রমজানজুড়ে ইরানের যত উৎসব ও আয়োজন
মহিমান্বিত মাস রমজান। এ মাসকে ঘিরে বিশ্বব্যাপী রয়েছে নানা অনুষ্ঠান আর রীতি-রেওয়াজ। সারাদিন রোজা রেখে সন্ধ্যায় বাহারি ইফতার, ইফতারের পর তারাবিহের নামাজ পড়া ইত্যাদি ছাড়াও আনন্দ-উৎসব করার মাধ্যমেও সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় রমজানের খুশির আমেজ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়েও এসব রীতি সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইরান। সেখানকার মুসলিমরা রমজানজুড়ে উৎসব ও আয়োজনে পালন করে থাকে। তাদের উৎসব আয়োজনগুলো কী?
অভিনন্দন
ইরানিদের ঐতিহ্য, রীতিনীতিতে রমজান একটি ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করে। রমজান এলেই ইরানের অনেক লোক তাদের দোকান বা গলি আলো এবং ফুল দিয়ে সাজায়। লোকেরা একে অপরকে ‘রমজান মোবারক’ (বরকতময় রমজান) বলে অভিনন্দন জানায়।
সেহরি
ইরানে সেহরির সময় নির্ধারণের ধারণাটি অতীতে অনেকটা বাংলাদেশের প্রাচীন রীতিনীতির মতোই ছিল। ঘড়ি না থাকার কারণে লোকেরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেহরির সময় সম্পর্কে অবহিত হতেন। কেউ কেউ আকাশের তারকারাজির ওপর নির্ভর করতেন। তাঁরা দোবে আকবর (The Big Dipper or The Seven Stars or Seven Brothers), মিজান (এক ধরনের সময় পরিমাপক যন্ত্র) ও পারভিন বা সোরাইয়া (The Pleiades or Seven Sisters) তারকা দেখে সেহরির সময় নির্ধারণ করতেন।
মোরগের ডাক
সময় নির্ধারণ ও সেহরির রীতিনীতির আরেকটি মাধ্যম ছিল মোরগের ডাক। ইরানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন বিশ্বাস করেন, মোরগ রাতের দীর্ঘ পরিসরে তিনবার ডাক দেয়। প্রথমবার অর্ধ রাতে, দ্বিতীয়বার অর্ধ রাত পার হওয়ার পর ও সর্বশেষ ভোরবেলা। এ কারণেই নিজেদের বাড়িতে মোরগ রাখা কল্যাণ ও বরকতের প্রতীক মনে করত। সাধারণ লোকজন বিশ্বাস করত, আরশে এলাহিতে বৃহৎ ও সাদা রঙের একটি মোরগ রয়েছে। যেটা ভোরে নিজের ডানা ঝাঁপটায় এবং উচ্চ স্বরে আজান দেয়। এ আজানের ধ্বনি পৃথিবীতে অবস্থানকারী সব মোরগের কানে পৌঁছে যায়। তারা এ আজানের অনুকরণে নিজেরাও আজান দেয় ও লোকজনকে ভোর সম্পর্কে অবহিত করে।
সেহরিতে ডাক-ঢোল ও গজল
লোকজনকে জাগ্রত করার একটি প্রাচীন পদ্ধতি ছিল সেহরিতে ডাক-ঢোল বাজানো ও গজল গাওয়া। সেটা বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের মতো একটি দল পাড়া বা মহল্লায় ঢোল ও গজলসহ জাগ্রত করা। ইরানের সিরজান অঞ্চলে এ দলটি লোকদের বাড়ির দরোজায় টোকা দিয়ে জাগ্রত করত। টোকা দিতে দিতে বাড়ির মালিককে সম্ভাষণ করে কবিতা আবৃত্তি করত। রমজান মাস যদি গ্রীষ্মকালে হতো, তবে বলত—ওহে বয়োজ্যেষ্ঠ! উঠুন, সেহরি খাই,/ খাই বরফ, চিনিমিশ্রিত ফালুদা; আর তো সময় নাই! শীতকালে মাহে রমজান হলে দলটি বলত—ওহে বয়োজ্যেষ্ঠ! উঠুন, সেহরি খাই/ খাই মধুমিশ্রিত মাখন-তেল; সময় তো আর নাই!
