অবাধ্য স্ত্রীকে তার মতের ওপর চলতে দেওয়া যাবে কি?

ইসলাম ডেস্ক
ইসলাম ডেস্ক ইসলাম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৪১ পিএম, ২১ মার্চ ২০২৩

স্বামী তার স্ত্রীর উপর কর্তৃত্ববান ও দায়িত্বশীল। এটি মহান আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যদি কোনো স্ত্রী অবাধ্য হয়ে যায় তবে তাকে সঠিক ফেরানোর দায়িত্বও স্বামীর। স্ত্রীকে সঠিক পথে ফেরানোর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে ওই স্বামীর জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত। কিন্তু অবাধ্য স্ত্রীকে তার মতের ওপর চলতে দেওয়া যাবে কি?

প্রথমত স্বামী নিজেই সব অন্যায়-অপকর্ম ও যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবে। তবেই  অন্যায়-অপকর্ম ও নানা গুনাহের কাজে লিপ্ত থাকা স্ত্রীকে সঠিক পথে ফেরাতে সাহস পাবে। আর যদি নিজেই অন্যায়-অপকর্মে নিয়োজিত থাকে তবে স্ত্রীকে সঠিক পথে ফেরাবে কীভাবে?

সুতরাং স্বামীর জন্য আবশ্যক হল, নিজে যেমন পাপাচার ও আল্লাহর নাফরমানি থেকে মুক্ত থাকবে তেমনি তার স্ত্রী-সন্তানদেরকেও মুক্ত রাখবে। পাশাপাশি স্ত্রীকে সব সময় ঈমান, তাকওয়া, সৎকর্ম ও পবিত্রতার উপর পরিচালনা করার সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আল্লাহ তাআলা স্বামীকে দিকনির্দেশনা দিয়ে কোরআনুল কারিমে ঘোষণা করেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ

‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে (স্ত্রী-সন্তানদের জাহান্নামের) সেই আগুন থেকে রক্ষা কর। যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর। যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোরস্বভাবের ফেরেশতারা। তারা আল্লাহ তাআলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয় তাই করে।’ (সুরা তাহরিম : আয়াত ৬)

আয়াতে স্ত্রী-সন্তানকে দুনিয়ার সব অবাধ্যতা ও অন্যায় কাজ থেকে সঠিক পথে পরিচালিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং কারো স্ত্রী যদি অন্যায় কাজে জড়িত থাকে সেক্ষেত্রে স্বামী যদি তার স্ত্রীকে কোরআনের দেওয়া নিয়ম ও বিধান অনুযায়ী সঠিক পথের দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা না করে। তবে স্বামীও হবে অপরাধী। তার এ অপরাধের কারণে স্বামীকেও জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে।

অবাধ্য স্ত্রীকে তার মতের ওপর চলতে দেয়া যাবে কি?

কোনোভাবেই পুরুষ তার বিবাহিত স্ত্রীকে মন মতো অন্যায়, অপকর্ম ও পাপাচারে লিপ্ত থাকার সুযোগ দিতে পারবে না। কেননা স্ত্রীর পাপাচারের অপরাধে স্বামীকেই জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে।

তাই স্বামীর জন্য এক্ষেত্রে নীরবতা অবলম্বন করা বা স্ত্রীর ইচ্ছার উপর দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকা জায়েজ নেই। কারণ আল্লাহ তাআলা স্বামীকে স্ত্রীর উপর কর্তৃত্ববান ও দায়িত্বশীল বানিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

اَلرِّجَالُ قَوّٰمُوۡنَ عَلَی النِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ اللّٰهُ بَعۡضَهُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ وَّ بِمَاۤ اَنۡفَقُوۡا مِنۡ اَمۡوَالِهِمۡ ؕ فَالصّٰلِحٰتُ قٰنِتٰتٌ حٰفِظٰتٌ لِّلۡغَیۡبِ بِمَا حَفِظَ اللّٰهُ ؕ وَ الّٰتِیۡ تَخَافُوۡنَ نُشُوۡزَهُنَّ فَعِظُوۡهُنَّ وَ اهۡجُرُوۡهُنَّ فِی الۡمَضَاجِعِ وَ اضۡرِبُوۡهُنَّ ۚ فَاِنۡ اَطَعۡنَکُمۡ فَلَا تَبۡغُوۡا عَلَیۡهِنَّ سَبِیۡلًا ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلِیًّا کَبِیۡرًا

‘পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক, এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা নিজদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে। সুতরাং পুণ্যবতী নারীরা অনুগত, তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে হিফাযাতকারিনী ঐ বিষয়ের যা আল্লাহ হিফাযাত করেছেনে। আর তোমরা যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, বিছানায় তাদেরকে ত্যাগ কর এবং তাদেরকে (মৃদু) প্রহার কর। এরপর যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমুন্নত মহান।’ (সুরা নিসা: আয়াত ৩৪)

আয়াতে স্ত্রীর উপর স্বামীকে যে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। স্ত্রীকে পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব পালনকালে স্ত্রীর সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে, তা-ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালনকালে কোনো স্বামী যদি তা যথাযথভাবে পালন করতে অবহেলা করে, তবে স্বামীকে আল্লাহর কাঠগড়ায় জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। হাদিসে এসেছে-

হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু  আনহু বর্ণনো করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জেনে রাখ! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। একজন পুরুষ তার পরিবার (স্ত্রী-সন্তানদের) উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (মুসলিম)

