সব মানুষের সঙ্গে কি শয়তান থাকে?
কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন। শয়তান মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। শয়তান মানুষকে ধোঁকা দেয়। মন্দ কাজের দিকে ধাবিত করে। ক্রমেই আল্লাহ কুফর ও শিরকে লিপ্ত করে। সবশেষে চিরদুঃখের ও অশান্তির জায়গা জাহান্নামে পৌঁছিয়ে দেয়। কিন্তু সব মানুষের সঙ্গে কি শয়তান থাকে। এসব শয়তান থেকে আত্মরক্ষার উপায়ই বা কী? এ সম্পর্কে ইসলামের দিকনির্দেশনা কী?
‘হ্যাঁ’ কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা থেকে এ বিষয়টি প্রমাণিত যে, প্রত্যেক মানুষের সঙ্গেই একটি শয়তান থাকে। যা মানুষকে গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার দিকে কুমন্ত্রণা দেয়। আর তাতে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন কি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গেও এ শয়তান ছিলো। যার মোকাবেলায় আল্লাহ তাআলা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেফাজত করতেন। হাদিসের দিকনির্দেশনা থেকেই এসব তথ্য প্রমাণিত সত্য। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এসেছে-
১. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘর থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেলেন। এতে আমার ব্যথাতুর মনে ক্ষোভের উদ্রেক হলো। পরক্ষণেই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফিরে এসে আমাকে বিমর্ষ ভাব দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আয়েশা! তোমার কী হয়েছে? তুমি কি ঈর্ষান্বিত হয়েছ? আমি বললাম, আপনার মতো মানুষের প্রতি (সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়ে) আমার মতো নারী কি করে ঈর্ষান্বিত না হয়ে থাকতে পারে? এটা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাকে শায়তান প্ররোচিত করেছে। আমি (বিস্ময়াভিভূত হয়ে) জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার সঙ্গেও কি শায়তান থাকতে পারে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি (আবারও) জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার সঙ্গেও কি শায়তান আসতে পারে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘হ্যাঁ’, তবে তার বিরুদ্ধে আল্লাহ আমাকে সাহায্য করায় আমি (তার কুমন্ত্রণা থেকে) নিরাপদ প্রাপ্ত হই।’ (মুসলিম ২৮১৫, মুসনাদে আহমাদ ২৪৮৪৫, মিশকাত ৩৩২৩)
২. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কোনো ব্যক্তি (অবশিষ্ট) নেই; যার সঙ্গে তার সহচর (কারিন) জিন (শয়তান সহচর) নিযুক্ত করে দেওয়া হয়নি। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন- ‘হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার সঙ্গেও কি?
তিনি বললেন, আমার সঙ্গেও। তবে আল্লাহ তাআলা তার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছেন। ফলে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে ( বা আমার অনুগত হয়ে গেছে)। ফলে সে আমাকে শুধু ভাল কাজেরই পরামর্শ দেয়।
৩. অন্য এক হাদিসে সুফিয়ানের বর্ণনায় এসেছে-
وقد وكِّل به قرينُه من الجنِّ وقرينُه من الملائكة
‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সঙ্গে তার সহচর জিন (শয়তান) এবং সহচর ফেরেশতা নিযুক্ত করে দেওয়া হয়নি।’ (মুসলিম)
মানুষকে কুমন্ত্রণা দেওয়া কিংবা প্ররোচনা প্রদানকারী জিন শয়তান মানুষের সঙ্গে থাকার বিষয়টি কোরআনুল কারিমেও সুস্পষ্ট। কেয়ামতের দিন মানুষের সঙ্গী এ শয়তান বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
قَالَ قَرِیۡنُهٗ رَبَّنَا مَاۤ اَطۡغَیۡتُهٗ وَ لٰکِنۡ کَانَ فِیۡ ضَلٰلٍۭ بَعِیۡدٍ - قَالَ لَا تَخۡتَصِمُوۡا لَدَیَّ وَ قَدۡ قَدَّمۡتُ اِلَیۡکُمۡ بِالۡوَعِیۡدِ
`তার সহচর (শয়তান) বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমি তাকে অবাধ্য হতে প্ররোচিত করিনি। বস্তুতঃ সে নিজেই ছিল ঘোর বিভ্রান্ত। আল্লাহ বলবেন, তোমরা আমার কাছে বাক-বিতণ্ডা করো না। অবশ্যই আমি আগেই তোমাদের সতর্ক করেছিলাম।' (সুরা কাফ : আয়াত ২৭-২৮)
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এ আয়াতের বিশ্লেষণে বলেন- এটাই হলো নিয়োগকৃত শয়তান। হাদিসে এসেছে-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন নামাজ পড়ে, তখন সে যেন তার সামনে দিয়ে কাউকে যেতে না দেয়। যদি সে অস্বীকার করে (বাধা মানতে না চায়) তবে সে যেন তার সাথে লড়াই করে। কেননা তার সাথে তার সঙ্গী শয়তান রয়েছে।’ (মুসলিম)
শয়তান থেকে বাঁচার সতর্কতা
আল্লাহ তাআলা মানুষকে শয়তানের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য কোরআনুল কারিমে সতর্ক করেছেন। আবার শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকতে দোয়াও শিখিয়েছেন।