ঈদি গ্রহণ
যারা মাসব্যাপী সেহরিতে জাগিয়ে দেয়, তারা রমজান মাসের শেষ দিনগুলোতে সবার বাড়ি-দোকানে যেত। লোকদের কাছ থেকে উপহার, হাদিয়া বা ঈদি গ্রহণ করত। এ হাদিয়া গ্রহণ করতে গিয়েও দলবদ্ধভাবে কবিতা আবৃত্তি করত। বুশেহর প্রদেশে এরা দোম দোম সেহরি নামে পরিচিত। এরা রমজানের রাতগুলোতে দাম্মাম (এক প্রকারের তবলা) বাজিয়ে লোকজনকে জাগ্রত করত।
কসম খেয়ে সেহরিতে ওঠার চেষ্টা
কেউ কেউ এমন বিশ্বাসী ছিল যে, ঘুমের সময় যদি মাটির কসম খাওয়া হয়, তবে সেহরির সময় জাগ্রত হওয়া যাবে। যেমন- ইরানের কেরমান প্রদেশের সিরজান অঞ্চলের লোকজন ঘুমের আগে আঙুল দিয়ে মাটিকে আঘাত করে বলে, হে মাটি! আমার পাপ তোমার ঘাড়ে, সেহরির সময় আমাকে জাগ্রত করো।
উচ্চ স্বরে মোনাজাত
সেহরিতে জাগানোর আরেক মাধ্যম উচ্চ স্বরে মোনাজাত। অধিকাংশ শহরগুলোতে ধর্মভীরু ব্যক্তি নিজের বাড়ি বা মসজিদের ছাদে চলে যান। উচ্চ স্বরে মোনাজাত করে রোজাদার লোকদের রোজা রাখার জন্য জাগ্রত করেন। ছন্দোবদ্ধ কবিতা বা মোনাজাতে খাজা আবদুল্লাহ আনসারি বা শেখ সাদির কবিতা অথবা গ্রামীণ কবিদের কবিতা মোনাজাতের মূল উপাদ্য। ফজরের আজানের কিছুক্ষণ আগে মোনাজাতকারী সবাইকে সতর্ক করে দিত। বলত, হে মুমিনগণ! শুধু কিছু পানি পান করতে পারবেন।
সেহরিতে ‘তারইয়াক’ টানা
কোনো কোনো এলাকায় তারইয়াক টানার প্রচলন ছিল। তারইয়াক হলো এক ধরনের আফিম বা গাঁজা জাতীয় জিনিস, তবে নিষিদ্ধ নয়; সাধারণত ধূমপানের মতো মামুলি ছিল। তাদের উদ্দেশ্যে বলা হতো, পানি পান করুন ও তারইয়াক পান শেষে মুখ পরিষ্কার করে নিন।
সেহরিতে বাদ্যযন্ত্র
ইরানের কোনো কোনো অঞ্চলে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সেহরির সময় জাগ্রত করা হতো। সেহরির সময় জাগ্রত করার জন্য একবার ও সেহরির সময় শেষ হওয়ার আগে একবার এই বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো। প্রযুক্তির উৎকর্ষে এগুলো প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে কিছু অঞ্চল ছাড়া শুধু বেতার, টেলিভিশন ও মসজিদে ঘোষণা দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের সতর্ক করা হয়।
প্রতিবেশীর সঙ্গে ইফতার
রমজান মাসে লোকেরা ভোরে উঠে সেহরি খায়। খাবারটি হালকা হয়। সাধারণত আগে তৈরি খাবার থাকে। ইফতারে বাহারি খাবারের আয়োজন থাকে। সম্ভব হলে পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্য, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ইফতার করা হয়।
ইফতারে দুর্লভ খাবার
পবিত্র রমজান মাসে মসজিদগুলো আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। স্বেচ্ছাসেবকরা দাতব্য কাজ করে। মসজিদে খাবার ও ইফতার বিতরণ করা হয়। মিষ্টি, তাজা খেজুর, ঐতিহ্যবাহী আজারি পনিরসহ শাক-সবজি এবং বাদাম থাকে। যদিও ইফতারের জন্য নির্দিষ্ট খাবার নেই, তবু ইরানিদের কিছু অনন্য রান্না রয়েছে; যা বছরের অন্যান্য মাসে পাওয়া যায় না। সুস্বাদু সিরায় গভীর ভাজা ময়দার তৈরি জুলবিয়া বামিহ, হালিম, ঐতিহ্যবাহী অ্যাশ রেশতেহ, শাকসবজি, ভাজা পেঁয়াজ, মাংস, বাদাম, মটরশুটি, পার্সিয়ান নুডল এবং অন্যান্য অনেক কিছুর একটি ভারী মিশ্রণ থাকে।