তাই আল্লাহর জবাবদিহিতা ও জাহান্নামের আগুণ থেকে মুক্ত পেতে স্বামীকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। যখনই কোনো স্ত্রী অপরাধ কিংবা স্বামী-সন্তানের অধিকার লঙ্ঘনের মতো কোনো কাজে জড়িত হয়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী সঠিক পথে ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে। কোরআনে বর্ণিত স্বামীর দায়িত্ব হলো-

১. স্ত্রীকে উত্তম উপদেশ দেয়া

স্ত্রীর অবাধ্যতা দেখলেই কোনো স্বামীরই উচিত নয় যে, সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যাপারে উত্তেজিত হয়ে যাওয়া। বরং নিজেকে সংযত রেখে স্ত্রীকে মিষ্টি ভাষায় ভালোবাসার মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করা কিংবা উপদেশ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোনো কারণে স্ত্রী ভুল ধারণায় থাকলে যথাসম্ভব তা দূর করার চেষ্টা করা। স্বামী নিজেকে সংযত রাখার পাশাপাশি স্ত্রীর অন্যায়গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা। তাদের অন্যায় আচরণে ছাড় দেওয়া এবং মায়া-মমতার মাধ্যমে যতদূর সম্ভব দাম্পত্য জীবন স্থায়ী করার আপ্রাণ চেষ্টা করা।

ফলে স্ত্রী যদি হৃদয় দিয়ে স্বামীর এ অনুভূতি উপলব্দি করতে পারে তবে সে সংশোধন হয়ে যাবে। সঠিক পথে ফিরে আসবে। তখন স্ত্রীর প্রতি বিকল্প কোনো মনোভাব প্রকাশ করা যাবে না। কিংবা তাকে হেয় করা যাবে না। কেননা স্বামীর জন্য স্ত্রী একান্ত আপন এবং একমাত্র অন্তরঙ্গ বন্ধু।

২. শয্যা ত্যাগ করা

উত্তম উপদেশ দেওয়ার পরও যদি স্ত্রী অবাধ্যতায় লিপ্ত থাকে। তবে কোরআনের নির্দেশ হলো তার থেকে বিছানা আলাদা করে দেওয়া। অধিকাংশ স্ত্রীরা স্বামীর বিছানা আলাদা করে দেওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারে না। এটি স্ত্রীদের জন্য অনেক বড় কষ্টের এবং আত্ম-সম্মানবোধের বিষয়। কোরআনুল কারিমের দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে স্ত্রীর সঙ্গে রাগ-অনুরাগ, অভিমান প্রকাশ করার জন্য স্বামীর দায়িত্ব হচ্ছে স্ত্রীর শয্যা ত্যাগ করা। একসঙ্গে একত্রে রাতযাপন থেকে বিরত থাকা। স্ত্রীর ঘুমানোর জায়গা পৃথক করে দেওয়া।

এতেই যদি স্ত্রী সতর্ক হয়ে যায় এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, তাহলে দাম্পত্য জীবন সুখের হবে। এ নির্দেশনায় এসেছে কোরআনে- ‘স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও। তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর।’

৩. মৃদু প্রহার করা

স্ত্রী যদি স্বামীর দেওয়া উত্তম উপদেশ ও বিছানা আলাদা করার পরও অবাধ্য থাকে তবে তাকে সংশোধন করার জন্য স্বামীর প্রতি কোরআনের দিকনির্দেশনা হলো, তাদের মৃদু প্রহার করা। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও। তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর। অতঃপর তাদের সামান্য প্রহার কর।’

মৃদু মারধর সম্পর্কে মুজামে তাবরানিতে এসেছে- ‘এমনভাবে হালকা প্রহার করবে, যাতে শরীরে কোনো যখম বা ক্ষত না হয়। তবে এক্ষেত্রে মুখে এবং লজ্জাস্থানে কখনো প্রহার করা যাবে না।’

৪. বিকল্প পথ অনুসরণ করা

প্রথম তিন ব্যবস্থায় স্ত্রী সঠিক পথে না আসলে কোরআনুল কারিমের নির্দেশনা বিকল্প পথ অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। আর তাহলো উভয় পক্ষ সমঝোতার মাধ্যমে সালিশ বসা। যখন উপদেশ, বিছানা আলাদা করা এবং মৃদু প্রহারে কোনো কাজ না হয়; তখন ইসলামের নির্দেশনা হলো- উভয় পক্ষ থেকে এক বা একাধিক সালিসের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সমস্যা নিরসনের চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন-

‘যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মত পরিস্থিতিরই আশঙ্কা কর, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ে মীমাংসা চাইলে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছু অবহিত।’ (সুরা নিসা: আয়াত ৩৫)

মনে রাখতে হবে

আল্লাহ তাআলা স্বামীকে স্ত্রীর ওপর কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আবার স্ত্রী-সন্তানকে সঠিক পথে পরিচালনা করা, অন্যায় কাজ থেকে ফেরানো এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রাখার দায়িত্বও আল্লাহ তাআলা পুরুষদের দান করেছেন।

পুরুষ কিংবা স্বামীরা এ দায়িত্বের কারণেই সহনশীলতার সঙ্গে স্ত্রীদের সঠিক পথে ফেরানোর জন্য কোরআনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী প্রচেষ্টা করবে। তবেই তাদের দাম্পত্য জীবন পাপ-পঙ্গিলতায় কলুষিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকবে। আল্লাহর আজাব-গজব থেকে হেফাজত থাকবে। দুনিয়ায় সুখী দাম্পত্য জীবনের সন্ধান পাবে। আর পরকালীন জীবনও হবে সুন্দর ও স্বার্থক।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব স্বামী-স্ত্রীকে দুনিয়ার যাবতীয় পাপাচার ও গোনাহের কাজ থেকে মুক্ত থাকার এবং পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।