষ্ট। তবে ইতেকাফকারী যেদিন থেকে ইতেকাফ শুরু করতে ইচ্ছুক সেদিন সূর্যাস্তের আগেই তাকে নিজ ইতেকাফের জায়গায় পৌঁছে যেতে হবে।

৪. নিজের জন্য একটা জায়গা বেছে নেয়া জরুরি যেখানে নীরবে আল্লাহর জিকির-আজকার করতে পারবে। প্রয়োজনের সময় আরাম করতে পরবে। কাপড় পরিবর্তন করতে পারবে। পরিবারের কেউ এলে তার সঙ্গে সাক্ষৎ করতে পারবে।

৫. ইতেকাফকারী মসজিদের বিভিন্ন প্রান্তে নফল নামাজ আদায় করতে পারবে। তবে ইতেকাফকারীর জন্য উত্তম হলো অধিক নড়াচড়া ও নফল নামাজ না পড়া। এর প্রথম কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজকে লুকিয়ে রাখা যায় মসজিদের অভ্যন্তরে এমন একটি জায়গা তৈরি করে নিতেন। আর দ্বিতীয় কারণ যখন কেউ নামাজ পড়ার জায়গায় বসে থাকে তখন ফেরেশতারা তার প্রতি রহমত বর্ষণের দোয়া করতে থাকে।

৬. ইতেকাফ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী মিলিত হওয়া চুম্বনস্পর্শ নিষেধ। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-

وَ لَا تُبَاشِرُوۡهُنَّ وَ اَنۡتُمۡ عٰکِفُوۡنَ ۙ فِی الۡمَسٰجِدِ

‘আর তোমরা মাসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না।’ (সুরা আল-বাকারা: ১৮৭)

ইতেকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হওয়া না হওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিতে হবে-

১. মানবীয় প্রয়োজনে বের হওয়ার অনুমতি আছে। যেমন পায়খানা, প্রস্রাব, পানাহার; যদি তা মসজিদে পৌঁছে দেওয়ার মত কেউ না থাকে। অনুরূপভাবে যে মসজিদে ইতেকাফ করা হচ্ছে তাতে যদি জুমার নামাজ না হয়, তাহলে জুমা আদায়ের জন্য অন্য মসজিদে যাওয়ার অনুমতি আছে।

২. এমন সব নেক-আমল বা ইবাদত-বন্দেগির জন্য বের হওয়া যাবে না যা ইতেকাফকারীর জন্য অপরিহার্য নয়। যেমন রোগীর সেবা করা, জানাজায় অংশ নেয়া ইত্যাদি। তবে যদি ইতেকাফের শুরুতে এ জাতীয় কোনো শর্ত করে নেওয়া হয়, তবে তার কথা ভিন্ন।

৩. এমন সকল কাজের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না যা ইতেকাফ বিরোধী। যেমন ক্রয়-বিক্রয়, চাষাবাদ ইত্যাদি। ইতেকাফ অবস্থায় এ সকল কাজের জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ইতেকাফ বাতিল হয়ে যাবে।

আমরা যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে চাই, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চাই  লাইলাতুল কদরের সুমহান মর্যাদা লাভ করতে চাই, সর্বোপরি জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে চাই তাদের জন্য উচিত হলো রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করা।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দান করুন। হে আল্লাহ! তোমার করুণা ধারায় আমাদের সিক্ত করো। আমিন।

লেখক: ইসলামি চিন্তক ও গবেষক।

এমএমএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।