বাহারি ইফতার ও জুলবিয়া
ইরানের লোকজন সাধারণত ইফতারিতে ‘অশ’ বা স্যুপ, খেজুর, কলা, দুধ, পনির, রুটি, মধু, আপেল, চেরি, তরমুজ, তলেবি বা এক ধরনের বাঙ্গি ও আঙ্গুর খেয়ে থাকেন। গরমের এ সময়ে নানা ধরনের পিচ ফল পাওয়া যায়। ইফতারিতে অনেকটা অবশ্যম্ভাবী উপাদান হিসেবে থাকে টমেটো, শসা, লেটুসপাতার সালাদ এবং পুঁদিনা ও ধনিয়া পাতাসহ নানা রকমের সুগন্ধযুক্ত পাতা। আর থাকে এক রকমের জিলাপি; তার স্বাদ ঠিক বাংলাদেশি জিলাপির মতো নয়। ইরানিরা জিলাপিকে বলে জুলবিয়া। এটি অনেকটা বাংলাদেশ বা ভারতের জিলাপির মতো। তবে এতে আড়াই প্যাঁচ থাকে না, প্যাঁচের সংখ্যা অসংখ্য এবং আকৃতি তুলনামূলকভাবে অনেক চিকন।
শোলে জার্দ ও হালিম
হালিম নামে একটি খাবারও ইফতারিতে খাওয়া হয়। তবে এই হালিমের স্বাদ বাংলাদেশের হালিমের মতো নয়। ছোট চাল, চিনি আর জাফরান দিয়ে রান্না হয় এক ধরনের ক্ষির বা পায়েশ যার ইরানি নাম ‘শোলে জার্দ’। এটিও ইফতারির একটি নামিদামি উপাদান।
ইফতারির আয়োজন
মসজিদে কিংবা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ ইরানেও আছে। মাশহাদে ইমাম রেজার মাজারে প্রতিদিন অন্তত ১২ হাজার মানুষের ইফতারির যোগান দেওয়া হয়।
মসজিদে মসজিদে ইতেকাফ
রমজান মাস এলেই কোরআন তেলাওয়াতের হিড়িক পড়ে যায় ইরানে। ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং স্কলারগণ এ মাসে নানা বিষয়ে বয়ান-বক্তৃতা করে থাকেন। রমজানের শেষ দশকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে লাইলাতুল কদর পালিত হয়। দলে দলে মসজিদে মসজিদে ইতেকাফ করতে দেখা যায়। যা ঈদুল ফিতর উৎসবের মাধ্যমে শেষ হয়। ইরানজুড়ে সব মসজিদ ও মাজারে ইতেকাফে অংশ নিতে ইচ্ছুক লোকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদের সেহরি ও ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। অনেকে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য তিনদিন মসজিদে অবস্থান করেন।
রমজানের বিশেষ অনুষ্ঠান
শিয়া সম্প্রদায়ের অষ্টম ইমাম রেজার মাজারে প্রতিদিন একজন আন্তর্জাতিক কারি পবিত্র কোরআন থেকে এক পারা করে তেলাওয়াত করেন। তার সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়ে কণ্ঠ মেলান। ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা এটি সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে। এ ছাড়া এখানকার বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পবিত্র রমজান উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ
রমজান মাসে ইরানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে। তবে এ মাসটিতে ছাত্র-শিক্ষকরা বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। তারা দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষকে শরিয়ত এবং আধ্যাত্মিক বিষয়ে তালিম দেন। এ মহৎ কাজের জন্য তারা কোনো সম্মানী গ্রহণ করেন না। ইরানের ফকিহদের মতে, কোনো ব্যক্তি মাত্র ১৭ কিলোমিটার ভ্রমণ করলেই মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে। আর মুসাফিরদের জন্য রোজা রাখা ইরানি আলেমদের মতে হারাম। অধিকাংশ ইরানিই মাসব্যাপী ইতেকাফ করে থাকেন। সারাদিন অফিস করে মসজিদে রাতযাপন করেন তারা।