শয়তান থেকে বাঁচতে এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা এভাবে সতর্ক করেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّبِعُوۡا خُطُوٰتِ الشَّیۡطٰنِ …
‘হে মুমিনরা, তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না।...’ (সুরা নুর : আয়াত ২১)
কুমন্ত্রণা দেওয়া শয়তান থেকে বাঁচার উপায়
১. শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচতে দোয়া পড়া
কোরআনে পাকে একাধিক কৌশল ওঠে এসেছে। আল্লাহ তাআলা একটি আয়াতকে দোয়া হিসেবে নাজিল করেছেন। তাহলো-
رَّبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ - وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَن يَحْضُرُونِ
উচ্চারণ : ‘রাব্বি আউজুবিকা মিন হামাযাতিশ শায়াত্বিন। ওয়া আউজুবিকা রাব্বি আইঁ ইয়াহদুরুন।’
অর্থ : ‘হে আমার পালনকর্তা! আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আমার প্রভু! আমার নিকট তাদের উপস্থিতি থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (সুরা মুমিনূন : আয়াত ৯৭-৯৮)
২. মিথ্যা ও পাপ ছেড়ে দেওয়া
যে কাজে শয়তান মানুষের সঙ্গে লেগে থাকে, তাহলো পাপ ও মিথ্যা। এ কাজ দুটি ছেড়ে দিতে হবে। কাজ দুটির ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের আয়াতে এভাবে ওঠে এসেছে-
هَلۡ اُنَبِّئُکُمۡ عَلٰی مَنۡ تَنَزَّلُ الشَّیٰطِیۡنُ - تَنَزَّلُ عَلٰی کُلِّ اَفَّاکٍ اَثِیۡمٍ
‘আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দেব, কার কাছে শয়তানরা অবতীর্ণ হয়? তারাতো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক চরম মিথ্যাবাদী ও পাপীর কাছে।’ (সুরা শুআরা : আয়াত ২২১-২২২)
৩. হৃদয়ের কঠোরতা ছেড়ে দেওয়া
অন্তরে দয়া পোষন করা। কারণ পাষাণ হৃদয়ের মানুষের সঙ্গী শয়তান। যারা অন্যের পেছনে লেগে থাকে এবং পাষাণ হৃদয়ের হয়। তাই শয়তান তাদের পেছনেও লেগে থাকে। তাদের জন্য অকল্যাণ, অমঙ্গল ও নানা রকম ক্ষতি নিয়ে আসে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
لِّیَجۡعَلَ مَا یُلۡقِی الشَّیۡطٰنُ فِتۡنَۃً لِّلَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِهِمۡ مَّرَضٌ وَّ الۡقَاسِیَۃِ قُلُوۡبُهُمۡ ؕ وَ اِنَّ الظّٰلِمِیۡنَ لَفِیۡ شِقَاقٍۭ بَعِیۡدٍ
‘এটা এই জন্য যে শয়তান যা প্রক্ষিপ্ত (পাঠ) করে, তিনি তা তাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ করেন— যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে এবং যারা পাষাণ হৃদয়। নিশ্চয়ই জালিমরা দুস্তর মতভেদে আছে।’ (সুরা হজ : আয়াত ৫৩)
৪. আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না হওয়া
অনেক মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়। তারা মহান প্রতিপালক ও স্রষ্টা আল্লাহর স্মরণে গাফিলতি করে। তার ইবাদত-বন্দেগি থেকে দূরে সরে থাকে। আর এমন সব লোকদের পেছনে শয়তান লেগে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ مَنۡ یَّعۡشُ عَنۡ ذِکۡرِ الرَّحۡمٰنِ نُقَیِّضۡ لَهٗ شَیۡطٰنًا فَهُوَ لَهٗ قَرِیۡنٌ - وَ اِنَّهُمۡ لَیَصُدُّوۡنَهُمۡ عَنِ السَّبِیۡلِ وَ یَحۡسَبُوۡنَ اَنَّهُمۡ مُّهۡتَدُوۡنَ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয়, আমি তার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান। এরপর সে তার সহচর হয়। শয়তানরাই মানুষকে সৎপথ থেকে বিরত রাখে, অথচ মানুষ মনে করে তারা সৎপথে আছে।’ (সুরা যুখরুফ : আয়াত ৩৬-৩৭)
৫. আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা
আল্লাহর কথা যাদের মনে পড়ে না এবং যারা মন আল্লাহকে স্মরণ করে না; শয়তান তাদের পেছনে লেগে থাকে। তাদের বিপথে পরিচালিত করে, শয়তান তাদের দুনিয়া-আখিরাত বরবাদ করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
اِسۡتَحۡوَذَ عَلَیۡهِمُ الشَّیۡطٰنُ فَاَنۡسٰهُمۡ ذِکۡرَ اللّٰهِ ؕ اُولٰٓئِکَ حِزۡبُ الشَّیۡطٰنِ ؕ اَلَاۤ اِنَّ حِزۡبَ الشَّیۡطٰنِ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ
‘শয়তান এদের ওপর চেপে বসেছে এবং তাদেরকে আল্লাহর জিকির ভুলিয়ে দিয়েছে। এরাই শয়তানের দল। জেনে রাখ, নিশ্চয়ই শয়তানের দল ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সুরা মুজাদালা : আয়াত ১৯)
কোরআন-সুন্নাহর আলোকে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, প্রত্যেকের সঙ্গে শয়তান আছে। আর তাই শয়তানের যাবতীয় কুমন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকতে উল্লেখিত বিষয়ের ওপর যথাযথ আমল করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন সুন্নাহর ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে সবাইকে হেফাজত করুন। আমিন।
এমএমএস/এএসএম