ধর্ম পালন
ইরানে ধর্মপ্রাণ মানুষ রোজা রাখে, নামাজ পড়ে। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ নিয়ে তেমন কোনো কড়াকড়ি বা বাধ্যবাধকতা নেই। ধর্মপালন একেবারেই ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে; রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ নেই তাতে। অবশ্য, ধর্মপালন বা ধর্মীয় আচার-আচরণ কোথাও কোথাও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।
রমজান বাজার
রোজা শুরুর আগে ইরানের লোকজনের মধ্যে এক ধরনের সাড়া পড়ে যায়। তবে বাংলাদেশে যেমন পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ভয়ে লোকজন আগেই বড় রকমের কেনাকাটা করে রাখার চেষ্টা করে, ইরানে তেমনটা দেখা যায় না। রমজানের বাজারে পণ্য সরবরাহ আর দশটা মাসের মতোই স্বাভাবিক থাকে। খেজুর বা গোশতের দাম সামান্য কিছু বাড়ে। কিন্তু সরকারি বাজারগুলোতে রমজান উপলক্ষে দাম ও মানের দিকটি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা হয়।
সরকারের ভর্তুকি
রোজার সময় সাধারণ মানুষের ওপর যাতে জিনিসপত্র কেনাকাটায় বাড়তি চাপ না পড়ে, সে দিকটি বিবেচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি বাজারে কখনও কখনও পণ্যমূল্যে কিছুটা ভর্তুকি দেওয়া হয়। সরকারি বাজার ও পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন রকমের দুধ, দই ও দুগ্ধজাত পণ্যের প্রচুর সরবরাহ থাকে।
রমজানে তেহরানের রাস্তা ফাঁকা
রোজা উপলক্ষে ইরানেও অফিস-আদালতের সময় পরিবর্তিত হয়। শেষ বিকেলে রাজধানী তেহরানের রাস্তাগুলো তুলনামূলক ফাঁকা থাকে। তবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বা অন্য শহরগুলোতে যেমন দুপুরের পরপরই ইফতারির বিশাল আয়োজন শুরু হয়, রাস্তার পাশে, ফুটপাথে যেখানে-সেখানে ইফতারি বিক্রি হয়, তেহরানে ঠিক তেমন নয়। রোজায় রেস্টুরেন্টগুলোর সামনে পর্দা টেনে দেওয়া হয় বটে, তবে রুটির দোকানগুলো খোলা থাকে। কারণ, তেহরানের পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠেছে রুটির দোকান। যেগুলোর ওপর সাধারণ মানুষ নির্ভরশীল। রোজার সময় যেসব শিশু, বৃদ্ধ কিংবা অসুস্থ নারী-পুরুষ রোজা রাখতে পারেন না, তাদের খাবারের যোগান আসে এই রুটির দোকান থেকে। তবে ইফতারির আগে এসব রুটির দোকানে ভিড় একটু বেশি হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তারাবিহতে নেই ব্যস্ততা
ইফতারি শেষে ইরানে শিয়া মুসলমানদের মধ্যে নেই তারাবিহের ব্যস্ততা। কারণ শিয়া মাজহাবে তারাবিহ নামাজের বিশেষ গুরুত্ব নেই।
শাহাদাত দিবসে বিশেষ আয়োজন
শিয়া মুসলিমের দেশ ইরান। দেশটিতে বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে পালিত হয় মাহে রমজান। এ মাসেই শহিদ হয়েছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। ১৯ রমজানে তিনি ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছিলেন। এ ঘটনার দুদিন পর ২১ রমজান তিনি শাহাদত বরণ করেন। এই স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য নানা আয়োজনের মাধ্যমে তিনদিন শোক পালন করে ইরানিরা। অনেকে এ তিনদিনকে ‘লাইলাতুল কদর’ হিসেবে পালন করে। কেউ কেউ প্রকাশ্যেও শোক কর্মসূচি পালন করে থাকেন। বিশেষ করে এ রাতে লোকজন জওশন কাবির নামে একটি প্রসিদ্ধ দোয়া পাঠ করেন। দোয়ার প্রতি বন্ধনীর পর পুরুষেরা উচ্চ স্বরে বলেন, আল গাউস, আল গাউস, খাল্লাসনা মিনান নার ইয়া রব ইয়া রব। এ রাতে অনেক ধর্মীয় গোষ্ঠী ইমাম আলীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডে শোক জানাতে তাদের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান শুরু করে। লোকেরা সারারাত জেগে বিশেষ প্রার্থনা করে। কখনও কখনও নামাজের সময় তাদের মাথায় কোরআন ধারণ করে।
কুলে মারজান উৎসব
হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকারী ইবনে মুলজাম মোরাদিকে ২৭ রমজান হত্যা করা হয়। সে কারণে এ দিনে ইরানি জনগণ আনন্দোৎসব পালন করে থাকেন। মারকাজি প্রদেশের খোমেইন শহরের ফারনাক ও খোমেইন শহরের পাহাড়ের পাদদেশের লোকজন ইবনে মুলজামের প্রতি শ্লেষ ও ভর্ৎসনা দিবস পালন করে থাকেন।
অভিসম্পাত দিবস
আড়াই হাজার বছর আগে সাইরাস দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর হাখামানশি রাজত্বে রাজ্য পরিচালনা প্রশ্নে মতভেদ দেখা দেয়। এ সময় গিউমাত নামক একজন মগ প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে রাজ্য শাসনে বসেন। পরবর্তীতে যখন দারয়ুশ বুঝতে পারেন, তখন তিনি গিউমাতকে এই প্রতারণার ফলস্বরূপ হত্যা করেন। সৌরবর্ষের মেহর মাসের ৮ তারিখে এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়। ওই সময়ে এটি ছিল পারস্যবাসীর সর্বোৎকৃষ্ট ঈদ। এ দিনে মগ গোষ্ঠীর যাকেই পেতেন পারস্যবাসী তাকেই হত্যা করতেন। ইতিহাসে একে মগ কোশি বা মগ হত্যা নামে পরিচিত। ইবনে মুলজামের প্রতি এই অভিসম্পাত দিবস এই মগ কোশির অনুরূপ একটি আনন্দমুখর দিন।
কুদস দিবস পালন
রমজানের শেষ শুক্রবার ইরানিরা আন্তর্জাতিক কুদস দিবস পালন করে। ইসরায়েলি শাসকদের দখলদারিত্ব থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য এবং ইসরায়েলের নৃশংসতার নিন্দা জানানোর জন্য তাদের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করার জন্য ইরানিরা আন্তর্জাতিক কুদস দিবস পালন করে। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনির উত্তরাধিকার, যিনি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে দিনটিকে মনোনীত করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে আন্তর্জাতিক কুদস দিবস বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
রমজানকে বিদায়
রমজান মাসের শেষ রাতগুলোতে খোদা হাফেজ মাহে রমজান নামে একটি অনুষ্ঠানও ইরানের বিভিন্ন শহরে প্রচলিত রয়েছে। এই অনুষ্ঠানটি কোনো কোনো শহরে ২৭ রমজান, আবার কোনো কোনো শহরে রমজান মাসের শেষের দিকের সেহরির পরপর, আবার কোথাও কোথাও মাগরিব ও এশার নামাজের পর অনুষ্ঠিত হয়। লোকেরা মসজিদে অথবা ওই এলাকার প্রসিদ্ধ একজনের বাড়িতে জড়ো হন এবং বিদায় নামক প্রসিদ্ধ কবিতা পাঠ করে রমজানকে বিদায় জানান।
এমএমএস/জিকেএস